img

শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধের কালো অধ্যায়

প্রকাশিত :  ১৪:২০, ০৭ অক্টোবর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১৭:০৩, ০৭ অক্টোবর ২০২৪

শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধের কালো অধ্যায়

ভূমিকা

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানে পলিয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদি শাসক শেখ হাসিনা গুম-খুনের রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা চালিয়েছিলেন। মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করতে ক্ষমতায় এসেই ভিন্নমতের রাজনীতিকদের গুম করা শুরু করেন। তাঁর নির্দেশেই মূলত রাষ্ট্রীয় বাহিনী গুলোর বিভিন্ন ইউনিট এই গুম করা শুরু করেছিল। কখনো র‌্যাব, কখনো ডিবি আবার কখনো পুলিশ মানুষকে ধরে নিয়ে গুম করেছে। গুম করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীও। সেনা গোয়েন্দা বাহিনী ডিজিএফআই’র বিরুদ্ধেও মানুষ গুম করার অভিযোগ রয়েছে। আয়নাঘর নামক গোপন কারাগার আবিস্কার হয়েছে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায়।

শুধু গুম করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধ। ক্রসফায়ারের নামে টার্গেট কিলিংও ছিল শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধের আরেকটি অধ্যায়। ভিন্নমতের মাঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মীদের ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করে লাশ বিভিন্ন জায়গায় ফেলে রাখা হত। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী এসব অপরাধের কালো অধ্যায় গুলো নিয়ে যুক্তরাজ্য থেকে আমার দেশ অনলাইনে ধারাবাহিক কেইস স্টাডি প্রকাশ করা হয়েছিল। সব গুলো ঘটনা আমাদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। সাধ্য অনুযায়ী আমরা চেষ্টা করেছি। অনেকে ভিকটিম পরিবার স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। আবার অনেক ঘটনা আমরা নিজেরা খুঁজে নিয়েছি। এখানে শেখ হাসিনার মানবতা বিরোধী অপরাধের খন্ডচিত্র মাত্র। এই খন্ডচিত্র থেকেই অনুমান করা যায় শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতি কতটা ভয়ঙ্কর ছিল। মানুষ কতটা নিপীড়ন সহ্য করেছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি শাসনের ১৬টি বছর।

আমরা মনে করি শেখ হাসিনার গুম-খুনের প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার। প্রতিটি ঘটনায় ভিকটিম পরিবার গুলো বিচার পাওয়ার দাবী রাখে। সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকার শেখ হাসিনার গুম-খুনের রাজনীতির শিকার ভিকটি পরিবার গুলোর জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবেন এটাই সময়ের দাবী।

ফ্যাসিবাদের প্রথম গুমের শিকার চৌধুরী আলম

চৌধুরী আলম। ঢাকার অন্যতম প্রভাবশালী বিএনপি নেতা। তিনি ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের একাধিকবার নির্বাচিত কমিশনার। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ এলাকায় তিনি ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী। বিএনপি’র সভা-সমাবেশে লোক জড়ো করতে পারতেন মুহূর্তেই। যে কারণে দলেও কদর ছিল তার। 

শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার দেশ বছর হয়েছে তখন। গুমের রাজনীতি শুরু করা হয় চৌধুরী আলমকে দিয়ে। ২৪শে জুন, ২০১০। হঠাৎই খবার আসে চৌধুরী আলম আটক হয়েওেছ। ইন্দিরা রোড থেকে তাকে আটক করেছে ডিবি।পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান ডিবি কার্যালয়ে। কিন্তু স্বীকার করেনি ডিবি। পরিবার এখান থেকে সেখানে দৌড়ঝাপ করেন। কখনো ডিবি, কখনো র‌্যাব অফিসে। পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়েও যোগাযোগ করেন তারা। পরিবার আজও খুঁজে পায়নি চৌধুরী আলমকে। 

চৌধুরী আলমের বড় ছেলে আবু সায়ীদ চৌধুরী হিমু গণমাধ্যমের কাছে ঘটনার বিবরণে যা বলেছিলেন তা নিম্নরূপ-

সেদিন রাত ৮টার পর আবু সায়ীদ চৌধুরী হিমুর মোবাইলে একটি ফোন আসে। ফোনটি করেন তাদের পারিবারিক গাড়িচালক জসীম। কাঁচুমাচু গলায় জিজ্ঞেস করেন, স্যারের (চৌধুরী আলম) খবর জানেন। হিমু পাল্টা প্রশ্ন করেন, না, কি হয়েছে? জবাবে চালক বলেন, স্যারকে মনে হয় ডিবি অ্যারেস্ট করেছে। গাড়িচালককে ফের প্রশ্ন করেন হিমু- তোমাকে কে বলেছে? গাড়িচালক উত্তর দেন, স্যার যে গাড়িতে ছিলেন ওই গাড়ির চালক অসীম জানিয়েছে। টিভিতে নাকি খবরটি দেখাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে হিমু টিভি অন করেন। দেখেন- প্রতিটি টিভির স্ক্রলে প্রচার হচ্ছে- ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে কমিশনার চৌধুরী আলম ডিবি’র হাতে আটক। সঙ্গে সঙ্গে দুই নিকট আত্মীয় নিয়ে দ্রুত যান মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে। তখন ডিবি কার্যালয় থেকে জানানো হয়, চৌধুরী আলমকে ডিবি’র কোনো টিম আটক কিংবা গ্রেপ্তার করেনি। অন্য কোথাও খোঁজ নেন। সেখান থেকে দ্রুত ছুটে যান তেজগাঁও থানায়। তৎকালীন ওসি তাদের জানান, ‘চৌধুরী আলম গ্রেপ্তার হয়েছেন- এটা নতুন কোনো কাহিনী নয়। আপনারা টিভির হেডলাইন দেখছেন না’। তখন ওই ওসি তাদের পরামর্শ দেন- যেহেতু তাকে ইন্দিরা রোড থেকে আটক করা হয়েছে ওই এলাকাটি শেরেবাংলানগর থানার অধীনে, আপনারা সেখানে যোগাযোগ করেন। ফের তারা ছুটে যান শেরেবাংলানগরে। সেখান থেকেও জানানো হয়, চৌধুরী আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আবার ছুটেন শেরেবাংলানগরস্থ র‌্যাব-২ এর কার্যালয়ে। সেখান থেকেও পান হতাশার খবর। পিতার খোঁজে এভাবেই সারারাত হন্যে হয়ে ছোটাছুটি করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরে। আটকের বিষয়টি স্বীকার করেনি কেউই। তখনো তারা আঁচ করতে পারেননি কী ঘটতে চলেছে। পরদিন প্রায় সবক’টি জাতীয় দৈনিকে ‘চৌধুরী আলম ডিবির হাতে গ্রেপ্তার’ শিরোনামে খবর ছাপা হয়। সংবাদপত্রের খবর দেখে তারা কিছুটা ভরসা পান।

এদিকে ঘটনার পরদিন সকালে তিনি খবর পান, কাওরান বাজারের ওয়াসা ভবনের উল্টোদিকে রাস্তার পশ্চিম পাশে যে গাড়ি থেকে চৌধুরী আলমকে  নামিয়ে নেওয়া হয়েছিলেন সেই প্রাইভেট কারটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পরে গাড়িটি শেরেবাংলানগর থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।

পিতার নিখোঁজের দিনের ঘটনার চিত্র তুলে ধরে হিমু বলেন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালে প্রথম হরতাল ডাকে বিএনপি। ২৫শে জুন ডাকা হরতালকে ঘিরে রাজধানীর শাহবাগ থানায় আগের দিনই বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। ওইদিন সকাল থেকেই রাজধানীতে শুরু হয় ধরপাকড়। দুপুরের দিকে শাহবাগ থানার এক এসআই আমাদের মালিবাগের চৌধুরীপাড়ার বাসায় আসেন। সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, স্যারকে বলবেন যেন সাবধানে থাকেন। পুলিশ কর্মকর্তার ওই মেসেজ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পিতাকে ফোন করেন হিমু। পিতাকে জানান পুলিশ কর্মকর্তার ওই সতর্কবার্তা। একইসঙ্গে বাসায় আসতে বারণ করেন, নিরাপদে থাকার পরামর্শ দেন। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে চৌধুরীপাড়ার বাসায় যান চৌধুরী আলম। নিজের গায়ের পোশাক পরিবর্তন করে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যান তিনি। ওই দিন চৌধুরী আলম ব্যবহার করেন ইন্দিরা রোডের ওই আত্মীয়ের গাড়ি। কাকতালীয়ভাবে ওইদিনই প্রথম তার আত্মীয়ের গাড়ির চালক নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু রাত ৮টার কিছু সময় পরই দুঃসংবাদটি পান হিমু। 

