img

নোনাজল! -রেজুয়ান আহম্মেদ

প্রকাশিত :  ১৯:১৫, ০১ অক্টোবর ২০২৪

কক্সবাজারের জেলে পল্লীর জীবন কখনোই সহজ নয়। এখানকার মানুষগুলো প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। তাদের জীবনে আলোর চেয়ে  অন্ধকার বেশি। এই পল্লীতে মাত্র কয়েকশো মানুষ বসবাস করে, যারা মূলত জেলে। তাদের মূল পেশা মাছ ধরা। তারা দিনের পর দিন সমুদ্র থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু তাদের জীবনে কোনো উন্নতি আসে না। কারণ এই পল্লীর প্রায় প্রতিটি পরিবারই মহাজনের কাছ থেকে আগেই টাকা ধার নিয়ে সংসার চালায়। দাদন নিয়ে কেউ কেউ নৌকা বানায়, মাছ ধরার সরঞ্জাম কেনে। অনেক কষ্ট করে মাছ ধরে আনার পর নানা কারণে মহাজনের কাছে অল্প দামে বিক্রি করতে হয় মাছ। দিন শেষে ঋণের বোঝা শোধ করতে করতে তাদের জীবন বয়ে চলে অভাবের স্রোতে, ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। এমন এক পল্লী \"শাপলা দ্বীপ\" এর মানুষের জীবন নিয়ে আমাদের গল্প। 

\"শাপলা দ্বীপে\" আজ ভোরের সূর্য এখনো পুরোপুরি উঠেনি। আধো আলো আধো অন্ধকারে সমুদ্রের পার ঘেঁষে দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে কিশোর আকমল। আকমলের বয়স মাত্র নয় বছর। সে একজন উচ্ছল চঞ্চল যুবক। অসম্ভব ভালো গান করে। আকমল কিশোর বয়সেই জীবন, জীবন বোধ এবং প্রতিবাদের গান করে। আজ আকমল অজানা কোন আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের কোলে। আকমল হঠাৎ করে খেয়াল করে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা একজন মানুষ বালিতে উপর হয়ে পড়ে আছে। সমস্ত উচ্ছলতা থেমে যায় আকমলের। আধো আলোয় চিনতে পারে না আকমল মানুষটিকে। খুব সাহস নিয়ে কাছে গিয়ে দেখে মানুষটি তাদের জেলে পল্লীর মকবুল। গত সাত দিন ধরে নিখোঁজ মকবুল। দৌড়ে চলে যায় আকমল জেলে পল্লীতে। সংবাদ দেয় মকবুলের স্ত্রী কুসুমকে। উন্মাদ হয়ে যায় কুসুম। ছুটে যায় সমুদ্রের দিকে। পিছু নেয় মোমেনা, নজরুল, কালা মিয়া, কফিল সহ অনেকেই। 

গত সাতদিন আগে অভাবের তাড়নায় ঝগড়া হয় মকবুল আর কুসুমের মধ্যে। রাগে, দুঃখে জীবনের প্রতি অভিমান করে ঋণগ্রস্ত মকবুল একাই গিয়েছিল মধ্য সমুদ্রে মাছ ধরতে। আর ফিরে আসেনি। 

দাফন শেষে সবাই যখন জেলে পল্লীতে কুসুমকে সান্তনা দিচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে বাবুল মহাজন এসে মকবুলের ঘরটি দখল করে নেয়। কারণ মহাজনের কাছ থেকে দুই দফায়  তিরিশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল মকবুলের। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়তে বাড়তে ৫০ হাজারে ঠেকেছে। জেলে পল্লীর সবার শত অনুরোধ উপেক্ষা করে পাওনা টাকার বিনিময়ে ঘর দখল করে কুসুমকে ঘরছাড়া করে মহাজন। 

কিন্তু কুসুম এখন কোথায় যাবে? জেলে পল্লীর কেউ কুসুমকে আশ্রয় দেয় না। অবশেষে সদ্য স্বামীহারা কুসুমের আশ্রয় মিলে মোমেনার ঘরে।

