img

বিয়ে নয়, ক্যারিয়ার: জীবনের মূল্যের সন্ধানে!

প্রকাশিত :  ১৮:৩০, ১১ অক্টোবর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ২০:০৯, ১১ অক্টোবর ২০২৪

বিয়ে নয়, ক্যারিয়ার: জীবনের মূল্যের সন্ধানে!

রেজুয়ান আহম্মেদ

জীবনে প্রতিটি মানুষের জন্য বিভিন্ন মূল্যবোধ থাকে। কিছু মানুষের কাছে বিয়ে হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আবার কিছু মানুষ ক্যারিয়ারকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করে। আমার কাছে, বিয়ে যে একান্তই মৌলিক হতে পারে, তাতে কোন সন্দেহ নেই; কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ক্যারিয়ারই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে যখন জীবনযাত্রা অভাবগ্রস্ত অবস্থায় গড়িয়ে যায়, তখনই ভালোবাসা ও সম্পর্কের স্থায়িত্ব অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

প্রথমত, বিয়ে একটি সামাজিক চুক্তি, যা কেবল দুইজনের মধ্যে নয় বরং দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিয়ের মাধ্যমে সমাজের প্রত্যাশা এবং পরস্পরের প্রতি দায়িত্বের বোঝাপড়া তৈরি হয়। কিন্তু যখনই জীবনের চাকা ঘোরে, তখন দেখা যায় যে প্রেম ও ভালোবাসা যখন অপ্রতুলতা বা সংকটের মুখোমুখি হয়, তখন সেগুলো কতটা দুর্বল হয়ে পড়ে। বাস্তবতা হলো, জীবনের প্রত্যাশার সাথে প্রেমের সম্পর্কের মধ্যে একটি দৃঢ় সম্পর্ক থাকা জরুরি। জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য অর্থ ও ক্যারিয়ারের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন ব্যক্তির ক্যারিয়ার যখন সঠিক পথে এগিয়ে যায়, তখন সে তার পরিবার এবং প্রিয়জনদের জন্য একটি স্থিতিশীল ভিত্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

দ্বিতীয়ত, ক্যারিয়ার একজন মানুষের স্বপ্ন, আশা এবং আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। এটি কেবল আর্থিক সাফল্য নয়, বরং আত্মবিশ্বাস, স্বকীয়তা এবং সামাজিক স্বীকৃতিরও সূচক। একজন ব্যক্তি যখন তার ক্যারিয়ার তৈরি করতে সক্ষম হয়, তখন সে একটি ভালো জীবনযাত্রা উপভোগ করে এবং পরিবারের প্রতি একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি তার পারস্পরিক সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্বও বাড়িয়ে দেয়। সে একদিকে যেমন নিজের ভালোবাসাকে সময় দিতে পারে, অন্যদিকে সঙ্গীর স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করতে পারে।

অন্যদিকে, অভাবগ্রস্ত অবস্থায় ভালোবাসা স্থায়িত্ব পায় না। প্রেমের ভাষা অর্থের অভাবে নিস্তেজ হয়ে যায়। অর্থনৈতিক চাপের ফলে সম্পর্কের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়। যখন কোন সম্পর্কের ভিত্তি কেবল প্রেমের ওপর থাকে, তখন দেখা যায়, অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সেই প্রেমের সূর্যকে মেঘাচ্ছন্ন করে ফেলে। ভালোবাসার সম্পর্কের মজবুত ভিত্তি গড়তে হলে, দুই পক্ষের ক্যারিয়ারের অগ্রগতি অপরিহার্য।

তৃতীয়ত, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিভিন্ন প্রত্যাশা কাজ করে। বিবাহিত জীবনের প্রতি সমাজের প্রত্যাশা এমন যে, কিছু মানুষ বুঝতে পারে না যে ভালোবাসা ও ক্যারিয়ার সমান গুরুত্বপূর্ণ। অকাল বিবাহ কিংবা সম্পর্কের তাড়াহুড়ো সমাজে স্টেরিওটাইপ তৈরি করে। এটি একদিকে পরিবার ও সমাজের মধ্যে অশান্তি তৈরি করে, অন্যদিকে ব্যক্তির ক্যারিয়ারকে বাধাগ্রস্ত করে।

বিশ্বজুড়ে, এমন অনেক সফল ব্যক্তি রয়েছেন যারা নিজের ক্যারিয়ারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং পরবর্তীতে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। ক্যারিয়ার নির্মাণের প্রক্রিয়ায় তাদের জন্য কিছু ক্ষেত্রে বিয়ের কোনো আবশ্যকতা ছিল না। তারা নিজেদের স্বপ্নের পেছনে ছুটে গেছেন, যার ফলে তাদের জীবন আরো অর্থবহ হয়ে উঠেছে। যেমন, অনেক নারীর ক্যারিয়ার এবং স্বনির্ভরতা তাদেরকে বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় অধিক আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তারা নিজেদের শর্তে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।

সুতরাং, আমার কাছে বিয়ের গুরুত্ব আছে, কিন্তু তা আমার ক্যারিয়ারের তুলনায় দ্বিতীয় স্তরের। জীবনের জন্য যে মূল্যের সন্ধান, তা হল একটি সফল ক্যারিয়ার। ক্যারিয়ার ছাড়া শুধু ভালোবাসা থাকার অর্থ হলো জীবনযাত্রা প্রতিষ্ঠিত করতে না পারা।

অতএব, আমাদের উচিত আমাদের জীবনের পথনির্দেশনার ক্ষেত্রে বিয়েকে নয়, বরং ক্যারিয়ারকে প্রথম পদের দিকে স্থান দেওয়া। একজন সফল ক্যারিয়ার তৈরি করতে সময় এবং শ্রম দেওয়া দরকার, যা আমাদের জীবনযাত্রাকে উন্নত করতে সাহায্য করবে।