পরদিন তিনি ইন্দিরা রোডের কালিন্দি অ্যাপার্টমেন্টের গলির দুর্ঘটনাস্থলে যান। কথা বলেন প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে। ঘটনাস্থলের পাশের ভবনে দায়িত্বরত এক নিরাপত্তারক্ষী তাকে জানান, ঘটনার সময় তিনি গেটেই দায়িত্ব পালন করছিলেন। রাত ৮টার দিকে একটি হলুদ রঙের ট্যাক্সিক্যাব প্রথমে চৌধুরী আলমকে বহনকারী প্রাইভেট কারটিকে পেছন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দেয়। তখন চালক গাড়ি থেকে নেমে ক্যাবচালকের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ান। গাড়িতে বসেই বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেন চৌধুরী আলম। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে নেমে আসেন তিনি। ঘটনার মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেন। তখন তাদের গাড়ির ঠিক সামনেই ছিল কালো গ্লাসের সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস। গাড়িটির দুইপাশ থেকেই দরজা খোলা। মাইক্রোবাস থেকে চার-পাঁচজন সাদা পোশাকের লোক নেমে আসেন। তাদের একজন চৌধুরী আলমের গাড়িচালক অসীমকে চড়থাপ্পড় দিয়ে তাড়িয়ে দেন। বাকিরা চৌধুরী আলমকে টেনে-হেঁচড়ে কালো গ্লাসের মাইক্রোবাসে তোলার চেষ্টা করেন। এসময় মিনিটখানেক তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে চৌধুরী আলমকে জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলেন অপহরণকারীরা। দ্রুত গাড়িটি ঘটনাস্থল  ত্যাগ করে। পেছন পেছন অপহরণকারীদের একজন চৌধুরী আলমের গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যান।

এদিকে ঘটনার দুই-তিনদিন পর ডিবি অফিসের এক কর্মকর্তা হিমুকে জানান, উনি (চৌধুরী আলম) আছেন। আপনারা নিশ্চিন্ত থাকেন। আমরা নিরাপত্তার স্বার্থে বিষয়টি প্রকাশ করছি না। এরপর কেটে যায় আরও কয়েকদিন। ফের হিমু যোগাযোগ করেন ওই কর্মকর্তার সঙ্গে। হতাশাজনক খবর দেন তিনি। নিভে যায় আশার প্রদীপ। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাড়তে থাকে উৎকণ্ঠা। তাদের সান্ত্বনা দিতে চৌধুরীপাড়ার বাসায় যান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

ওদিকে কোথাও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য না পেয়ে বাধ্য হয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। চৌধুরী আলমের সন্ধান দাবিতে সরকারের কাছে আবেদন জানান সন্তানরা। তাতে পাননি আশানুরূপ কোনো ফল। চৌধুরী আলম নিখোঁজের ৬ দিন পর ৩০শে জুন শেরেবাংলানগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন হিমু। পরে সাধারণ ডায়েরিটি অপহরণ মামলা হয়। মামলার তদন্তভার দেয়া হয় ডিবিকে। তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিবি কর্মকর্তারা দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন চৌধুরী আলমের পরিবারের সদস্যদের। বছর দুয়েক পর মামলার তদন্তভার যায় সিআইডিতে। তারাও একইভাবে ইন্টারোগেশন করেন পরিবারের সদস্যদের। শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্তের দায় এড়ান তারা। উদ্ধারের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।

তদন্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে চৌধুরী আলম পুত্র বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের ভবনের সিসিটিভির ফুটেজ ছিল। এ ছাড়া চৌধুরী আলমের যে গাড়িটি উদ্ধার হয়েছে সেটির স্টিয়ারিংয়ে অপহরণকারীদের হাতের আঙুলের ছাপ ছিল। তদন্ত কর্মকর্তারা সেই আলামতের কোনো কিছুই কেন সংগ্রহ করেননি? এ ছাড়া যে ট্যাক্সিক্যাবটি ধাক্কা দিয়েছিল সেটির মালিক কে তা বের করার চেষ্টা করেননি। উল্টো দফায় দফায় পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করা হয়েছে। 

