img

অচেনা সমাজে স্বীকৃতির সংগ্রাম!

প্রকাশিত :  ১৮:৩৯, ০২ অক্টোবর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ২০:০২, ০২ অক্টোবর ২০২৪

অচেনা সমাজে স্বীকৃতির সংগ্রাম!

রেজুয়ান আহম্মেদ


রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনা যাচ্ছিল। শহরের এক কোণে একদল কুকুর জড়ো হয়েছে, যেন তাদের হৃদয়ের কষ্টগুলো ভাগাভাগি করছে। মাথায় ছিল একই চিন্তা— “কেন আমরা সমাজে অবাঞ্ছিত? আমাদের কি কোন অধিকার নেই? এই দেশেই তো আমাদের জন্ম, বাংলাদেশেই আমাদের শিকড়।” নীলু নামের একটি পুরনো কুকুর সেই সভার মূল বক্তা।

নীলু বললো, “আমরা এই দেশের সন্তান। আমাদের পূর্বপুরুষরাও এই মাটিতে জন্মেছে, মরে গেছে। কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার অধিকার কি এত কম যে, মানুষ আমাদের দেখলেই পাথর ছুড়ে মারে, লাঠি দিয়ে পেটায়? আমরা তো কখনও তাদের ক্ষতি করিনি, কখনো তাদের জীবনের পথে বাধা দিইনি।”

একটা ছোট কুকুর, মধু, কেঁদে উঠলো, “কেন আমাদের জীবন এত কঠিন? আমরা তো দেশি কুকুর, তাতে আমাদের দোষ কি? কেন আমাদের উপর এত ঘৃণা, এত অত্যাচার?”

বুড়ো কুকুর নীলু একটু থেমে কথা বলতে শুরু করলো, “তোমরা জানো, মানুষরা বিদেশি কুকুরদের কতো সম্মান দেয়? এয়ার কন্ডিশনড (এসি) রুমে রাখে, দামি খাবার দেয়, গাড়িতে কোলে নিয়ে ঘোরে। আর আমাদের? আমাদের কোনো ঘর নেই, খাবারের জন্য আমাদের রাস্তায় লড়াই করতে হয়। কেন এই বৈষম্য?”

মধু আবার বলল, “তারা কেন আমাদের ঘৃণা করে, নীলু ভাই? আমরা কি মানুষদের ক্ষতি করি? আমরা তো না চাইতেও তাদের গৃহের পাহারাদার হয়ে যাই, তাদের ভালোবাসার জন্য লেজ নাড়ি। তবুও তারা আমাদের তাড়িয়ে দেয়। তাদের জন্য আমরা অবাঞ্ছিত।”

কুকুরদের এ সমাবেশে ক্রমশ কষ্টের ভার বেড়ে চলছিল। সবার মাথায় একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—তাদের জীবনের মানে কী? কুকুরদের জীবন কি শুধুই উপেক্ষিত থাকার জন্য, অপমান সহ্য করার জন্য? তাদের এই দেশে জন্ম, বাংলাদেশি বংশের অধিকার কি একেবারেই মূল্যহীন?

একজন বৃদ্ধা কুকুর ধীরে ধীরে উঠলো। তার শরীর ক্লান্ত, চোখের গভীরতা বলে দিচ্ছে বছরের পর বছর অত্যাচার সয়ে আসার কাহিনি। সে বলে উঠলো, “মানুষরা আমাদের সাথে অন্যায় করে যাচ্ছে। আমরা সেও ভালোবাসা দিতে জানি, কিন্তু আমরা তার বদলে পাই লাথি, অপমান। বিদেশি কুকুরদের যত্নে রাখার যে ভালোবাসা, সেটা কি আমাদের প্রাপ্য নয়?”

কুকুরদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠলো, “আমরা এই শহরে জন্মেছি, এই শহরে মরবো। কিন্তু বেঁচে থাকার অধিকার আমাদেরও আছে। আমরা তো কারো ক্ষতি করি না। আমাদের অপরাধ শুধু একটাই— আমরা দেশি কুকুর!”

অপর প্রান্তে দাঁড়ানো একটা ছোট কুকুর নরম গলায় বললো, “মানুষ কেন বুঝতে চায় না? আমরা তাদের মতোই জীবন্ত প্রাণী। আমাদেরও ক্ষুধা লাগে, ঠান্ডা লাগে, কষ্ট হয়। আমরা তো মানুষকে কখনো আঘাত করিনি, তবুও কেন আমাদের উপর এত অত্যাচার?”