মোমেনা এই জেলে পল্লীর একজন সংগ্রামী নারী। প্রতিমুহূর্তেই জীবনের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে আছে মোমেনা। তাকে নিয়ে পুরো পল্লীতেই কানাঘুষা চলে। দুই বছর আগে মোমেনার স্বামী আবেদ আলীও সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সেই থেকে মোমেনা তার স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায়। দেখতে অত্যন্ত সুন্দরী মোমেনা, লোভনীয় যৌবন। যৌবন আর সৌন্দর্যই মোমেনার জীবনে কাল হয়ে এসেছে। বাবুল মহাজন সুযোগ বুঝে প্রতিনিয়তই মোমেনাকে নানাভাবে কু-প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মোমেনা প্রতিবারই মকবুলকে প্রত্যাখ্যান করে। মোমেনার হৃদয়ে আবেদ আলির স্মৃতি। প্রতি মুহূর্তেই আবেদ আলীর সাথে প্রেমময় সম্পর্কের স্বপ্ন দেখে মোমেনা। স্মৃতি মন্থর হয়। কত কথা, কত গল্প, কত ভাব, কত মুহূর্ত, কত প্রেম। এই স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছে মোমেনা। তার বিশ্বাস একদিন আবেদ আলী ফিরে আসবেই।

কুসুমকে আশ্রয় দেওয়াতে মোমেনার উপর ক্ষেপে যায় মহাজন। মহাজনের মাছের আরতেই স্বল্প বেতনে কাজ করতো মোমেনা। সেই দিয়েই তার সংসার চলতো কোনরকম। হঠাৎ করেই মহাজন চাকরি থেকে মোমেনাকে ছাটাই করে। প্রতিবাদী মোমেনা যুদ্ধ করেও জয়ী হয় না। এমনকি মহাজনের কাছে পাওনা কয়েক হাজার টাকা মোমেনা আদায় করতে পারে না। একদিন মহাজন বলে- এটাই নাকি তার অপরাধের শাস্তি। মহাজন মোমেনাকে আবারো প্রস্তাব দেয়- মাত্র একটি রাত তার সাথে তার চালার আরামদায়ক বিছানায় একান্তে থাকবার জন্য। রাগে দুঃখে মোমেনা কলস ভর্তি পানি মহাজনের বিছানায় ঢেলে দিয়ে বলে- প্রয়োজনে সমুদ্রে ডুইবা মরমু তাও তোর মতো হারামজাদার কাছে যামু না। আরো ফুসে ওঠে বাবুল মহাজন।

এক রাতে মোমেনা আর কুসুম যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন বাবুল মহাজনের লাঠিয়াল আজিম আর রফিক আসে মোমেনাকে তুলে নিতে। কিন্তু তাদের বাধা হয়ে দাঁড়ায় আফজাল। মহাজনের লাঠিয়াল দের হাত থেকে উদ্ধার করে আফজাল মোমিনাদের।

আফজাল এই \"শাপলা দ্বীপ\"এর একমাত্র শিক্ষিত তরুণ যুবক। সে অত্যন্ত প্রতিভাবান ছেলে। যার স্বপ্ন বিসিএস পাস করে সরকারের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী হওয়ার। এবং ভবিষ্যতে শিক্ষা এবং সুবিধা বঞ্চিত মৎস্য শিল্প এবং মৎস্যজীবীদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করার। দরিদ্র ঘরের সন্তান হলেও পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী আফজাল। মৎস্য পল্লীর বাসিন্দারা  লেখাপড়ায় আগ্রহী না হলেও গোপনে পড়ালেখা করে আফজাল আজ শিক্ষিত যুবক। প্রতিবাদী আফজাল স্বপ্ন দেখে জেলে পল্লীর মানুষদের জীবনধারার পরিবর্তন আনার। এবং সে আরো বিশ্বাস করে এই ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থায় যদি  শিশু-কিশোরদেরকে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পারে তাহলেই তাদের মুক্তি। 

