নিষিদ্ধ পল্লীর আলো আঁধারের ভালোবাসা!
রেজুয়ান আহম্মেদ
দৌলোদিয়া। পদ্মার কোল ঘেঁষে থাকা এই নিষিদ্ধ পল্লীটির নাম শুনলে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেখানে আলো জ্বলে ঠিকই, কিন্তু সেই আলোর নিচে ছায়ার মতো বাস করে অসংখ্য নিষ্পাপ মেয়ের জীবন। জীবন, যা ঘিরে থাকে অবমাননা, যন্ত্রণা আর বঞ্চনার জালে। তাদের হৃদয়ের গভীরে জমা থাকে অসীম বেদনা, যার গল্প কেউ শোনে না, শুনতে চায় না।
তবে এমনই একটি অন্ধকারময় জীবনের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল একটি অসম্ভব ভালোবাসার গল্প—রেশমা আর রুবেলের। এই নিষিদ্ধ পল্লীর বুকে একদিন, আশাহীনতার মধ্যেও তারা খুঁজে পেয়েছিল একটুকরো শান্তি, একটুকরো সত্যিকারের ভালোবাসা।
রেশমা এই পল্লীর একটি পুরনো বাসিন্দা। তার বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তখনই তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল এখানে। নিষ্ঠুর সমাজের অমানবিক ছলনায় আটকে পড়েছিল সে। সেই থেকে তার জীবন কাটছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অন্যের ইচ্ছার দাসী হয়ে। তার জীবনে ভালোবাসা বা স্বাধীনতার কোনো স্বপ্নই ছিল না, কারণ এই পল্লীতে এমন কোনো স্বপ্নের জায়গা নেই।
অন্যদিকে, রুবেল ছিল এক সাধারণ যুবক। স্থানীয় একটি চা দোকানে কাজ করতো সে। রুবেলের দৃষ্টিতে ভালোবাসা ছিল সারল্যে মোড়ানো, কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা ধূর্ততা ছিল না। সে জানতো না, ভালোবাসা কেমন হয়, জানতো না কিভাবে কাউকে ভালোবাসতে হয়। সে শুধু জানতো মানুষের সেবা করা আর হাসিমুখে দিন কাটানো। চা বিক্রির আড়ালে সে খুঁজে বেড়াতো জীবনের মানে।
একদিন রেশমা ঠিক তার দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তাকে দেখে রুবেলের চোখে একটা অদ্ভুত অনুভূতি জন্মালো। সে প্রথমে বুঝতে পারল না কেন তার দিকে এভাবে তাকাচ্ছে। কিন্তু রেশমা কিছু বুঝতে না দিয়েই দ্রুত চলে গেল, যেন তার চোখের সামনে ধরা পড়তে না চায়।
এরপর থেকে, রুবেল প্রতিদিনই রেশমাকে দেখার অপেক্ষায় থাকত। কিন্তু কথা বলার সাহস হচ্ছিল না। রেশমা প্রথমে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সে বুঝতে পারল রুবেল তাকে লক্ষ্য করছে। অদ্ভুত একটা টান অনুভব করছিল সে। অথচ তার মতো মেয়ে কি কারও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য হতে পারে?
একদিন হঠাৎ করেই রুবেল রেশমার সামনে এসে দাঁড়াল। সে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “আপনি কি এখানে নতুন এসেছেন? আগে তো দেখিনি।” রেশমা চমকে উঠে রুবেলের মুখের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “না, আমি এখানেই থাকি। আর নতুন না, বহুদিন হলো এখানে আছি।”
রুবেলের হৃদয়ে যেন একটা কাঁটা ফুটল। সে জানত দৌলোদিয়ার নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের কাহিনি, কিন্তু কখনও ভাবেনি যে একজন মানুষের জীবন এতটা কঠিন হতে পারে। রুবেল আরও জানতে চাইল, কিন্তু তার মুখে কথা আটকে গেল। অবশেষে বলল, “আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারি?”
রেশমা প্রথমে ভয় পেল। এমন সরল ও দয়ালু কথা আগে কেউ বলেনি। সে বলল, “আমার জন্য তুমি কিছুই করতে পারবে না। আমাকে এ জীবন থেকে কেউ মুক্ত করতে পারবে না।”
কথোপকথনের মাধ্যমে রেশমা আর রুবেলের মাঝে একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি হলো। তারা প্রায়ই দেখা করত, চা খেত আর জীবনের গল্প করত। রুবেল প্রথমবার বুঝতে পারল, ভালোবাসা শুধু শরীরের নয়, হৃদয়ের টান। রেশমার বেদনাময় জীবন তাকে আরও কাছে টানতে লাগল। রুবেল চেয়েছিল রেশমাকে মুক্ত করতে, কিন্তু সে জানত, এ কাজ সহজ নয়।
একদিন রুবেল সাহস করে রেশমাকে বলল, “চলো, পালিয়ে যাই। আমরা অন্য কোথাও গিয়ে নতুন জীবন শুরু করব।”
রেশমা হতবাক হয়ে তাকাল। তার মনে মিশে ছিল আশা ও ভয়। সে জানত, পালানো সহজ নয়, তার ওপর এই নিষিদ্ধ পল্লী থেকে বেরিয়ে যাওয়া মানে মৃত্যুর ঝুঁকি। তবুও, রুবেলের চোখের মধ্যে এমন একটা দৃঢ়তা ছিল যে, সে একটু হলেও বিশ্বাস করতে শুরু করল। তার অন্তরে যে ছোট্ট একটা আশার আলো জ্বলে উঠেছে, সেটাকে সে নিভতে দিতে চায়নি।
তারা পরিকল্পনা করল পালানোর। রুবেল কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল, সেটাই ছিল তাদের সম্বল। কিন্তু এই নিষিদ্ধ পল্লীর লোকেরা এত সহজে কাউকে ছাড়তে রাজি নয়। পল্লীর দালালরা রেশমার পিছু নিতে লাগল। তারা খবর পেল যে রেশমা পালানোর চেষ্টা করছে। এক রাতে, যখন তারা পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই দালালদের একজন তাদের দেখে ফেলল।
রুবেল ও রেশমা দৌড়াতে শুরু করল। তারা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে ছিল, যেন জীবনের শেষ মুহূর্তেও একে অপরকে ছাড়বে না। দালালরা তাদের পিছু নিয়ে তাড়া করতে লাগল। পদ্মার পাড় ধরে তারা ছুটছিল, যেন সেই নদীর স্রোত তাদের নতুন জীবনের দিকে নিয়ে যাবে।
কিন্তু জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা এত সহজে ছাড়ে না। দালালরা তাদের ধরে ফেলল। রুবেলকে মারধর করে দূরে ফেলে দিল আর রেশমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো সেই অন্ধকারে, যেখানে আর কোনো আলো ছিল না।
রুবেল যখন চেতনা ফিরে পেল, তখন চারদিকে অন্ধকার। সে জানত রেশমাকে বাঁচাতে না পারার যন্ত্রণা তাকে আজীবন তাড়া করবে। সে ছুটে গেল পল্লীর দিকে, কিন্তু সেখানে কেউ রেশমার নাম শোনেনি। রুবেলের চোখের জল শুকিয়ে গেল। সে পদ্মার দিকে তাকিয়ে অনুভব করল, তার ভালোবাসা পদ্মার মতো গভীর ছিল, কিন্তু সেই ভালোবাসা সমাজের নিষ্ঠুরতার স্রোতে হারিয়ে গেল।
কয়েকদিন পর, রুবেল খুঁজে পেল রেশমার মৃতদেহ। নিষ্ঠুর দালালদের অত্যাচারে তার প্রিয় মানুষটি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। রুবেলের মনে হল, এই নিষিদ্ধ পল্লী তার ভালোবাসাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।
পদ্মার ঢেউগুলো ক্রমাগত ভাঙছিল, যেমন ভেঙে পড়েছিল রুবেলের স্বপ্ন। সে পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করল, তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রেশমার স্মৃতি সে হৃদয়ে বহন করে চলবে। কিন্তু সমাজের নিষ্ঠুরতা আর অমানবিকতার এই অন্ধকার কখনও শেষ হবে না।
এই নিষিদ্ধ পল্লীতে হাজার হাজার রেশমা আর রুবেলের গল্প আছে, যেগুলো সমাজ কখনও শোনে না। তাদের ভালোবাসা হারিয়ে যায় পদ্মার স্রোতে, সমাজের বঞ্চনায়। কিন্তু তাদের হৃদয়ের গভীরে বেঁচে থাকে সেই নিষিদ্ধ ভালোবাসা, যা তাদের জীবনের একমাত্র আলো হয়ে থাকে।