হিমু গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমার বাবা অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নং ওয়ার্ডে (বর্তমান ২০ নং ওয়ার্ড) একটানা ২৩ বছর কমিশনার ছিলেন। আন্দোলনের তীর্থভূমি গুলিস্তান, পল্টন, মুক্তাঙ্গন, প্রেস ক্লাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এলাকায় ছিল তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। দলীয় যেকোনো কর্মসূচিতে মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে তিনি ২০ হাজার মানুষের সমাগম করতে পারতেন। দলীয় সভা-সমাবেশ কিংবা যেকোনো আন্দোলন কর্মসূচি সফলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন তিনি। সে কারণেই হয়তো চৌধুরী আলমকে প্রথম টার্গেট করা হয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান তৈরির কারণে তাকে গুম করা হয়েছে।

পাকিস্তান আমলে পিতার চাকরির সুবাদে নোয়াখালীর কবিরহাট থেকে রাজধানীর মালিবাগের চৌধুরীপাড়ায় সরকারি কোয়ার্টারে বসবাস শুরু করেন চৌধুরী আলম। স্থানীয়দের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে এলাকার বিচার সালিশের মধ্যমণি হয়ে উঠেন তিনি। ১৯৮৫ সালে জড়ান বিএনপি’র রাজনীতিতে। নির্বাচিত হন ৫৬ নং ওয়ার্ডের কমিশনার। অনেক নরম মনের মানুষ ছিলেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেক ভালো ব্যবহার করতেন। কখনো কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেননি। নিখোঁজের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও চৌধুরী আলমের জন্য বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করেছেন। এমন একটি চরিত্রের মানুষ কখনো গুম কিংবা অপহরণের শিকার হবেন- সেটা পরিবারের কেউ এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না। এখনো তারা আশায় বুক বেঁধে আছেন- একদিন চৌধুরী আলম পরিবারের কাছে ফিরে আসবেন।

ওয়ান-ইলেভেনের জরুরী আইনের সরকারের সময় চৌধুরী আলমের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা দায়ের হয়। ওই সময় গ্রেপ্তার হয়ে টানা ২৭ মাস কারাভোগ করেন তিনি। কারাগার থেকে যখন বের হন তখন তার বয়স ছিল ৬৭। এরপর বেশিদিন পরিবারের সান্নিধ্যে কাটাতে পারেননি। শিকার হন গুমের। চৌধুরী আলম ছিলেন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা।  


মতামত এর আরও খবর

img

আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি: পাকিস্তানের অন্ধকার ভবিষ্যৎ

প্রকাশিত :  ১৮:৪১, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৯:১১, ১৫ নভেম্বর ২০২৫

সাইফুল খান 

জেনারেল আসিম মুনিরকে দেওয়া আজীবন লিগ্যাল ইমিউনিটি পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভূমিকম্পের মতো একটি ঘটনা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্রে সেনাবাহিনী আগেই ছিল সবল, কিন্তু এবার সামরিক ক্ষমতার ওপর যে “অভিশাপহীনতা” ও “বিচার-বহির্ভূত নিরাপত্তা” দেওয়া হলো। তা শুধু একটি দেশের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; বরং নতুন আঞ্চলিক জটিলতার প্রতিচ্ছবি।অনেক বিশ্লেষকের মতে, এই ইমিউনিটি শুধু অভ্যন্তরীণ শক্তি‑রাজনীতির ফল নয়; এটি সৌদি আরব‑মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র‑ট্রাম্প অক্ষের নতুন জিওস্ট্র্যাটেজিক সমীকরণের পুরস্কার। যার মূল লক্ষ্য আফগানিস্তান শাসনব্যবস্থাকে চাপের মুখে রাখা, তালেবানের বিপরীতে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন সামরিক খেলা শুরু করা।

১. সৌদি–ট্রাম্প অক্ষ: কেন আসিম মুনিরকে প্রয়োজন

সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কৌশল লক্ষ্য করলে দেখা যায়। তারা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন সামরিক পার্টনারশিপ গড়ে তুলছে। ইরানের প্রভাব মোকাবিলা, ইয়েমেনের সামরিক প্রতিরোধ এবং ভবিষ্যতের আঞ্চলিক ব্লক তৈরি সব মিলিয়ে সৌদি আরব পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাদের ‘এক্সটেনশন ফোর্স’ হিসেবে বিবেচনা করে আসছে বহুদিন। এখন সেটা নতুন স্ট্র্যাটেজিক চুক্তির কারনে আরো ঘনিষ্ট।

অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য‑কৌশল বরাবরই ছিল দুই স্তরে:

ক ইস্রায়েলের সুরক্ষা, 

খ.আফগানিস্তান‑পাকিস্তান বেল্টে ‘প্রক্সি’ শক্তি তৈরি।

এই দুই উদ্দেশ্যের মিলনস্থল হলো পাকিস্তান আর্মি।

আসিম মুনির সৌদির পছন্দের মানুষ হিসেবে পরিচিত; একই সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকে ওয়াশিংটনের কিছু নিরাপত্তা চক্র তাঁকে “বিশ্বস্ত সামরিক পার্টনার” হিসেবে দেখেছে বলে বহু বিশ্লেষকের ধারনা। তাই তাঁর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে এই অক্ষ লাভবান হবে।

২. কেন লিগ্যাল ইমিউনিটি এই অক্ষের জন্য সুবিধাজনক

লিগ্যাল ইমিউনিটির অর্থ হলো:

ভবিষ্যতে কোনো জবাবদিহিতা নেই।

সামরিক অভিযান বা গোয়েন্দা অপারেশন প্রশ্নহীনভাবে চালানো সম্ভব।বিদেশি শক্তির সাথে সামরিক সহযোগিতায় বাধা কম।দেশের রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে সামরিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ। এই অবস্থায় আসিম মুনির এমন একটি পূর্ণ ক্ষমতাধর সামরিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হবেন, যাঁর সাহায্যে:

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে নতুন স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করতে পারবে

তালেবান সরকারকে চাপে রাখতে পাকিস্তানের ভৌগোলিক সুবিধা ব্যবহারের জন্য এমন সামরিক নেতৃত্ব দরকার। যিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ঝামেলা ছাড়াই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

সৌদি আরব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা পার্টনার হিসেবে আরও দৃঢ়ভাবে ব্যবহার করতে পারবে। বিশেষত ইরানের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা সহযোগিতা ও কনফ্লিক্ট থিয়েটার ব্যবস্থাপনায়।

৩. পাকিস্তানের গণতন্ত্রে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব

জেনারেল আসিম মুনিরের আজীবন লিগ্যাল ইমিউনিটি শুধু একজন সেনাপ্রধানকে আইনি সুরক্ষা দিচ্ছে না; এটি পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে তিন স্তরে মারাত্মক আঘাত করছে।

ক. বিচার বিভাগের নির্জীবতা

একজন সেনাবাহিনী প্রধানকে আজীবন মামলাহীন করা মানে:

১. সুপ্রীম কোর্টের ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ হওয়া

সুপ্রিম কোর্ট বা নিম্ন আদালত এখন সেনাবাহিনী প্রধানকে তদন্ত বা অভিযুক্ত করতে পারবে না।

দীর্ঘমেয়াদে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নষ্ট হবে এবং বিচারালয় শুধুই প্রশাসনিক কার্য সম্পাদন করবে, ন্যায়বিচারের রক্ষক হিসেবে নয়।

২. আইনের সমতা ধ্বংস

সাধারণ নাগরিক, সাংবাদিক বা রাজনৈতিক নেতা যে আইন অনুসারে দায়ী, সেই সমতার ধারণা সেনাপ্রধানের ক্ষেত্রে আর থাকবে না।

এটি জনগণের মধ্যে আইনের প্রতি আস্থা হ্রাস করবে।

৩. সেনাবাহিনী-আদালত সম্পর্কের আধিপত্য

বিচার বিভাগ এখন সেনাবাহিনীকে সমর্থন বা অনুমোদনের জন্য কাজ করবে।

সেনাবাহিনীকে এক ধরনের “অ্যাডজান্ট বিভাগ” হিসেবে দেখা হবে। যেখানে আদালত সিদ্ধান্তে স্বাধীন নয়, বরং সামরিক প্রভাবের অধীন থাকবে।

খ. সংসদ এবং নির্বাচনী রাজনীতি অচল

লিগ্যাল ইমিউনিটি স্পষ্টভাবে একটি বার্তা দেয়:

 “রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা জনগণের ভোটে নয়, বুটের আওয়াজে।”

১. নির্বাচিত সরকার এবং সংসদের কার্যক্ষমতা সীমিত। রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে সেনাবাহিনীর অনুমোদন নিতে হবে।

সেনা-নেতৃত্বের অগ্রাধিকার সংবিধানগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সংসদকে কার্যত ফর্মালিটি হিসেবে দেখা হবে।

২. রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রতিকূল পরিবেশ:

বিরোধী দলগুলো সেনাবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা নীতিগত চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। ভোট ও জনমতের প্রভাব কমে যাবে, কারণ সামরিক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপরে দখল করবে।

৩. রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধ্বংস:

দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে আত্মসংশয় তৈরি হবে। সরকার শুধু “সামরিক স্বার্থ রক্ষা করে টিকে থাকা”র ওপর নির্ভরশীল হবে।

গ. বেসামরিক প্রশাসনের ‘সিস্টেমিক দাসত্ব’

লিগ্যাল ইমিউনিটি বেসামরিক প্রশাসনকে বাধ্য করে সামরিক স্বার্থ রক্ষা করতে। এর ফলে:

১. স্বাধীন নীতিনির্ধারণের সীমাবদ্ধতা

অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কূটনীতি প্রতিটি ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসন সেনাবাহিনীর দিকনির্দেশনা মেনে চলবে। সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা নেই, সবকিছু সামরিক স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে।

২. গণতান্ত্রিক কাঠামোর ফরমালিটি

সরকার এবং সংসদ এখন কেবল প্রশাসনিক ফর্মালিটি। আসলে দেশের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত, সেনাবাহিনী ও তার নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করে।

৩. দীর্ঘমেয়াদী সংস্কৃতিগত প্রভাব

সাধারণ নাগরিক ও সরকারি কর্মকর্তা অনুপ্রেরণা হারাবে। সামাজিক ও প্রশাসনিক মানসিকতা হবে “সেনার নির্দেশ পালনের ওপর নির্ভরশীল”।

৪. পাকিস্তানে সামরিকতন্ত্রের নতুন অধ্যায়

লিগ্যাল ইমিউনিটি দিয়ে এমন একজন সামরিক প্রধানকে “অতিমানবিক আইনি ক্ষমতা” প্রদান করা হলো, যার প্রভাব সরাসরি তিন ভাবে দেখা যাবে:

১. সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক সর্বশক্তি

এখন আর তারা পর্দার আড়ালে নয় সংবিধানে, আইনে, বাস্তবে সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করবে।

২. ভবিষ্যতের সামরিক শাসকদের প্রণোদনা

আজ আসিম মুনির; কাল অন্য কেউ।

এই নজির ভবিষ্যতের যে কোনো সামরিক প্রধানকে “অভিযুক্তহীন রাজা” বানিয়ে দিতে পারে।

৩. রাষ্ট্রের ভেতরে দ্বিতীয় রাষ্ট্র

সামরিক গোয়েন্দা, সাইবার, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, কূটনীতি সবকিছুতেই সেনাবাহিনীর আলাদা সিস্টেম তৈরি হবে।

৪. ভারতের জন্য কেন উদ্বেগজনক

ভারতের জন্য এটি তিন কারণে দুশ্চিন্তার বিষয়:

ক. পাকিস্তানে ক্ষমতা সম্পূর্ণ সামরিক হাতে গেলে সীমান্ত পরিস্থিতি অনিশ্চিত হবে।সেনাবাহিনী রাজনৈতিক হিসাব কম করে মাঠের সিদ্ধান্ত বেশি নেবে।

খ.আফগানিস্তানে মার্কিন‑পাকিস্তানি অপারেশন হলে আঞ্চলিক ব্যালান্স বদলে যাবে। এর প্রভাব ভারতের উত্তর সীমান্তেও পড়বে।

গ.চীন–পাকিস্তান–সৌদি–আমেরিকা চতুর্মুখী জটিলতা নতুন আঞ্চলিক জোট তৈরি করবে। যা ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে চাপে ফেলতে পারে।

উপসংহার:  আসিম মুনিরের লিগ্যাল ইমিউনিটি শুধু পাকিস্তানের আইনগত সিদ্ধান্ত নয়।এটি একটি নতুন আঞ্চলিক শক্তি বিন্যাসের সিগন্যাল।সৌদি আরব একটি নিরাপত্তা‑অক্ষ তৈরি করছে। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান নীতিতে পুনরায় প্রবেশের চেষ্টা করছে।ট্রাম্প–ইস্রায়েল–গালফ অক্ষ আবার সক্রিয় হচ্ছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই অক্ষের “নতুন গিয়ার” হিসেবে প্রস্তুত হচ্ছে। এর মাশুল দেবে পাকিস্তানের জনগণ। গণতন্ত্র, রাজনীতি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা সবকিছু আরো দুর্বল হবে। আর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি প্রবেশ করবে এক অনিশ্চিত, অস্থিতিশীল, সামরিকতান্ত্রিক ভবিষ্যতে।


লেখক- ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

মতামত এর আরও খবর