শহরের মানুষগুলো জানতেও চায় না এই কুকুরদের কথা। তাদের জীবন মানেই যেন কেবল ঘৃণা আর নির্যাতনের সাথে লড়াই। তারা এ দেশেই জন্মেছে, কিন্তু তারা যেন সমাজের চোখে চিরকাল পরবাসী। কুকুরদের কাছে একটাই অনুরোধ, একটাই প্রার্থনা— "আমাদের উপর নির্যাতন বন্ধ করুন। আমরা অনেক অসহায়, আমরা তো আপনাদের কোন ক্ষতি করিনা। দয়া করে আমাদেরও বাঁচার একটু সুযোগ দিন।"

এই কথাগুলো বলতে বলতে কুকুরদের মধ্যে কেমন এক স্থিরতা নেমে এলো। সবাই একমত হলো—এবার আন্দোলনের সময় এসেছে। মানুষদের বুঝতে হবে, কুকুরদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তারা এবার নিজেদের জন্য কথা বলবে। তাদেরও সমাজে স্থান পাওয়ার অধিকার আছে।

শহরের রাতের অন্ধকারে কুকুরদের এই ছোট্ট সমাবেশ তাদের হৃদয়ের কষ্টগুলো প্রকাশের শুরু। তারা জানে যে, এই সমাজ তাদের সহজে গ্রহণ করবে না। কিন্তু তারা লড়াই করবে, যতদিন না তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। নীলুর কথাগুলো সবাইকে এক সুতোয় বাঁধল, "আমরা হেরে যেতে পারি, কিন্তু আমাদের সম্মানের জন্য, আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য এই লড়াই চলতেই থাকবে। আমরা দেশি কুকুর, এই মাটির সন্তান।"

গল্পের শেষ প্রান্তে, এক উজ্জ্বল সকাল আসে। সেই সকালে দেখা যায়, কিছু মানুষ কুকুরদের দিকে ভালোবাসার চোখে তাকাচ্ছে। যেন তারা বুঝতে শুরু করেছে, এই সমাজে কুকুরদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। কুকুরদের প্রতি তাদের চোখের দৃষ্টিতে প্রথমবারের মতো এ কধরনের মমতা ফুটে উঠেছে।

এ যেন তাদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফল। সমাজে স্বীকৃতি পেতে কুকুরদের আরও লড়তে হবে, কিন্তু এই ছোট পরিবর্তনটাই তাদের আশা বাড়িয়ে দেয়।

শেষ

img

মায়ের ভালোবাসা!

প্রকাশিত :  ০৯:২০, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৯:২৪, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪

রেজুয়ান আহম্মেদ

মেঘলা আকাশ, গুমোট বাতাস, সিলেটের জৈন্তাপুর ফেরিঘাট এলাকার মেঠোপথে এক অদৃশ্য দুঃস্বপ্নের ছায়া। দূরে এক পাহাড়ি নদীর স্রোত যেন ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বন্যার খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আর লোকজন দলবেঁধে নিরাপদ স্থানে ছুটছে। তবে গ্রামের শেষপ্রান্তে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে তখনও এক মা তার ছোট্ট সন্তানকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বসে আছে। সুলতানা, এই মায়ের নাম, আর তার ছোট্ট ছেলের নাম নাবিল।

সুলতানার জীবন ছিল সংগ্রামের এক নিঃশেষ পরিসংখ্যান। তিন বছর আগে সে তার প্রিয়জন, তার স্বামীকে হারিয়েছে। একাকী, অদম্য শক্তি আর সাহস নিয়ে, গ্রামীণ জীবনে সংসারের হাল ধরেছিল। তার দিন গিয়েছিল অন্যের বাড়িতে হাঁড়ি ধুয়ে, কাজ করে, আর রাতে বাড়ি ফিরে তার একমাত্র ছেলেকে স্নেহের মাঝে মানুষ করার চেষ্টা। নাবিল ছিল তার জীবনের একমাত্র আশ্রয়, জীবনের একমাত্র প্রেরণা। মায়ের মুখে সবসময় শুনত, “তোর জন্যই আমি বাঁচি, রে। তুই-ই আমার স্বপ্ন।”

কিন্তু সে দিনটা ছিল অন্যরকম। বন্যার স্রোত যখন বাড়তে লাগল, প্রতিবেশীরা এসে বলল,

“সুলতানা, তুই এখনো বসে আছিস? পানি কিন্তু সব ডুবিয়ে দিচ্ছে। চল, আমাদের সঙ্গে চল।”

