বন্যার্তদের সাহায্যার্থে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হলো সঞ্জয় দে'র একক সঙ্গীতসন্ধ্যা
সারওয়ার-ই আলম: শরতের মায়াবী সন্ধ্যায় গানে গানে, সুরে সুরে, অল্পস্বল্প গল্পকথায় লন্ডনের বাংলা সঙ্গীতপ্রেমীদেরকে গত ৪ঠা অক্টোবর শুক্রবার একটি অনুপম সঙ্গীতসন্ধ্যা উপহার দেন স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী সঞ্জয় দে। পূর্ব লন্ডনের একটি জনাকীর্ণ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় বাংলাদেশে বন্যাদুর্গতদের পুনর্বাসনে আর্থিক সাহায্য সংগ্রহের লক্ষ্যে। তাঁর এ মানবিক উদ্যোগে সাড়া দিয়ে কমিউনিটির বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিবর্গ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন এবং একটি সময়োপযোগী আয়োজনের জন্য তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন।
মেধাবী কিশোর নুরাজ রহমান অভ্যাগতদের স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠানটির শুভ সূচনা করে। তার আমন্ত্রণে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন শিল্পী সঞ্জয় দে, সঞ্চালক কিশোয়ার মুনিয়া এবং যন্ত্রশিল্পী তন্ময়, তানিম, অমি ও কীর্তি।
মনোজ্ঞ এ সঙ্গীতানুষ্ঠানটির শুরুটা হয় রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে। সকলকে স্বাগত জানিয়ে সঞ্জয় বলেন, জন্মভূমির জন্য মনটা ভীষণভাবে কাঁদে, আনন্দ উৎসবের সঙ্গে বয়ে চলে অশ্রুধারা। তাই রবীন্দ্রনাথ দিয়েই সূচনা করতে চাই। হৃদয়ের আবেগ উজাড় করে দিয়ে তিনি একে একে পরিবেশন করেন— প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু কাঁদে কেনরে মন, এমনি করে যায় যদি দিন যাক না, সকরুণ বেনু বাজায়ে কে যায় ইত্যাদি রবীন্দ্র সঙ্গীত।
রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুমধুর সুরের আবেশ ছড়িয়ে এরপর তিনি চলে যান আধুনিক গানের পরিবেশনায়। এ পর্বটি শুরু হয় শ্যামল মিত্রের গাওয়া গান দিয়ে। ' আমি চেয়ে চেয়ে দেখি সারাদিন'— গানটি অনুষ্ঠানে অপূর্ব আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দেয়। দর্শকদের অনেকেই তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে মুহূর্তটিকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলেন।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে সঞ্জয় ও মুনিয়া কথা বলে দর্শকদেরকে যুক্ত করছিলেন এবং গানগুলোর গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের ছোট ছোট স্মৃতিকথা তুলে ধরছিলেন; যা দর্শকদের আনন্দ উপভোগে যোগ করে এক ভিন্ন মাত্রা। কিশোয়ার মুনিয়া উত্তম কুমার ও শ্যামল মিত্রের একটি মানবিক গল্প উপস্থাপন করেন।
এরপর সঞ্জয় পরিবেশন করেন, 'কে প্রথম কাছে এসেছি, কে প্রথম চেয়ে দেখেছি, কিছুতেই পাই না ভেবে, কে প্রথম ভালবেসেছি, তুমি, না আমি?'— মান্না দে ও লতা মঙ্গেশকরের এ বহুল জনপ্রিয় গানটি। এ গানটি দর্শকদের এতটাই আপ্লুত করে যে দম্পতিদের অনেকেই একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে ভালবাসাভরা চাহনীতে জিজ্ঞেস করছিলেন— বলো কে প্রথম ভালবেসেছি?তুমি, না আমি...? এ গানটির ' কে প্রথম মন হারালো' গাইতে গিয়ে সঞ্জয় যেন হৃদয়ের সব দরদ ঢেলে দিচ্ছিলেন, যা দর্শকদেরকে দারুণভাবে আবেগাপ্লুত করে।
আধুনিক গানের পরিবেশনা শেষে আবারো অল্পস্বল্প কথোপকথন। কিছু মিষ্টি সংলাপ। সঞ্জয় কৃতজ্ঞচিত্তে বলেন, বিলেতের মাটিতে আজ যে বাংলা গান গাইছি তা সম্ভব হয়েছে আপনাদের অকৃত্রিম ভালবাসায়। আপনাদের এ ভালবাসা, এ উদার সহযোগিতা আশা করি অব্যাহত থাকবে এবং ভবিষ্যতে বিলেতে বাংলা গানের চর্চা ও প্রসারে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এরপর সঞ্জয় চলে যান দেশের গানে। গভীর আবেগের সংশ্লেষে তিনি পরিবেশন করেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় এর বিখ্যাত গান- আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই, আমি আমার আমিকে চিরদিন এ বাংলায় খুঁজে পাই। গানটির দর্শকদেরকে দারুণভাবে মোহিত করে। তাঁরা শিল্পীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে মিলনায়তনে ছড়িয়ে দেন দেশপ্রেমের সুললিত বাণী, দেশের প্রতি তাঁদের সুদৃঢ় প্রত্যয়।
এরপর তিনি পরিবেশন করেন- 'জ্যোৎস্না ভেজা এ রাত' গানটি। তারপর কিছুটা সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে। পরিবেশন করেন ' নীল আকাশের নীচে পৃথিবী আর পৃথিবীর 'পরে ওই নীলাকাশ তুমি দেখেছো কি' এ গানটি। লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া সলিল চৌধুরীর গান - আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে— গানটি অনুষ্ঠানে যোগ করে অনন্য সুরের আবেশ।
এরপর ছোট্ট একটি বিরতি। বিরতি পর্বে সুধীজনদের সুযোগ মেলে পরস্পরের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের, ছবি তুলে সঙ্গীতসন্ধ্যাটিকে স্মৃতির আলনায় তুলে রাখার। দ্বিতীয় পর্বের শুরুটা হয় নিয়াজ মোহাম্মদের আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়ল তোমায়- বহুল জনপ্রিয় এ গানটি দিয়ে। এরপর কিছুসময় রবীন্দ্রনাথ, কিছু সময় হেমন্ত, কিছু সময় জগজিৎ সিং, কিছু সময় কিশোর কুমার এবং কিছুটা সময় ভূপেন হাজারিকা থেকে দর্শকনন্দিত নির্বাচিত কয়েকটি গান পরিবেশন করেন সঞ্জয়। সঞ্জয়ের গায়কী অনন্য! তাঁর কণ্ঠ হৃদয়ছোঁয়া— অন্তর থেকে উৎসারিত মাধুর্যে ভরা— এমনটিই বলছিলেন দর্শকদের অনেকেই।
সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয়ে রাত দশটা। গায়ক, সঞ্চালক, দর্শক, যন্ত্রশিল্পী কারোরই যেন কোনো ক্লান্তি নেই।শিল্পী শেষের দিকটায় পরিবেশন করেন কাজল নদীর জলে ভরা— গানটি । গানটি দর্শকদের এতটাই প্রিয় যে এ গানটি নির্বাচন করায় তাঁরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে শিল্পীকে অভিনন্দিত করেন। সোনালি দিনের সঙ্গীতের সুর লহরীতে অভিভূত হতে হতে অবশেষে ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা। ' বেকারার কারকে হামে' দিয়ে সমাপ্তি টানা হয় মনোমুগ্ধকর এ স্বর্ণালি সন্ধ্যার।দর্শকেরা বাড়ি ফেরেন বাংলা সঙ্গীতের এক মধুর আবেশকে সঙ্গে করে। সঙ্গীতপ্রেমীদের বিপুল প্রশংসায় অভিনন্দিত হন নন্দিত সঙ্গীতশিল্পী সঞ্জয় দে ও তাঁর সহযোগী কলাকুশলীবৃন্দ।