ভালোবাসার সঙ্গে জীবনের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে, একজন সফল ক্যারিয়ারই প্রধান চাবিকাঠি। তাই, আমাদের উচিত জীবনযাত্রাকে উন্নত করতে ক্যারিয়ার গড়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া এবং অভাবগ্রস্ত অবস্থায় স্থায়ী সম্পর্ক গড়ার পরিবর্তে, নিজেদের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া।

এটাই আসলে জীবনের সঠিক মূল্যবোধ, যেখানে ক্যারিয়ারই প্রথম। ক্যারিয়ার আমাদের জন্য কেবল একাডেমিক সাফল্য নয়, বরং আমাদের স্বপ্ন, আশা, এবং জীবনের উদ্দেশ্যও প্রকাশ করে। এটি আমাদের কাছে একটি পরিচিতি, যা আমাদের আত্মমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান তৈরি করে। সুতরাং, আমাদের উচিত ক্যারিয়ারকে অগ্রাধিকার দেওয়া, কারণ এটি জীবনের মূল্যের সন্ধানে আমাদের সাহায্য করে।

রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম

img

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কাছে করিম চাচার খোলা চিঠি

প্রকাশিত :  ১৫:৫৭, ১৫ মার্চ ২০২৫

বিষয়: বেঁচে থাকার আকুতি—আমাদের দুঃখ দেখুন, আমাদের কষ্ট শুনুন!

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা স্যার,  

আমার নাম করিম মিয়া। বয়স ষাট পেরিয়েছে। গাজীপুরের এক বস্তির কুঁড়েঘরে বাস করি। জীবনের চল্লিশ বছর কাটিয়েছি গার্মেন্টসের যন্ত্রপাতির সাথে সংগ্রাম করে। দুই সন্তানকে মানুষ করেছি এই শ্রমের অর্থে। কিন্তু আজ? আজ আমি নিঃস্ব, কাজহারা এক বৃদ্ধ। শুধু আমি নই, পাশের ঘরের লতিফ, সামনের বস্তির জাহানারা—সবাই আজ অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে। আমাদের চুলোয় আগুন জ্বলে না, বাচ্চারা ক্ষুধায় কাঁদে, মায়েরা কষ্টে চোখের জল চেপে রাখে, আর পুরুষরা দিনরাত ঘুরে বেড়ায় এক মুঠো ভাতের আশায়।  

মাননীয় মহোদয়, এই গাজীপুর শহর একদিন কত প্রাণবন্ত ছিল! টঙ্গী, কালিয়াকৈর, নারায়ণগঞ্জ—সারাদিন মেশিনের আওয়াজে মুখরিত থাকত। আমরা কাজ করতাম, মজুরি পেতাম, সংসার চালাতাম। এখন? এখন সেই কারখানাগুলো শুধু মাকড়সার জালে আবৃত। মালিকেরা দেশ ছাড়ছেন, বিনিয়োগকারীরা দূরে সরে যাচ্ছেন। গত বছরেই গাজীপুরে ৩০০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে। পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক রাস্তায়—এটা কি মানুষের বাঁচার উপায়?  

আমার মেয়ে রেশমা এইচএসসি পাস করে ঘরে বসে আছে। ওর স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। এখন তো দুই বেলা ভাত জোটানোই দায়। ছেলে শফিকের চাকরির খোঁজে পাগলের মতো ঘুরি। কারখানার গেটে দাঁড়ালে শুধু বলে, \"দেশের অবস্থা খারাপ, পরে আসুন।\" মহোদয়, \"পরে\" বলতে কী বোঝায়? আমাদের তো আজই ভাত চাই!  

আমার পাশের বস্তির অমিতের কথা শুনেছেন? সেও গার্মেন্টসে কাজ করত। কারখানা বন্ধ হওয়ার পর স্ত্রী চলে গেল, দুটি সন্তান নিয়ে রাস্তায় বসে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। গত মাসে শুনলাম, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। মহোদয়, এভাবে কত জীবন নিভে যাবে? কত করিম-অমিত মরবে?  

মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আমরা কখনো রাজনীতির দাবিদার হইনি। চাইনি সোনার বাংলা। শুধু চেয়েছি ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র। সন্তানদের মুখে ভাত দিতে পারলেই হয়। কিন্তু এখন তো সেই ভাতের গ্রাসও হাতছাড়া। আমাদের ঘামে-রক্তে গড়া এই দেশের অর্থনীতি, অথচ আমরা কেন এভাবে মরছি?  

আপনার কানে কী আমাদের কান্না পৌঁছায় না? আপনি কি জানেন, রাতের বস্তিতে কত মা অভুক্ত সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর গান গায়? আমরা তো আর কিছু চাই না—শুধু একটি সুযোগ চাই। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎটুকু বাঁচান।  

আপনার পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছি। কারখানার তালা খুলুন, বিনিয়োগকারীদের ডাকুন, আমাদের হাতে কাজ দিন। আমরা রাজনীতি বুঝি না, বুঝি শুধু ক্ষুধার যন্ত্রণা। আমাদের ভোট না পেতে চান, তাতেও আপত্তি নেই—শুধু বাঁচতে দিন।  

আপনি আমাদের শেষ ভরসা, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। এই ভরসার প্রদীপ নিভিয়ে দেবেন না।  


করিম মিয়া  

(একটি ক্ষুধার্ত, আশাহত বাতাসে দোল খেয়ে চলা জীবন)  

গাজীপুর বস্তি, ১৫ মার্চ ২০২৫

মতামত এর আরও খবর