img

ডক্টর ইউনুস ও শেখ হাসিনা: আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতার পর্যালোচনা

প্রকাশিত :  ০৭:২২, ১১ অক্টোবর ২০২৪

ডক্টর ইউনুস ও শেখ হাসিনা: আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতার পর্যালোচনা

রেজুয়ান আহম্মেদ


বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের নাম উঠে আসে—ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস এবং শেখ হাসিনা। এদের দুজনের প্রভাব ও আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রূপে। একদিকে ডক্টর ইউনুসের মাইক্রোক্রেডিট উদ্যোগ দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, অন্যদিকে শেখ হাসিনা একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তবে জনমতের একাংশের ধারণা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ডক্টর ইউনুসের গ্রহণযোগ্যতা শেখ হাসিনার তুলনায় অনেক বেশি, যার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন কারণ। এ লেখায় এই দুই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের গ্রহণযোগ্যতা এবং তাদের প্রভাব বিশ্লেষণ করা হবে।

ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস: একটি বিশ্বজনীন ব্যক্তিত্ব

ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস, যিনি দারিদ্র্য দূরীকরণের এক উদ্ভাবনী পথিকৃৎ, কেবল বাংলাদেশের নয়, পুরো বিশ্বের কাছেই একজন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক এবং মাইক্রোক্রেডিট সিস্টেম সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ২০০৬ সালে, মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্বে প্রথমবারের মতো একটি কার্যকর সামাজিক ব্যবসায়িক মডেল প্রবর্তনের জন্য ডক্টর ইউনুসকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এর ফলে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে আরও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

ডক্টর ইউনুসের চিন্তা এবং দর্শন শুধুমাত্র আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তিনি একটি বৃহত্তর মানবিক এবং সামাজিক কাঠামোকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, এবং সামাজিক ব্যবসায়ের ওপর ভিত্তি করে গঠিত তাঁর কার্যক্রম বহু দেশে অনুপ্রেরণা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বিশেষত তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাইক্রোফাইন্যান্স সিস্টেম বিশ্বব্যাপী একটি নতুন অর্থনৈতিক চেতনা জন্ম দিয়েছে, যা আজ বহু দেশেই অনুসৃত হচ্ছে।

যেখানে বিশ্বব্যাপী বহু রাজনীতিবিদ এবং সামাজিক সংগঠক তাদের কাজের জন্য প্রশংসা পেয়েছেন, সেখানে ডক্টর ইউনুস এক আলাদা উচ্চতায় পৌঁছেছেন। তাঁর কাজের নৈতিকতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে শ্রদ্ধা পেয়েছেন। ইউনুস কেবল অর্থনৈতিকভাবে নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন এবং তাঁদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করেছেন।

বিশ্বের বহু উন্নত দেশও তার মডেল গ্রহণ করেছে এবং তাঁকে একজন সফল সমাজকর্মী হিসেবে বিবেচনা করেছে। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ নারী আর্থিক স্বনির্ভরতা অর্জন করেছেন, যা নারীর ক্ষমতায়নের এক সফল উদাহরণ।

শেখ হাসিনা: রাজনৈতিক শক্তি ও নেতৃত্ব

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের রাজনীতিতে এক অন্যতম শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত আছেন। তিনি শুধু একজন নেতা নন, বরং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রয়োজক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হওয়ার কারণে তাঁকে সবসময়ই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তবে তাঁর নেতৃত্বের দক্ষতা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে স্থায়িত্ব তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলেও পরিচিত করে তুলেছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নয়নের পথে এগিয়েছে। বিশেষত, তাঁর সরকারের সময়ে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন ঘটেছে। তাঁর শাসনামলে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

এছাড়াও, শেখ হাসিনা জাতিসংঘ, ওআইসি, সার্কসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি তুলে ধরেছেন। রোহিঙ্গা সংকটের সময় তাঁর নেতৃত্ব বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে প্রশংসা পেয়েছেন।

তবে তাঁর সরকারের সময়ে কিছু বিতর্কও সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে রাজনীতিতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে নেওয়া বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে অনেক সময় বিতর্ক দেখা গেছে। এই বিতর্কগুলো আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচিত হয়েছে, যা অনেক সময়ে তাঁর আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতায় প্রভাব ফেলেছে।

জনমতের প্রতিফলন

বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে ডক্টর ইউনুস এবং শেখ হাসিনা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ডক্টর ইউনুসের সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে। তাঁর মাইক্রোফাইন্যান্স মডেল এবং সামাজিক ব্যবসার ধারণা শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়, বরং একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। তাঁর উদ্যোগ সমাজের সব স্তরের মানুষের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে এবং তিনি এভাবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক স্তরে গৌরবান্বিত করেছেন।