সুলতানা তার চোখে একবার তাকাল তার ছেলেকে। কোলের নাবিল তখন গভীর ঘুমে। তার ছোট্ট নিঃশ্বাসে যেন পৃথিবীর সমস্ত শান্তি ছিল। সুলতানা মৃদু হেসে বলল,

“তোমরা যাও। আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে। ওকে নিয়ে কীভাবে বেরোব? ঘুম থেকে জাগলেই যাব।”

কিন্তু এই কথাগুলো ছিল শুধু সন্তানকে সুরক্ষিত রাখার অজুহাত। তার বুকের ভেতরে চলছিল এক গভীর দ্বন্দ্ব। “আমি যদি বের হই, নাবিলকে বাঁচাতে পারব তো?”

ঘরের ভেতর পানি ঢুকতে শুরু করল। সময় ছিল না, তাড়াহুড়া করে সুলতানা ঘরের কোণায় রাখা একটি পুরনো কাঠের বাক্স টেনে আনল। ভাবল, যদি এই বাক্সে ছেলেকে রাখে, তবে হয়তো স্রোতের হাত থেকে রক্ষা পাবে। দ্রুত সে তার গায়ের চাদর দিয়ে বাক্সটি মুড়িয়ে দিল, যেন পানি ভেতরে না ঢোকে।

ছেলেকে বাক্সে রেখে সুলতানা নিজে বসে রইল বাক্সের পাশে। তার হাত শিশুটির গায়ে রেখে বারবার অনুভব করছিল, “আমার জীবন যাক, কিন্তু ও যেন বাঁচে।” ঘরের ভেতর পানি আরও বেশি বাড়তে লাগল, সুলতানা বাক্সটি শক্ত করে ধরে রেখে পানির স্রোতের সঙ্গে লড়াই করল। তার কণ্ঠে একটিই প্রার্থনা ছিল,

“হে আল্লাহ, আমার সন্তানকে বাঁচাও। ওর জীবন যেন আমার চেয়েও বেশি দামি হয়।”

বন্যার স্রোতে ভেসে গেল কুঁড়েঘর। সুলতানা এক হাত দিয়ে বাক্সটি ধরে রেখেছিল, আর অন্য হাত দিয়ে একটি গাছের ডাল আঁকড়ে রইল। অনেকক্ষণ ধরে লড়াই করার পর সুলতানা বুঝতে পারল, তার শরীর আর স্রোতের সঙ্গে লড়তে পারছে না। কিন্তু মায়ের মন যেন দেহের শারীরিক শক্তি ছাড়িয়ে এক অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছিল। শেষবারের মতো ছেলেকে চুমু খেয়ে, বাক্সটি ঠেলে দিল পানির বিপরীতে। তার শরীর আর শক্তি ছিল না, কিন্তু বুকের ভেতর তার একক সাধনা ছিল—“আমার সন্তান যেন বাঁচে।”

সুলতানা নিজের হাত ছেড়ে দিয়ে স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে গেল। পরদিন ভোরে গ্রামবাসী একটি ভাসমান বাক্স দেখতে পেল। বাক্সটি খোলার পর তারা দেখল, নাবিল জীবিত আছে, শুকনো চাদরে মুড়ে রাখা। কিন্তু তার মা আর নেই।

গ্রামের মানুষ কাঁদল। সবাই বলল, “মায়ের ভালোবাসা এমনই। নিজের জীবন দিয়ে সন্তানকে বাঁচায়।”

মায়ের ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ অনুভূতি। এটি সময়, স্থান বা পরিস্থিতি মেনে চলে না। মা তার সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তা আর কেউ কখনো করতে পারবে না। মায়ের ভালোবাসা শুধুমাত্র প্রেম নয়, এটি এক আত্মত্যাগ, এক বিশাল শক্তি, যা পৃথিবীর সমস্ত শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে সন্তানকে রক্ষা করে। মা শুধুই মা নয়, সন্তানের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষাকবচ।

এটাই মা-বাবার প্রতি সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা যেন কখনো শেষ না হয়। মা তার সন্তানকে শুধু জন্মই দেয় না, তাকে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলে, আর সেই ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য রত্ন।

এই ভালোবাসার কোনও সীমা নেই। এটি নিজস্বতায়, জীবনের প্রতি অটুট বিশ্বাসে ভরা। সত্যিকার অর্থে, একজন মা তার সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তা আর কেউ কখনো করতে পারবে না, কারণ মা যেন এক পৃথিবী, যা তার সন্তানকে লালন-পালন করার জন্য এক অনবদ্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখে।