অচেনা সমাজে স্বীকৃতির সংগ্রাম!
রেজুয়ান আহম্মেদ
রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনা যাচ্ছিল। শহরের এক কোণে একদল কুকুর জড়ো হয়েছে, যেন তাদের হৃদয়ের কষ্টগুলো ভাগাভাগি করছে। মাথায় ছিল একই চিন্তা— “কেন আমরা সমাজে অবাঞ্ছিত? আমাদের কি কোন অধিকার নেই? এই দেশেই তো আমাদের জন্ম, বাংলাদেশেই আমাদের শিকড়।” নীলু নামের একটি পুরনো কুকুর সেই সভার মূল বক্তা।
নীলু বললো, “আমরা এই দেশের সন্তান। আমাদের পূর্বপুরুষরাও এই মাটিতে জন্মেছে, মরে গেছে। কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার কি এত কম যে, মানুষ আমাদের দেখলেই পাথর ছুড়ে মারে, লাঠি দিয়ে পেটায়? আমরা তো কখনও তাদের ক্ষতি করিনি, কখনো তাদের জীবনের পথে বাধা দিইনি।”
একটা ছোট কুকুর, মধু, কেঁদে উঠলো, “কেন আমাদের জীবন এত কঠিন? আমরা তো দেশি কুকুর, তাতে আমাদের দোষ কি? কেন আমাদের উপর এত ঘৃণা, এত অত্যাচার?”
বুড়ো কুকুর নীলু একটু থেমে কথা বলতে শুরু করলো, “তোমরা জানো, মানুষরা বিদেশি কুকুরদের কতো সম্মান দেয়? এয়ার কন্ডিশনড (এসি) রুমে রাখে, দামি খাবার দেয়, গাড়িতে কোলে নিয়ে ঘোরে। আর আমাদের? আমাদের কোনো ঘর নেই, খাবারের জন্য আমাদের রাস্তায় লড়াই করতে হয়। কেন এই বৈষম্য?”
মধু আবার বলল, “তারা কেন আমাদের ঘৃণা করে, নীলু ভাই? আমরা কি মানুষদের ক্ষতি করি? আমরা তো না চাইতেও তাদের গৃহের পাহারাদার হয়ে যাই, তাদের ভালোবাসার জন্য লেজ নাড়ি। তবুও তারা আমাদের তাড়িয়ে দেয়। তাদের জন্য আমরা অবাঞ্ছিত।”
কুকুরদের এ সমাবেশে ক্রমশ কষ্টের ভার বেড়ে চলছিল। সবার মাথায় একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—তাদের জীবনের মানে কী? কুকুরদের জীবন কি শুধুই উপেক্ষিত থাকার জন্য, অপমান সহ্য করার জন্য? তাদের এই দেশে জন্ম, বাংলাদেশি বংশের অধিকার কি একেবারেই মূল্যহীন?
একজন বৃদ্ধা কুকুর ধীরে ধীরে উঠলো। তার শরীর ক্লান্ত, চোখের গভীরতা বলে দিচ্ছে বছরের পর বছর অত্যাচার সয়ে আসার কাহিনি। সে বলে উঠলো, “মানুষরা আমাদের সাথে অন্যায় করে যাচ্ছে। আমরা সেও ভালোবাসা দিতে জানি, কিন্তু আমরা তার বদলে পাই লাথি, অপমান। বিদেশি কুকুরদের যত্নে রাখার যে ভালোবাসা, সেটা কি আমাদের প্রাপ্য নয়?”
কুকুরদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো, “আমরা এই শহরে জন্মেছি, এই শহরে মরবো। কিন্তু বেঁচে থাকার অধিকার আমাদেরও আছে। আমরা তো কারো ক্ষতি করি না। আমাদের অপরাধ শুধু একটাই— আমরা দেশি কুকুর!”
অপর প্রান্তে দাঁড়ানো একটা ছোট কুকুর নরম গলায় বললো, “মানুষ কেন বুঝতে চায় না? আমরা তাদের মতোই জীবন্ত প্রাণী। আমাদেরও ক্ষুধা লাগে, ঠান্ডা লাগে, কষ্ট হয়। আমরা তো মানুষকে কখনো আঘাত করিনি, তবুও কেন আমাদের উপর এত অত্যাচার?”
শহরের মানুষগুলো জানতেও চায় না এই কুকুরদের কথা। তাদের জীবন মানেই যেন কেবল ঘৃণা আর নির্যাতনের সাথে লড়াই। তারা এ দেশেই জন্মেছে, কিন্তু তারা যেন সমাজের চোখে চিরকাল পরবাসী। কুকুরদের কাছে একটাই অনুরোধ, একটাই প্রার্থনা— "আমাদের উপর নির্যাতন বন্ধ করুন। আমরা অনেক অসহায়, আমরা তো আপনাদের কোন ক্ষতি করিনা। দয়া করে আমাদেরও বাঁচার একটু সুযোগ দিন।"
এই কথাগুলো বলতে বলতে কুকুরদের মধ্যে কেমন এক স্থিরতা নেমে এলো। সবাই একমত হলো—এবার আন্দোলনের সময় এসেছে। মানুষদের বুঝতে হবে, কুকুরদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তারা এবার নিজেদের জন্য কথা বলবে। তাদেরও সমাজে স্থান পাওয়ার অধিকার আছে।
শহরের রাতের অন্ধকারে কুকুরদের এই ছোট্ট সমাবেশ তাদের হৃদয়ের কষ্টগুলো প্রকাশের শুরু। তারা জানে যে, এই সমাজ তাদের সহজে গ্রহণ করবে না। কিন্তু তারা লড়াই করবে, যতদিন না তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নীলুর কথাগুলো সবাইকে এক সুতোয় বাঁধল, "আমরা হেরে যেতে পারি, কিন্তু আমাদের সম্মানের জন্য, আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য এই লড়াই চলতেই থাকবে। আমরা দেশি কুকুর, এই মাটির সন্তান।"
গল্পের শেষ প্রান্তে, এক উজ্জ্বল সকাল আসে। সেই সকালে দেখা যায়, কিছু মানুষ কুকুরদের দিকে ভালোবাসার চোখে তাকাচ্ছে। যেন তারা বুঝতে শুরু করেছে, এই সমাজে কুকুরদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কুকুরদের প্রতি তাদের চোখের দৃষ্টিতে প্রথমবারের মতো এ কধরনের মমতা ফুটে উঠেছে।
এ যেন তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফল। সমাজে স্বীকৃতি পেতে কুকুরদের আরও লড়তে হবে, কিন্তু এই ছোট পরিবর্তনটাই তাদের আশা বাড়িয়ে দেয়।
শেষ