img

নীরব অশ্রু -রেজুয়ান আহম্মেদ

প্রকাশিত :  ০৭:০৮, ০১ অক্টোবর ২০২৪

নীরব অশ্রু  -রেজুয়ান আহম্মেদ

চার দশক—একটা দীর্ঘ সময়। এই সময়ের মধ্যে কত মানুষের ভাগ্য বদলেছে, কত সম্পর্ক নতুন মোড় নিয়েছে, কত মানুষ জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু করিমন বেগমের জীবন যেন থেমে আছে এক অদৃশ্য চক্রে। চারিদিকে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে, কিন্তু সেই হাওয়া যেন করিমনের দিকে কখনও তাকায়নি।

করিমন বেগম ঢাকার গুলশানের চৌধুরী মঞ্জিলে গৃহপরিচারিকার কাজ করছেন বিগত ৪০ বছর ধরে। যখন প্রথম এসেছিলেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র কুড়ি। তখন ঢাকার গুলশান ছিল অনেকটাই নিরিবিলি, বড় বড় দালানগুলো তখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়নি। চৌধুরী মঞ্জিলের উঁচু দালানের নিচের ছোট্ট ঘরে করিমন থাকতেন, আর দিনের পর দিন সেই দালানের নিচেই তার জীবন বন্দী হয়ে রইল।

প্রথম দিকে চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে অনেক ব্যস্ততা ছিল। বাড়ির মালিক চৌধুরী সাহেব ছিলেন একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তার স্ত্রী, তিন সন্তান, আত্মীয়স্বজন মিলে বাড়িতে সবসময় জমজমাট পরিবেশ ছিল। করিমনের কাজ ছিল গোছগাছ করা, রান্নাঘরে সাহায্য করা, এবং বাড়ির বাচ্চাদের দেখাশোনা করা। কিন্তু বাচ্চাদের খেলায় ব্যস্ত থাকতে থাকতে কখন যে করিমনের নিজের শৈশব হারিয়ে গেল, সেটা সে নিজেও টের পায়নি।

কালের স্রোতে চৌধুরী সাহেবের ছেলেমেয়েরা বড় হলো। একে একে সবাই বিদেশে পাড়ি জমালেন। চৌধুরী মঞ্জিলের জমজমাট পরিবেশ ধীরে ধীরে নিস্তব্ধ হতে লাগল। চৌধুরী সাহেবও বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেলেন। করিমন দেখল, তার চারপাশের সবাই বদলে যাচ্ছে, কিন্তু তার নিজের জীবন থমকে আছে। সে আজও সেই একই ছোট্ট ঘরে, একই কাজের চাপে জর্জরিত।

তারও তো স্বপ্ন ছিল, একদিন ভাগ্য বদলাবে, জীবনের চাকা ঘুরবে। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও করিমনের জন্য সেই পরিবর্তনের কোন সংকেত এলো না। তার ছোট মেয়ে রহিমা আজও সেই ছোট্ট গ্রামে, যেখানে করিমনের জন্ম হয়েছিল। মেয়েটার বিয়ে দিতে পারেনি, ভালো শিক্ষাও দিতে পারেনি। আর এই অপূর্ণতার কষ্টে করিমনের দিনগুলো আরও ভারী হয়ে উঠছে।

চৌধুরী মঞ্জিলে করিমন বেঁচে আছে কেবলই দায়িত্ববোধ থেকে। বয়সের কারণে তার শরীরের শক্তি কমে গেছে, কিন্তু মনোবল আজও অটুট। তবুও প্রতি রাতে যখন একা বিছানায় শুয়ে থাকে, তখন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়ের মুখ। \"রহিমার বিয়েটা না দিতে পারলে আমার শান্তি হবে না,\" করিমন মনে মনে নিজেকে এই কথা বলে।

রহিমার জীবনও যেন তার মায়ের মতোই থমকে আছে। করিমন চেয়েছিল, তার মেয়ে যেন তার মতো পরের বাড়িতে কাজ না করে, যেন একটা ভালো জীবন পায়। কিন্তু সেই আশাও যেন নিভে যেতে বসেছে। গ্রামের বাড়িতে রহিমা এখন মায়ের অপেক্ষায় থাকে, কবে তার বিয়ে হবে, কবে তার জীবনেও একটু সুখের রোদ উঠবে।

একদিন করিমন গুলশান থেকে ছুটি নিয়ে গ্রামে গেল। মেয়ের সঙ্গে বসে অনেক কথা বলল, কিন্তু কিছুতেই সে মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। সে জানে, তার মেয়ে তার ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু তার নিজের জীবনেই তো কোন স্বস্তি নেই। মায়ের মুখের করুণ চাহনি দেখে রহিমাও বুঝতে পারল, মায়ের মতো তার জীবনও কোনদিন বদলাবে না।

গ্রাম থেকে ফিরে আসার পর করিমনের দিনগুলো আরও নিস্তেজ হয়ে গেল। চৌধুরী মঞ্জিলে এখন তেমন কাজ নেই, ঘরটাও অনেকখানি ফাঁকা। শুধু বয়সী চৌধুরী সাহেব আর তার স্ত্রী রয়ে গেছেন, আর তাদের দেখাশোনা করা করিমনের দায়িত্ব। করিমন মনে মনে ঠিক করে, যতদিন পারবে, এ বাড়িতেই থাকবে। তার জীবনে পরিবর্তন আসুক বা না আসুক, সে নিজের দায়িত্ব থেকে কখনও সরে আসবে না।

একদিন রাতে করিমন চুপচাপ বসে ছিল, তখন হঠাৎ করেই একটা ফোন আসে। ফোনের ওপাশে রহিমার গলা, \"মা, তোমার শরীরটা কেমন?\" করিমন কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে যায়। সে জানে, তার শরীর ভালো নেই। কিন্তু সে এসব কিছু মেয়েকে বলতে চায় না। করিমন জানে, সে যদি একবারও মেয়েকে দুর্বলতার কথা বলে, তাহলে তার মেয়ে আরও ভেঙে পড়বে।

সেই রাতে করিমন বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে, জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল, কিন্তু তার নিজের জন্য কিছুই করতে পারল না। মেয়ের জন্যও কিছু করতে পারল না। এই কষ্টের বোঝা নিয়ে সে কতদিন আর টিকে থাকবে?

করিমন জানে, পৃথিবীর অন্য প্রান্তে চৌধুরী মঞ্জিলের প্রতিটি সদস্যের জীবন বদলে গেছে। বড় বড় গাড়ি, উঁচু দালান আর বিদেশের সোনালি ভবিষ্যৎ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তার নিজের জীবন? সে যেন একটি ছোট্ট গাছ, যার শেকড় মাটিতে বদ্ধ হয়ে গেছে, কিন্তু তার ডালপালা বাড়ার কোন সুযোগ পায়নি।

রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে করিমনের চোখে জল ভেসে আসে। গুলশানের উঁচু দালানগুলো আকাশ ছুঁয়েছে, কিন্তু তার ভাগ্য যেন আজও সেই মাটির কাছেই পড়ে আছে।

img

ঈদ যখন কাঁদে অভাবের কাছে: উৎসবের আলো আর অন্ধকারের গল্প

প্রকাশিত :  ০৫:৩০, ০৮ জুন ২০২৫

ঈদের নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট শিশুর হাসিমাখা মুখ, নতুন জামার রঙ, বাজারের কোলাহল, সুগন্ধে ভরা রান্নাঘর আর পরিবারজুড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা। মনে হয়, এ যেন এক মিলনের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব—মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক মহা-উপলক্ষ।

কিন্তু একটু ভাবুন—এই উৎসব কি সবার জন্য একই রকম আনন্দ বয়ে আনে?

ঈদের পেছনের সেই নিঃশব্দ কান্না

আমরা অনেকেই ঈদের আগে বাজারে যাই, জামাকাপড় কিনি, খাবারদাবারে ঘর সাজাই, ছবি তুলে পোস্ট দিই—সবই স্বাভাবিক আনন্দের অংশ। কিন্তু আমাদের আশপাশেই এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ঈদের আগের রাতে জানে না, পরদিন সকালে তাদের শিশুটি আদৌ কিছু খেতে পাবে কি না।

তারা ফেসবুকে অন্যদের ছবিতে ঈদের রঙ দেখে, ছেলেমেয়েদের হাসিমুখ দেখে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আমেজটা গায়ে মাখার চেষ্টা করে—কিন্তু মনে মনে ভেঙে পড়ে।

একজন মা যখন সন্তানের নতুন জামার আবদার শুনে চুপ করে থাকেন, চোখের জল আড়াল করতে রান্নাঘরে চলে যান—তখন ঈদের আনন্দ তার কাছে হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য বোঝা।

তিনি বলেন, “কাল পাবে বাবা, কাল পাবে”—এই ‘কাল’ যে কবে আসবে, তিনি নিজেও জানেন না। তবু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করাটাই যেন তার ঈদের একমাত্র প্রস্তুতি।

রিকশাচালক বাবার সন্ধ্যা

রিকশা চালানো মানুষটি ঈদের দিনেও রাস্তায় থাকেন—কারণ এই দিনটিতে একটু বেশি উপার্জনের সম্ভাবনা থাকে। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত শরীরে, পকেট ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা।

বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার জামা কই?”

তিনি মাথা নিচু করে বলেন, “এইবার না, পরেরবার।”

এই কথাটি বলার সময় তার বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যায়—তা কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না।

শিশুর চোখে ঈদের রংহীনতা

ঈদ তো শিশুদের আনন্দের দিন—এমনটাই শুনে বড় হয় তারা। কিন্তু যেসব শিশু নতুন জামা পায় না, খেলনা পায় না, পেট ভরে খেতে পায় না—তারা কেমন করে ঈদ উদযাপন করে?

তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদ দেখে। এক ধরনের ঈর্ষা, অপমান আর অক্ষমতা মিশে তৈরি হয় তাদের জীবনের প্রথম ঈদের শিক্ষা—“ঈদ সবার জন্য নয়।”

এই শিক্ষা একটি শিশুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অভিমান, সমাজব্যবস্থার প্রতি রাগ, ঈদের প্রতি ঘৃণা।

ঈদের আসল পাঠ—কোথায় হারিয়ে গেল?

ঈদের মূল শিক্ষা ছিল সহমর্মিতা, সমতা ও ভালোবাসা। কিন্তু আজকাল এই শিক্ষা অনেক সময় ফেসবুক পোস্ট আর ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যাকাত-সদকা অনেকটাই লোক দেখানো কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

আসলে, একটি দরিদ্র শিশুকে জামা কিনে দেওয়া কোনো দয়া নয়—এটা তার ন্যায্য প্রাপ্য। একজন রিকশাচালককে ঈদের দিনে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া সহানুভূতি নয়, বরং ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব পালন।

হাজার টাকায় ফিরতে পারে একটি ঈদ

আপনার ঈদের খরচ যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়, তার মধ্যে মাত্র এক হাজার টাকা ব্যয় করলেই একটি পরিবারের মুখে ঈদের হাসি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একটা জামা, একজোড়া জুতো, এক প্লেট বিরিয়ানি—এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়। সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই এই ছোট ছোট উপহারগুলো বহু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

ঈদ সবার হোক—তবেই পূর্ণতা

আমরা চাই না সবাই সমাজবিপ্লবী হোক। শুধু চাই—আপনার পাশের দরিদ্র শিশুটির জন্য একটি জামা কিনে দিন। রাস্তার সেই বৃদ্ধ মায়ের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি তুলে দিন।

এই ছোট ছোট ভালোবাসার কাজগুলোই ঈদকে সত্যিকার অর্থে সবার করে তোলে।

রাষ্ট্র কি পারত না পাশে দাঁড়াতে?

একটি রাষ্ট্র চাইলে ঈদের দিনে কোনো পরিবার না খেয়ে থাকবে না—এটা নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়। ঈদের সময় একটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চালু করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া যেত—এটা হতে পারত এক নতুন দৃষ্টান্ত।

সরকারি খাদ্য সহায়তা, জামা বিতরণ, শিশুবান্ধব উপহার কার্যক্রম—এসব শুরু হলে ঈদ আর কারো জন্য অন্ধকার হয়ে থাকত না।

ঈদ হোক ভালোবাসার নাম

আমরা যতই বলি ঈদ মানে আনন্দ, ততদিন তা খালি বুলি হিসেবেই থাকবে—যতদিন না আমরা সেই আনন্দ সবার মাঝে ভাগ করে নিতে শিখি।

এই ঈদে আসুন আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিই—একটি মুখে হাসি ফোটাব, একটি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে বলব: “তোমরা একা নও।”

এই ছোট ছোট ভালোবাসার স্পর্শগুলোই ঈদকে ঈদ বানায়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার আগে যদি একটু ভাবি—আমার চারপাশে কেউ কি আজও না খেয়ে আছে? কারো সন্তানের মুখ কি আজও শুকনো?

কারণ ঈদ শুধু নামাজের উৎসব নয়। ঈদ হলো হৃদয়ের উৎসব—যেখানে সকল শ্রেণি, সকল মানুষ একসাথে বলে, “আমরা একসাথে।”

ঈদ হোক সেই ভালোবাসার গল্প—যা শুরু হয় একজন মানুষের হাসি দিয়ে, আর ছড়িয়ে পড়ে হাজারো হৃদয়ে।