img

ইসলামি শাসনতন্ত্রের বাংলাদেশ:কতটা যৌক্তিক?

প্রকাশিত :  ০৬:৫৫, ০৭ অক্টোবর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:০০, ০৭ অক্টোবর ২০২৪

ইসলামি শাসনতন্ত্রের বাংলাদেশ:কতটা যৌক্তিক?

 সারওয়ার-ই আলম 

হাল আমলে জামায়াতে ইসলামীসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি রাজনৈতিক দল সংবিধানের মূলনীতি থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সরিয়ে ইসলামি শাসনতন্ত্রকে গ্রহণ করার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব দল ভাস্কর্য সহ্য করতে পারছে না, নারীদের শিক্ষা ও কাজ করা মানতে পারছে না, জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবী তুলছে এবং দেশের সংবিধানের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। ধর্মকে অবলম্বন করে পরিচালিত রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরণের চেষ্টা বাঙালি মুসলমানের দীর্ঘকালের অসাম্প্রদায়িক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার সামিল। কারণ বাংলাদেশের বাঙালিরা অত্যন্ত সচেতনভাবে একইসঙ্গে দুটি পরিচয় বহন করেন। এবং দুটি পরিচয়ের প্রতিই তাঁরা সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। একটি হলো তাঁদের ধর্মীয় পরিচয়, আর অন্যটি হলো জাতিগত পরিচয়। ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ খ্রীস্টান, কেউ বৌদ্ধ ইত্যাদি। এখানে তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে ভিন্নতা থাকে। কিন্তু জাতিগত পরিচয়ে তাঁদের মধ্যে কোনো ভিন্নতা থাকে না। এক্ষেত্রে তাঁদের সকলের বিশ্বাস ও পরিচয় এক ও অভিন্ন এবং তা হলো— সবাই বাঙালি।

কিন্তু তাই বলে এই জাতিগত পরিচয় বাঙালির ধর্ম পালনে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আমাদের দেশে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মুসলমান, হিন্দু, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা একই সমাজে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য রক্ষা করে বসবাস করে আসছেন। মুসলমানেরা তাঁদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী নামাজ পড়ছেন, রোজা রাখছেন, ঈদ উদযাপন করছেন, মসজিদে মসজিদে আজান হচ্ছে— এতে অন্য ধর্মের কেউ এসে তাঁদেরকে বাধা দিচ্ছেন না। একইসঙ্গে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মন্দিরে যাচ্ছেন, পুজামণ্ডপ তৈরি করে তাঁদের পুজা উদযাপন করছেন, বাড়িতে বাড়িতে উলু ধ্বনি দেয়া হচ্ছে— এতেও অন্য ধর্মের কেউ এসে তাদের কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন না। এটা সমানভাবে সত্য খ্রীস্টান, বৌদ্ধসহ অন্য সকল ধর্মের ক্ষেত্রেই।

এই আচার-অনুষ্ঠানগুলো হলো বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিজ নিজ অনুষ্ঠান।এর বাহিরেও আরো কিছু অনুষ্ঠান আছে যে অনুষ্ঠানগুলো কোনো ধর্মীয় পরিচয় বহন করে না। সেগুলো হলো ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠান, যে সব অনুষ্ঠানে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে বাঙালি একই কাতারে এসে হাজির হয়, যাকে আমরা বলতে পারি বাঙালির সর্বজনীন অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে পহেলা বৈশাখ, শহীদ দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসসহ অন্যান্য।

অন্য ধর্মের সঙ্গে না থাকলেও ইসলাম ধর্মের অনুশাসনের সঙ্গে সর্বজনীন বাঙালি উৎসবের কিছু মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। বাঙালি সংস্কৃতির অনেক আচার-অনুষ্ঠানকে মৌলভীরা বেশরিয়তী বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। তার মধ্যে নাচ-গান অন্যতম। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হলো— মৌলভীদের ফতোয়া শুনে ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বাঙালি মুসলমানেরা জাতিগত সংস্কৃতির সঙ্গে কখনোই সাংঘর্ষিক অবস্থানে নিয়ে যান না। নিয়ে যান না বলেই ধর্মের প্রচলিত ব্যাখ্যা অনুযায়ী গানবাজনাকে হারাম হিসেবে গণ্য করা হলেও বাঙালি মুসলমান নর-নারীরা যুগ যুগ ধরে ঠিকই গান বাজনা উপভোগ করে আসছেন। আমাদের দেশে ইসলামি জলসা যেমন হয় তেমনি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। বাঙালি মুসলমানেরা হলেন উদারনৈতিক মুসলমান। তাঁরা একদিকে যেমন নামাজ পড়েন অন্যদিকে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমাও দেখেন। তাঁরা রোজা পালন করেন আবার শহীদ মিনারে গিয়ে পুষ্পস্তবক দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাও জানান। পহেলা বৈশাখে, শহীদ দিবসে, বিজয় দিবসে ও স্বাধীনতা দিবসে দেশজুড়ে দেশপ্রেমিক বাঙালির যে স্বতস্ফূর্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা যায় তা তাদের ধর্মীয় পরিচয়কে ছাপিয়ে জাতিগত পরিচয়কেই সবচেয়ে বেশী উচ্চে তুলে ধরে। আর এ কারণেই বাঙালি মুসলমান উদারনৈতিক মুসলমান হিসেবে পরিচিত; যে পরিচয় এ দেশটিতে নির্মাণ করেছে ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অপূর্ব ঐতিহ্য।

বাঙালি মুসলমানদের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে তাঁরা ধর্ম পালনে মোটেই গোঁড়া নন। ধর্মীয় সংস্কৃতি ও বাঙালি সংস্কৃতিকে যুগপৎ ধারণ করে তাঁরা জীবন পরিচালনা করে থাকেন। এটি তাঁদের চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। বোধকরি এই বৈশিষ্ট্যের কথা মাথায় রেখেই স্বাধীনতা অর্জনের পর আমাদের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহন করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রাধান্য দেয়া হয়নি। রাষ্ট্রের নাম দেওয়া হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, ইসলামি প্রজাতন্ত্র নয়।

এখন জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, যারা সংবিধানে ইসলামি শাসনতন্ত্র সংযোজনের স্বপ্ন দেখছেন তাদেরকে স্মরণে রাখতে হবে যে তাদের এ চেষ্টা হবে বাঙালির ঐতিহ্যের প্রতি বিরুদ্ধাচারণ, এবং দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একইসঙ্গে এটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেও অস্বীকার করার সামিল কারণ সকল ধর্মের মানুষ মিলেই এ দেশটিকে স্বাধীন করেছে। দলগুলো যদি এ ধরণের চেষ্টা থেকে সরে না আসে তাহলে সেদিন মনে হয় খুব দূরে নয় যেদিন সচেতন বাঙালি মুসলমানেরা তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা শুরু করবে। ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে ব্যবহার করে মুসলমানদের মনে বিদ্বেষ ছড়িয়ে জাতীয ঐক্যে বিভেদ সৃষ্টির দায়ে তাঁরা ধীরে ধীরে জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হবে। আর জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলের পরিণতি যে কী ভয়াবহ তাতো আমরা বাংলাদেশের ইতিহাসেই দেখতে পাই।

তাই জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকাকে পরিবর্তনের অহেতুক দাবি না তুলে এদেশে রাজনীতি করতে চাইলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে সর্বাগ্রে নিজেদের চিন্তা-চেতনাকে পরিবর্তন করা। জনগণের মাঝে বিভাজন নয় ঐক্য সৃষ্টি করা। সংবিধান সংশোধনের দাবি তোলার আগে নিজেদের দলের গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনা। ইসলামি শাসনতন্ত্রের স্বপ্ন থেকে সরে আসা। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জনগণ যে কখনোই এ দেশে ইসলামি শাসনতন্ত্র মেনে নেবে না বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ইতিহাস আমাদেরকে সে বার্তাই দেয়।

img

যৌনতা এবং শারীরিক চাহিদা থেকে জীবনের পরিধি আরও অনেক বড় – এ আর রহমানের আত্মোপলব্ধি

প্রকাশিত :  ০৭:৩২, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৮:১১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

রেজুয়ান আহম্মেদ

অস্কারজয়ী সঙ্গীতশিল্পী এ আর রহমান, যিনি পৃথিবীকে সুরের মাধ্যমে নতুনভাবে চিনিয়েছেন, সম্প্রতি নিজের জীবনের এক অদেখা অধ্যায় প্রকাশ্যে এনেছেন। সায়রা বানুর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর, এক দীর্ঘ নীরবতার শেষে রহমান তাঁর ব্যক্তিগত যাত্রা সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে জীবনের উদ্দেশ্য এবং মানবিক সম্পর্কের মধ্যে শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার সীমা থাকে না; জীবনের পরিধি আরও অনেক বড় এবং গভীর।

তিনি তাঁর একটি বক্তব্যে বলেন, ‘‘যৌনতার মতো শারীরিক চাহিদা মেটানোই জীবনের সব নয়, কখনও…’’ তাঁর এই উক্তি শুধু একটি সঙ্গীতশিল্পীর দৃষ্টিকোণ নয়, বরং একটি জীবনদৃষ্টি, যেখানে আত্মিক পরিপূর্ণতা এবং মানসিক শান্তি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। রহমানের মতে, আমাদের জীবনে একটি গভীর শূন্যতা রয়েছে, যা শুধুমাত্র শারীরিক সুখ দ্বারা পূর্ণ হতে পারে না। আমাদের আধ্যাত্মিক বা মানসিক উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যা জীবনকে অর্থবহ এবং পূর্ণতা দেয়।

প্রায়ই সমাজে যৌনতা এবং শারীরিক সম্পর্ককে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু রহমানের অভ্যন্তরীণ জগতের এই খোলামেলা উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের জীবনের অঙ্গনের অনেক বৃহৎ ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে আনন্দ, শান্তি এবং পূর্ণতা আসতে পারে। ‘‘শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদা মেটানোই জীবনের সব নয়’’—এই কথায় তিনি একদিকে যেমন জীবনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করছেন, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বও তুলে ধরছেন।

এ আর রহমানের মতে, একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য তখনই ভালো থাকতে পারে, যখন সে জীবনের গভীরে প্রবাহিত হতে পারে। তিনি বলছেন, ‘‘অবসাদ ঘিরে ধরে, কারণ আমার মনে হয়, আমাদের সবার মধ্যেই একটা শূন্যতা রয়েছে।’’ এরই মধ্যে গল্পকাররা, দর্শন, বিনোদন, এমনকি কখনও কখনও ওষুধের মাধ্যমে এই শূন্যতা পূর্ণ করা যায়। কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য সেই সব জিনিসে সীমাবদ্ধ নয়।

এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, রহমানের ব্যক্তিগত জীবনের অধ্যায়গুলো। তাঁর স্ত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একটি অন্তর্দৃষ্টি দেয়, যে যেখানে তিনি তাঁর শূন্যতা, দুঃখ এবং সঙ্কটের মধ্যে থেকেও জীবনের একটি বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ খুঁজে পেয়েছেন। ‘‘এমনকি ভগ্ন হৃদয়ের ভারে ঈশ্বরের সিংহাসনও কেঁপে উঠতে পারে’’—রহমান তাঁর নিজের দুঃখ এবং সংগ্রামকে পৃথিবীর বৃহত্তর দুঃখের সঙ্গে তুলনা করছেন, যেখানে ক্ষতি এবং হতাশা একে অপরকে অনুসরণ করে। তবুও, তিনি এই ভঙ্গুরতার মধ্যে জীবনের অন্য অংশগুলির জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

এ আর রহমানের এই বক্তব্যে প্রতিটি মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রশংসা করা হয়েছে—মানসিক শান্তি, আত্মিক উন্নতি, এবং অন্যের জন্য বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। তিনি বলেছেন, ‘‘যখন তুমি অন্যের জন্য বাঁচবে, তখন তোমার মধ্যে এই চিন্তাগুলি আসবে না।’’ এর মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে জীবনকে শুধুমাত্র নিজের সুখের জন্য না, বরং একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বাঁচার পরামর্শ দিয়েছেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এমন একটি নৈতিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া উচিত, যা শুধুমাত্র আমাদের শারীরিক চাহিদা পূরণে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের আধ্যাত্মিক এবং মানসিক উন্নতি, আমাদের জীবনের বাস্তব মূল্যমানের পরিচয় দেয়।





রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম

মতামত এর আরও খবর