মহাজন আফজালের উপর ক্ষেপে যায়। কিন্তু কিছু বলার সাহস পায় না। কারণ আফজাল ভয়ংকর খ্যাপাটে স্বভাবের। অপেক্ষায় থাকে সুযোগের। 

মোমেনা এবং কুসুমের যখন অভাবের তাড়নায় না খেয়ে থাকার উপক্রম হয় তখন আফজাল তাদেরকে সহযোগিতার জন্য পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদেরকে নিয়ে আসে কক্সবাজার শহরে।যেখানে বিভিন্ন হোটেলে থালা-বাসন ধোয়া, মসলা বাটার কাজে যোগ দেয় মোমেনা এবং কুসুম। 

এইতো সুযোগ বাবুল মহজনের। লাঠিয়াল আজিম এবং রফিকের মাধ্যমে \"শাপলা দ্বীপে\" ছড়িয়ে দেওয়া হয় মোমেনা এবং কুসুম কক্সবাজার হোটেলে হোটেলে বিভিন্ন জনের সাথে অসামাজিক কাজে লিপ্ত।এবং তাদেরকে সহযোগিতা করে আফজাল। ধীরে ধীরে বদনাম ছড়িয়ে যায় পুরো জেলে পল্লীতে। প্রভাবিত হতে পারে তরুণ সমাজ এই বলে বিচার বসানো হয় তাঁদের বিরুদ্ধে। বিচারক বাবুল মহাজন একতরফা বিচারে মোমেনা এবং কুসুমের অপরাধের শাস্তি হিসেবে আজিম এবং রফিককে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত দেন। নইলে গ্রাম ছাড়া হতে হবে। প্রতিবাদ করে মোমেনা এবং কুসুম। তাতেও কাজ হয় না। আবারও পাশে এসে দাঁড়ায় আফজাল। স্থানীয় থানার পুলিশের সহযোগিতায় বানোয়াট বিচার সালিশের আয়োজন ভন্ডুল হয়।

ইলিশ মাছ ধরার সিজন চলে আসে। মহাজন জেলেদের ঠকানোর জন্য নানা ধরনের ফন্দি ফিকির আটে। আফজাল জেলে পল্লীর তরুণদের সংগঠিত করে তাদেরকে সাথে নিয়ে একতাবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এইবার মহাজনের কাছ থেকে কোনরকম সহযোগিতা নেবেনা তারা। মাছও বিক্রি করবেন বাবুল মহাজনের কাছে। 

প্রয়োজনে সিন্ডিকেট ভেঙে চট্টগ্রামের মাছ ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করবে। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি চলতে থাকে। জেলেরা সবাই একত্রিত হয়ে রাত দিন পরিশ্রম করে পুরনো জাল, নৌকা মেরামত করে। তাদের এই একত্রিত প্রচেষ্টায় জেলে পল্লীতে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে নিটোল আনন্দ। সবাই যখন নিজেদের মতো করে মাছ ধরতে যাবে ঠিক আগের রাতে নৌকায় আগুন জ্বালিয়ে দেয় মহাজনের লোকজন। কিন্তু কোন প্রমাণ রাখে না। 

আবারো অসহায় হয়ে পড়ে জেলে পল্লীর সদস্যরা। অবশেষে বাধ্য হয়ে সহযোগিতার জন্য বাবুল মহাজনের কাছেই যেতে হয় তাদের। কিন্তু বাবুল মহাজন  সহযোগিতা করবে না বলে জেলেদের তাড়িয়ে দেয়। এবং বলে তোমাদের আজকের দুর্দিনের জন্য দায়ী নব্য শিক্ষিত, ঘাড় তেরা বেয়াদব যুবক আফজাল। সিজন চলে গেলে তাদের তো আর ইলিশ ধরা হবে না। এটাই তো উপার্জনের মাধ্যম। এতে করে ব্যাহত হবে তাদের সংসার চালানো। ধীরে ধীরে জেলে পাড়ার সবাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সমস্ত অপরাধের দায় আফজালকে দিতে থাকে। আফজাল সত্য বুঝাতে অক্ষম হয়। বিসিএস এর ভাইবা পরীক্ষা দেয়ার প্রয়োজনে আফজালকে ঢাকায় চলে আসতে হয় কিছুদিনের জন্য। মহাজন বলে আফজাল তোমাদের বিপদে ফেলে ভেগে গেছে। সবাই আবার মহাজনের চক্রান্তের ফাঁদে পা দেয়। আফজাল এর উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়। এবং সিদ্ধান্ত নেয় আর কোনদিন আফজালকে তাদের পল্লীতে ফিরে আসতে দিবে না।

জেলে পাড়ার আরেকটি চরিত্র ফুলবানু। বয়সের ভারে তার জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। অভাব তাকে ক্রমাগত কষ্ট দিয়ে চলেছে। এতদিন ধরে বেঁচে থাকা যেন জীবনে এক ভয়ংকর অভিশাপ। এই জেলে পরিবারের বিভিন্ন ঘটনার কালের সাক্ষী তিনি। জীবনযুদ্ধে পরাজিত ফুলবানু সৃষ্টিকর্তাকে প্রতিনিয়ত  দোষারোপ করে। তার বাবা, তার স্বামী এবং একমাত্র ছেলে সন্তান একে একে হারিয়ে গেছে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে। কপালে নেই শান্তি, তাই জীবনের শেষ বেলায়ও তার চোখে অশ্রু, মনে কষ্ট। ফুলবানুর জীবনের ভাজে ভাজে গল্প। ধীরে ধীরে গল্প উম্মোচিত হতে থাকবে।

কিছুদিন পর মধ্য সমুদ্রে ইলিশ মাছ ধরতে যাওয়া জেলেরা খালি নৌকা নিয়ে ফিরে আসে। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে উত্তাল সমুদ্রের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে আসে তারা। ঝড় জলোচ্ছ্বাস এর পূর্বাভাস না পাওয়ায় এবং মোকাবেলা করার সরঞ্জাম বা প্রস্তুতি না থাকায় তাদের এই পরাজয়। অসহায় ব্যর্থ এই সমস্ত জেলেরা বাবুল মহাজনের কাছে আবারো আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু মহাজন কোনভাবেই ছাড় দিতে নারাজ। যেভাবেই হোক তার টাকা ফেরত চাই। চলতে থাকে অমানবিক শাস্তি। 

পাহাড় কেটে বসতি তৈরি করবে মহাজন। বেড়াতে আসো টুরিস্টদের রিসোর্ট হবে এখানে। এই দায়িত্ব জেলেদের কাধে পড়ে উঁচু উঁচু শক্ত পাহাড় কেটে বসতি গড়ে দিতে পারলেই ঋণ মুক্ত হবে তারা। বিনিময় কোন পারিশ্রমিক পাবে না শুধু দুই বেলা খাবার ছাড়া। অসহায় জেলেরা বাধ্য হয় মহাজনের এই শর্ত পূরণ করতে। 

ঠিক তখনই জেলে পল্লীতে আগমন ঘটে  শ্রাবন্তী নামের এক তরুণীর। 

শ্রাবন্তী মাহমুদ একজন বাঙালি শিক্ষার্থী হিসেবে নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অফ বার্গেন এ  পিএইচডি করছে। থিসিস করার জন্য \"শাপলা দ্বীপ\" এর জেলেপাড়া ফিট হিসেবে বেছে নিয়েছে। আধুনিক এবং শিক্ষিত শ্রাবস্তীর উপস্থিতি পল্লীতে এক নতুন আলো নিয়ে আসে। সে এখানে এসে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে গবেষণা শুরু করে। কিন্তু তার এই আগমনে শংকিত হয় মহাজন। জেলে পাড়ার মানুষ যদি পৃথিবীর সভ্যতা যেনে যায় তাহলে তার উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যাঘাত ঘটবে। শুরু হয় দ্বন্দ্ব।

মহাজন শ্রাবন্তীকে সহযোগিতার ভাব দেখিয়ে সার্বক্ষণিক তার পাশে নিজের লোক লাগিয়ে রাখে। প্রথমে বুঝতে পারে না শ্রাবন্তী। বিশ্বাস করে বাবুল মহাজনকে। অপরদিকে বাবুল মহাজন বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে শ্রাবন্তীকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। শ্রাবস্তী মহাজনের দুষ্ট রাজনীতিতে অজ্ঞ। 

একদিন শহর থেকে ফিরে আসে আফজাল। জেলে পাড়ার জেলেরা আফজালকে থাকতে দিতে চায় না শাপলা দ্বীপে। বাবুল মহাজনের দুষ্ট কার সাথে করে আফজাল এর উপর ছেলেদেরকে খেপিয়ে তুলেছিল তার বহিঃপ্রকাশ পাওয়া যায়। সাধারণ ছেলেদের মধ্যে ঢুকে বাবুল মহাজনের লোক গণপিটুনি দেয় আফজালকে। জেলেরা এই ঘটনায় বোকা হয়ে যায়, অস্বস্তিতে পড়ে কারণ তারা তো আফজালে গায়ে হাত তুলতে চায় নাই। আফজাল পরিচয় হয় শ্রাবন্তীর সাথে। তারপর নানা সময় নানা কথা। এই প্রথম আফজাল শক্তি খুঁজে পায় শ্রাবন্তীকে কাছে পেয়ে। দুর্গম অঞ্চলে যেখানে শিক্ষার কোন আলো নেই সেখানে আফজালের মত শিক্ষিত এবং মেধাবী একজন মানুষকে পেয়ে শ্রাবন্তী বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। এক সময় থিসিস করতে আসা শ্রাবন্তী জড়িয়ে যায় জেলে পল্লীর সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে। ধীরে ধীরে আধুনিকতার ছোঁয়া আনার চেষ্টা করে জেলে পল্লীতে। 

ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের সহযোগিতায় মাছ ধরা, ন্যায্য দামে মাছ বিক্রি করা থেকে সবকিছুই সহজ হয়ে উঠতে থাকে \"শাপলা দ্বীপে\"। গল্প মোর নয় অন্যদিকে।

মাছ ধরতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে আহত হওয়া আরেক চরিত্র কালা মিয়া। কালা মিয়া এই পল্লীর আদি বাসিন্দা। শ্রী মারা গেছে বছরখানেক আগে। একদিন তার দুই বছরের শিশুর জন্য দোকান থেকে দুধ চুরি করতে বাধ্য হয় কালা মিয়া। 

কিন্তু চুরি করতে গিয়ে দোকানদারের গাছে ধরা পড়ে কালামিয়া। পল্লীর মানুষের কাছে তার চুরির ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। কিন্তু কেউ তার পরিস্থিতি বুঝতে চায় না। লজ্জায় কালামিয়া আত্মহত্যা করে শিশু কে সাথে নিয়ে। আসে পুলিশ। 

আতঙ্কে থাকে জেলে পল্লীর বাসিন্দারা। এটা আরেকটি মানবিক গল্প। ধীরে ধীরে গল্পের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। 

গল্পের শুরুর দিকের চরিত্র কিশোর আকমল। আকমলের বাবার নাম কফিল। কফিল ভবের মানুষ। সংগীতের সাথে তার বসবাস। সংসার বৈরাগী কফিল জীবনের বাস্তবতা বুঝছ নাই কোনদিন। আজ সে অসুস্থ। কিশোর আকমল সাগর পাড়ে গান গেয়ে টাকা তুলে বাবার চিকিৎসার খরচ যোগানোর চেষ্টা করে। তার কণ্ঠে জেলে পল্লীর লোকেরা আশার গান শুনতে পায়। সংগীত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে শ্রাবন্তী আকমল কে আবিষ্কার করে ভিন্ন রূপে। তাকে নিয়ে যায় শহরে সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। একদিন আকমল একটি রিয়েলিটি শোর সুবাদে সংগীত শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। ফিরে আসে আবার জেলে পল্লীতে আপন মানুষদের কাছে। পাশে থাকবার প্রাণান্তর চেষ্টায়।

শ্রাবন্তীর থিসিস করার ক্ষেত্রে আফজাল শ্রাবন্তীকে নানা ধরনের সহযোগিতা করে। তাদের সম্পর্ক আরো গভীর হয়। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব তারপর নতুন স্বপ্ন দেখা। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসায় পরিণত হয়। কিন্তু তাদের এই স্বপ্ন পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায় যথারীতি সরদার। আফজালের পূর্বপুরুষ সর্দারের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা দাদন নিয়েছিল যা এখনো পরিশোধ হয়নি। শ্রাবন্তী জানার পর সমস্ত ঋণ পরিশোধ করার ব্যবস্থা নেয়। মহাজন আরো শংকিত হয়। শ্রাবন্তির পরিবারের ঠিকানা জোগাড় করে শ্রাবন্তীর বাবাকে সমস্ত কিছু জানায় মহাজন। শ্রাবন্তীকে না জানিয় ই একদিন কক্সবাজারে আসে শ্রাবন্তীর বাবা। শ্রাবন্তি বাবাকে দেখে বিস্মিত হয়। গল্প মোর নেয় অন্যদিকে।

শাপলা দ্বীপের আরেকটি চরিত্র করিম চাচা। করিম চাচা পল্লীর সবচেয়ে প্রবীণ একজন। তিনি খুব অসুস্থ, কিন্তু টাকার অভাবে কোনো চিকিৎসা করতে পারছেন না। তার চোখে কেবলই কষ্ট, আর মুখে অসহায়ত্ব। গ্রামের মানুষগুলো করিম চাচার দুর্দশা দেখে কষ্ট পেলেও তার জন্য কিছু করতে পারে না। তার চিকিৎসার খরচ মেটাতে পল্লীর মানুষদের অনেকবার একত্রিত হওয়ার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু সেই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। মৃত্যু পথযাত্রী করিম চাচা প্রায়শই যৌবন কালের গল্প বলে- মধ্য সমুদ্রে ইলিশ মাছ ধরার গল্প।

কফিলের বড় মেয়ে আফসানা, দেখতে সুন্দর এবং পড়াশোনায় ভালো। সে এই বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। আফজাল, শ্রাবন্তী সহ পুরো পল্লী তাকে নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু তার জীবনেও কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। দোকানদার নজরুল, যিনি পল্লীর একমাত্র মুদি দোকানের মালিক। বয়স ৩৫ এর উপরে হবে। সে পছন্দ করে আফসানাকে। বিয়ে করতে চায়। অর্থের অভাবে আফসানার বাবা নজরুলের সাথে আফসানার বিয়ে দিতে রাজি হয়। আফসানা তার এই বিয়ে মেনে নিতে পারে না। কারণ সে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই তো স্বপ্ন। আফসানার বাবার বক্তব্য গরীবের অবাস্তব স্বপ্ন পূরণ হয় না, তাই বিয়ে চূড়ান্ত করে ফেলে। কিশোরী আফসানা সহযোগিতা নাই শ্রাবন্তীর। বিয়ের রাতে যখন সব আয়োজন চূড়ান্ত তখন শ্রাবন্তী থানা থেকে পুলিশ এনে আফসানার পাশে দাঁড়ায়। ভেঙে যায় বিয়ে। আফসানা লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয় শ্রাবন্তী। 

বিসিএস এ ভালো রেজাল্ট করে আফজাল। চাকরি হয় মৎস্য ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে। ট্রান্সফার হয়ে আসে কক্সবাজার। এদিকে থিসিস কমপ্লিট হয়ে যায় শ্রাবন্তীর। ফিরে যাওয়ার সময় হয়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশেই থাকবে। আফজাল এবং শ্রাবন্তীর প্রেম গভীর হয়। বিয়ে করে ফেলে গোপনে। বাবুল মহাজন তাদের নিয়ে বাজে গল্প ছড়ায়। আবারো শ্রাবন্তীর বাবার সহযোগিতা চায় মহাজন। কিন্তু শ্রাবন্তীর বাবা মেয়ের ভালোবাসার স্বীকৃতি দেয়। অর্থ দিয়েও সহযোগিতা করে জেলে পল্লীর সাধারণ জেলেদের। 