অন্যদিকে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তবে, রাজনীতিতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং বিরোধীদের দমন নিয়ে তাঁর সরকারের বিতর্কিত কিছু পদক্ষেপ জনগণের মাঝে প্রশ্ন তুলেছে। এর ফলে অনেকেই মনে করেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ডক্টর ইউনুসের তুলনায় কিছুটা কম।

ডক্টর ইউনুসের প্রতিষ্ঠিত মাইক্রোফাইন্যান্স মডেল এবং সামাজিক উদ্যোগগুলি মানুষকে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করেছে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। তাঁর কাজ কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং সামাজিক প্রভাবও ফেলেছে। তাঁর চিন্তা, কাজের নৈতিকতা, এবং সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টায় জনগণ তাঁকে উচ্চ সম্মানে বিবেচনা করে।

অন্যদিকে, শেখ হাসিনার সরকারের নীতিগুলো, যদিও কিছু ক্ষেত্রে সফল, রাজনৈতিক বিতর্কের কারণে জনগণের মধ্যে তাঁর প্রতি কিছুটা নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও দলীয় আধিপত্যের কারণে অনেকেই তাঁর নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিফলন

আন্তর্জাতিক স্তরে ডক্টর ইউনুস একজন মানবতাবাদী এবং সমাজকর্মী হিসেবে পরিচিত, যিনি নিজের উদ্যোগ দিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন নেতা, সংগঠন, এবং মানবাধিকার কর্মী।

অন্যদিকে, শেখ হাসিনা একজন দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তিনি দেশকে অনেক ক্ষেত্রে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তবে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি জনগণের মতামত ভিন্ন হতে পারে, এবং তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলী, সাফল্য, এবং আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে।

শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যা দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর—এ ধরনের প্রকল্পগুলো দেশের যোগাযোগ এবং পরিবহন ব্যবস্থাকে আধুনিক করে তুলেছে। তাঁর সরকারের অধীনে বিদ্যুৎ উৎপাদনও অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের শিল্প ও কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। তিনি নিজে এসব সাফল্যকে বাংলাদেশের উন্নয়নের মডেল হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরেছেন।

শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ব্যাপক অবদান রেখেছেন। তাঁর শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থেকেছে, যা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামগুলোতে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশকে একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁর সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো, বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি, শিল্প খাতের উন্নয়ন এবং রপ্তানি বাজারে প্রবৃদ্ধি অর্জন, দেশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে।

তবে, শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে কিছু বিতর্কও তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে। বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বের কৌশল নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। সরকারের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিযোগে কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রতি সরকারের কঠোর আচরণ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কিছু প্রশ্ন উঠেছে।

এছাড়া, শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব দেখিয়েছেন, যা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়, এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার এই মানবিক সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর এই উদ্যোগে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং দেশসমূহ বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। এটি শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে এবং তাঁকে একজন মানবতাবাদী নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

তবে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সাফল্য এবং সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর ভূমিকা ও প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর সরকারকে একটি উন্নয়নমুখী ও সুশাসন নিশ্চিতকারী সরকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর অবদান স্বীকৃতি পেয়েছে, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য ও শক্তিশালী একটি ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরেছে।

শেখ হাসিনা এবং ডক্টর মুহাম্মদ ইউনুস, উভয়েই বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মুখ। তবে, তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা এবং নেতৃত্বের ধরণ আলাদা। ডক্টর ইউনুস একজন সমাজকর্মী ও অর্থনৈতিক চিন্তাবিদ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে প্রশংসিত হয়েছেন, অন্যদিকে শেখ হাসিনা একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে তাঁর ভূমিকা রেখেছেন।


রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম
img

ভারত-শ্রীলঙ্কা স্থলসংযোগ: স্বপ্ন না বাস্তবতা?

প্রকাশিত :  ০৬:৫৪, ২২ এপ্রিল ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৭:০৮, ২২ এপ্রিল ২০২৫

ভারতের পরিবেশ বিষয়ক থিংক ট্যাংঙ্ক Urbanacres অবলম্বনে

সাইফুল খান

দুই দশকের পুরনো এক স্বপ্ন আবারও উঠে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক আলোচনায়। ভারত চায়, পক প্রণালী পেরিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে একটি সড়ক ও রেলপথ নির্মাণ করতে। একটি স্থায়ী স্থলসেতু, যা দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। তবে শ্রীলঙ্কা যেন এবার একটু ভিন্ন পথে হাঁটছে। স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা দিয়েই তারা মূল্যায়ন করছে প্রস্তাবটি।

কলম্বোর সিদ্ধান্ত-নির্মাতারা এখন অনেক বেশি সতর্ক। সরকারের অবকাঠামো ও পরিবহন পরিকল্পনা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা খোলাখুলিভাবে জানিয়েছেন, “এই মুহূর্তে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়।” শুধু কারিগরি দিক নয়, তারা তুলেছেন প্রকল্পটির পরিবেশগত ক্ষতি, আর্থিক ভারসাম্য এবং ভূ-রাজনৈতিক জটিলতার প্রশ্ন।

বিশেষ করে গালফ অব মান্নার বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ও রাম সেতু এলাকা নিয়ে শ্রীলঙ্কার উদ্বেগ স্পষ্ট। ঐ অঞ্চলের প্রবাল প্রাচীর, মাছের প্রজননক্ষেত্র ও পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল এই সেতুর কারণে বিপন্ন হতে পারে। আঞ্চলিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার যাত্রায় এটি হবে এক বড় ধরনের ধাক্কা এবং এ নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে প্রবল জনমতেও রূপ নিতে পারে।

আরেকটি বড় প্রশ্ন উঠেছে অর্থনীতি নিয়ে। এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সরাসরি বলেছেন, “দেশ এখনো অর্থনৈতিক সংকট থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়নি। এই মুহূর্তে বড় পরিসরের বিদেশনির্ভর প্রকল্প গ্রহণ মানে ভবিষ্যতের ঝুঁকি বয়ে আনা।”

অন্যদিকে, নয়াদিল্লির স্বপ্ন কিন্তু আঞ্চলিক সংযোগের এক বড় ক্যানভাসে আঁকা। BIMSTEC-এর আওতায় ভারত এমন একটি যোগাযোগব্যবস্থা চায়, যা সড়ক ও রেলপথ দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে যুক্ত করবে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। এতে নাকি বাণিজ্য, পর্যটন ও কার্বনমুক্ত পরিবহন নতুন গতি পাবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় সমুদ্রের উপর দিয়ে কংক্রিট আর স্টিলের সেতু তৈরি করে পরিবেশবান্ধব লক্ষ্য কীভাবে অর্জিত হবে?

ইতিহাস বলছে, এটাই প্রথম নয়। ২০০০-এর দশকে একবার এমন প্রস্তাব উঠে এসেছিল। তখনও রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবে তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০২৩ সালে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপ্রধান নয়াদিল্লি সফরে গেলে যৌথ বিবৃতিতে সংযোগ সহযোগিতার কথা উঠেছিল, কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি হয়নি।

তবে এবার প্রেক্ষাপট আরও জটিল। ভারত মহাসাগরে চীনের প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। বন্দর নির্মাণ, নৌ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ আর কৌশলগত অবস্থান নিয়ে চীন এখন এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। শ্রীলঙ্কা তাদের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ধরে রাখতে চায়। ফলে, ভারতের সঙ্গে স্থলসংযোগ মানে শুধু প্রযুক্তিগত নয়, রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ও।

তবে এই স্থগিত সিদ্ধান্তকে ‘প্রত্যাখ্যান’ হিসেবে দেখা ভুল হবে। বরং শ্রীলঙ্কার এই অবস্থান একটি পরিণত কূটনৈতিক অবস্থান।যেখানে স্বল্পমেয়াদী সুবিধার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতও বুঝে গেছে, শুধু সেতু নয়, প্রয়োজন ‘আস্থা’র সেতু। তাই তারা এখন বিকল্প পথ খুঁজছে।যেমন- নতুন ফেরি সার্ভিস, সবুজ নৌ পরিবহন করিডোর বা পরিবেশবান্ধব বিমান চলাচল।

অবশেষে একটাই কথা বলা যায়।সংযোগ মানেই কংক্রিট আর স্টিলের সেতু নয়। সংযোগ মানে প্রেক্ষাপট, পরিকল্পনা ও পারস্পরিক সম্মান। আর এখন, ভারত-শ্রীলঙ্কার মধ্যে সেই ‘ভবিষ্যতের সেতু’ গড়ার অপেক্ষা রয়ে গেল।যেদিন পরিবেশ, অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতি একসাথে সবুজ সংকেত দেবে।

সর্বোপরি শ্রীলঙ্কা ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছে। যা ভারতের কৌশলগত রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।


সাইফুল খান: ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।