অবশেষে শ্রাবন্তী এবং আফজাল মৎস্যজীবীদের উন্নয়নে নানা ধরনের প্রস্তাবনা দেয় মন্ত্রণালয়ে। ধীরে ধীরে ভাগ্য পরিবর্তন হতে থাকে সুবিধাবঞ্চিত শাপলা পল্লীর জেলেদের। 

অশিক্ষিত বাচ্চাদের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রাথমিক স্কুল খুলে সেখানে। এগিয়ে আসে সরকার সহ সর্বস্তরের মানুষ। নতুন আলোয় আলোকিত হয় \"শাপলা পল্লী\"।

img

বংশের পরিচয়!

প্রকাশিত :  ১২:০০, ১২ মে ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

আষাঢ়ের এক ভিজে বিকেল। আকাশের গর্জন থেমে গেছে বটে, কিন্তু বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। উঠোনে জমে আছে নিঃশব্দতা। দূরের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গান—যেন সময় থেমে গেছে, কিংবা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।  

রতন মাস্টার বসে আছেন পুরোনো আমগাছটার ছায়ায়। হাতে নাইলনের সুতো, বাঁধছেন মাছ ধরার জাল। দেখে মনে হয়, এই জালের ফাঁকেই তিনি বুনে চলেছেন জীবনের গল্প—ভাঙা স্বপ্ন, না বলা কথা, হারিয়ে যাওয়া সময় আর কিছু গোপন কষ্ট।  

ঠিক এমন সময়, গ্রামের পেছনের কাদা-ঢালা পথ বেয়ে এসে দাঁড়াল সজল। আধময়লা ছেঁড়া জিন্স, হাঁটুর কাছ থেকে ঝুলে থাকা ইয়ারফোনের তার, আর চোখজোড়া যেন কিছু হারানোর গ্লানিতে ঘোলাটে।  

সে আমগাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, একটু নিচু গলায় বলল,  

— “মাস্টার চাচা... শহরের বন্ধুরা মজা করে বলে ‘রংপুরের মফিজ’। তাদের পূর্বপুরুষরা কেউ জমিদার, কেউ ব্যারিস্টার। আর আমার শিকড় তো চাষার ঘরে...”

রতন মাস্টার চশমাটা একটু উঁচু করে তাকালেন। চোখের কোণায় বয়সের ভাঁজ হলেও, দৃষ্টিতে ছিল একরাশ কোমলতা। ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললেন,  

— “চা খাবি সজল? পাতলা লেবু চা, না কি গাঢ় দুধ চা?”

সজলের গলা কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল,  

— “যে চায়ের কাপে বংশের গরিমার সুবাস থাকে, সেই চা চাই…”

রতন মাস্টার জালটা থামিয়ে পাশে রাখলেন। একটু নীরব হয়ে বললেন,  

— “আয়, আজ তোকে একটা গল্প শোনাই। এক চাষার গল্প, যার হাতে ছিল না জমিদারি দলিল, কিন্তু মুঠোয় ছিল বিশুদ্ধ স্বপ্ন আর সৎ ইচ্ছে।” 

এ গল্প আসলে তাঁর নিজের—রতন মাস্টারের। মাটির ঘরে জন্ম তাঁর, টিনের চাল ভেদ করে বৃষ্টির পানি যে ঘরে প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে দিত। বাবা শিবু মণ্ডল, গরিব কৃষক; আধ বিঘা জমি, আর সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। মা পদ্মা দেবী রোজ ভোরে বলে উঠতেন,  

— “মানুষের উপকার করিস রতন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তো সবচেয়ে বড় ধর্ম।”

রতনের বয়স তখন বারো, সেদিনই তাঁর বাবা না-ফেরার দেশে চলে যান। সেই ছোট্ট কাঁধে সংসারের ভার। গরুর পিঠে চড়ে দুধ বিক্রি করতেন সকালে, আর রাতে স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে পড়তেন। পাড়ার ছেলেরা হাসত, বলত—“দুধওয়ালা পণ্ডিত!” 

রতন হেসে বলত, “এক গরু দিচ্ছে শরীরের শক্তি, আরেকটা মনকে দিচ্ছে জ্ঞানের আলো—দুটোই দরকার মানুষ বাঁচাতে।”

একবার পরীক্ষার হলে সবাই নকল করছে। রতন সাদা খাতা জমা দেয়। শিক্ষক রেগে গিয়ে বললেন, “তুই ফেল করলি!”  

রতনের জবাব ছিল—“খাতায় ফেল, কিন্তু বিবেকের খাতায় তো একশো!” 

দিন গড়াতে গড়াতে তাঁর পাঠশালায় ভিড় বাড়ে। গরিব, অনাথ, পথশিশু—সবাই তাঁর ছাত্র। একদিন গ্রামের চেয়ারম্যান ঠাট্টা করে বললেন, “চাষার ঘরে জন্ম নিয়ে এত পড়া শিখে কী করবি?”

রতনের উত্তর ছিল, “জন্ম তো আমার হাতে ছিল না। কিন্তু আমি মানুষের মতো মানুষ হবো, এটা আমার সিদ্ধান্ত!”

মুসলিম-হিন্দু, জাত-পাত তাঁর কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঈদের সকালে গোপাল কাকার বাড়ি গিয়ে হাতে মিষ্টি তুলে দিতেন, আবার দুর্গাপূজায় মুসলিম ছেলেদের সাথে মিলে মণ্ডপে আলপনা আঁকতেন।  

একবার মন্দিরে আগুন ধরলে, তিনি দৌড়ে ঢুকে যান আগুনে। হাত পুড়ে গেলেও মুখে শুধু বললেন, “মানুষের ধর্মে আগুন লাগলে, পানি ঢালাটাই তো আমার কাজ।”

একদিন এক রাজনীতিবিদ এলেন ভোট চাইতে। রতন জিজ্ঞেস করলেন, “গ্রামের সেই অন্ধ মা যার চোখে অস্ত্রোপচারের টাকা নেই, আপনি কি তাঁর জন্য কিছু করেছেন?”

তিন দিন পর রাজনীতিবিদ এসে প্রণাম করে বললেন, “আপনি শিখিয়ে দিলেন, রাজনীতি মানে পকেট ভরা না, হৃদয় ভরা!”

সজল নীরবে শুনছিল। সেদিন থেকে তার ভেতরটা বদলে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও আর শহরের চাকরির পেছনে ছুটল না। গড়ে তুলল ‘মাটির পাঠশালা’। সেখানে এখন রাস্তার শিশুরা শেখে অক্ষর চিনতে, আর স্বপ্ন দেখতে। রতনের কথা সে লিখে রেখেছে ডায়েরির প্রথম পাতায়—  

“বংশের পরিচয় রক্তে নয়, কর্মে।” 

পঁচিশ বছর কেটে গেছে...  

গ্রামের মেলায় মাইক হাতে সজল দাঁড়িয়ে বলছে,  

— “আমার পেছনে নেই জমিদার বংশ, নেই ইতিহাসের ভারি গরিমা। আছে এক মাটির মানুষ, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন—মানুষের পরিচয় তার আদর্শে, তার কাজে।”

মাঠজুড়ে করতালির শব্দ। ছাপড়া ঘর থেকে হেঁটে এলেন এক বৃদ্ধ—রতন মাস্টার। পায়ের জুতা নেই, কিন্তু চোখে জল। গ্রামের মানুষ চিৎকার করে উঠল,  

— “এই তো আমাদের গর্ব, আমাদের বংশ!”  

রতন মাস্টার চোখ মুছে শুধু বললেন,  

— “বংশ মানে জন্ম নয়। বংশ মানে নদীর মতো হওয়া—নিজের পথ নিজেই বানিয়ে, সবার পিপাসা মেটানো।”

তোমার জন্ম হয়তো মাটির ঘরে, কিন্তু কর্ম যদি হয় আকাশ ছোঁয়া, তবে সেই কর্মই তোমার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। কারণ, সত্যিকারের বংশ পরিচয় রক্তে নয়—আদর্শে।