img

নিষিদ্ধ পল্লীর আলো আঁধারের ভালোবাসা!

প্রকাশিত :  ০৫:৫০, ১২ অক্টোবর ২০২৪

নিষিদ্ধ পল্লীর আলো আঁধারের ভালোবাসা!

রেজুয়ান আহম্মেদ

দৌলোদিয়া। পদ্মার কোল ঘেঁষে থাকা এই নিষিদ্ধ পল্লীটির নাম শুনলে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেখানে আলো জ্বলে ঠিকই, কিন্তু সেই আলোর নিচে ছায়ার মতো বাস করে অসংখ্য নিষ্পাপ মেয়ের জীবন। জীবন, যা ঘিরে থাকে অবমাননা, যন্ত্রণা আর বঞ্চনার জালে। তাদের হৃদয়ের গভীরে জমা থাকে অসীম বেদনা, যার গল্প কেউ শোনে না, শুনতে চায় না।

তবে এমনই একটি অন্ধকারময় জীবনের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল একটি অসম্ভব ভালোবাসার গল্প—রেশমা আর রুবেলের। এই নিষিদ্ধ পল্লীর বুকে একদিন, আশাহীনতার মধ্যেও তারা খুঁজে পেয়েছিল একটুকরো শান্তি, একটুকরো সত্যিকারের ভালোবাসা।

রেশমা এই পল্লীর একটি পুরনো বাসিন্দা। তার বয়স যখন মাত্র ১২ বছর, তখনই তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল এখানে। নিষ্ঠুর সমাজের অমানবিক ছলনায় আটকে পড়েছিল সে। সেই থেকে তার জীবন কাটছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অন্যের ইচ্ছার দাসী হয়ে। তার জীবনে ভালোবাসা বা স্বাধীনতার কোনো স্বপ্নই ছিল না, কারণ এই পল্লীতে এমন কোনো স্বপ্নের জায়গা নেই।

অন্যদিকে, রুবেল ছিল এক সাধারণ যুবক। স্থানীয় একটি চা দোকানে কাজ করতো সে। রুবেলের দৃষ্টিতে ভালোবাসা ছিল সারল্যে মোড়ানো, কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা ধূর্ততা ছিল না। সে জানতো না, ভালোবাসা কেমন হয়, জানতো না কিভাবে কাউকে ভালোবাসতে হয়। সে শুধু জানতো মানুষের সেবা করা আর হাসিমুখে দিন কাটানো। চা বিক্রির আড়ালে সে খুঁজে বেড়াতো জীবনের মানে।

একদিন রেশমা ঠিক তার দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তাকে দেখে রুবেলের চোখে একটা অদ্ভুত অনুভূতি জন্মালো। সে প্রথমে বুঝতে পারল না কেন তার দিকে এভাবে তাকাচ্ছে। কিন্তু রেশমা কিছু বুঝতে না দিয়েই দ্রুত চলে গেল, যেন তার চোখের সামনে ধরা পড়তে না চায়।

এরপর থেকে, রুবেল প্রতিদিনই রেশমাকে দেখার অপেক্ষায় থাকত। কিন্তু কথা বলার সাহস হচ্ছিল না। রেশমা প্রথমে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সে বুঝতে পারল রুবেল তাকে লক্ষ্য করছে। অদ্ভুত একটা টান অনুভব করছিল সে। অথচ তার মতো মেয়ে কি কারও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য হতে পারে?

একদিন হঠাৎ করেই রুবেল রেশমার সামনে এসে দাঁড়াল। সে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “আপনি কি এখানে নতুন এসেছেন? আগে তো দেখিনি।” রেশমা চমকে উঠে রুবেলের মুখের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “না, আমি এখানেই থাকি। আর নতুন না, বহুদিন হলো এখানে আছি।”

রুবেলের হৃদয়ে যেন একটা কাঁটা ফুটল। সে জানত দৌলোদিয়ার নিষিদ্ধ পল্লীর মেয়েদের কাহিনি, কিন্তু কখনও ভাবেনি যে একজন মানুষের জীবন এতটা কঠিন হতে পারে। রুবেল আরও জানতে চাইল, কিন্তু তার মুখে কথা আটকে গেল। অবশেষে বলল, “আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারি?”

রেশমা প্রথমে ভয় পেল। এমন সরল ও দয়ালু কথা আগে কেউ বলেনি। সে বলল, “আমার জন্য তুমি কিছুই করতে পারবে না। আমাকে এ জীবন থেকে কেউ মুক্ত করতে পারবে না।”

কথোপকথনের মাধ্যমে রেশমা আর রুবেলের মাঝে একটা মিষ্টি সম্পর্ক তৈরি হলো। তারা প্রায়ই দেখা করত, চা খেত আর জীবনের গল্প করত। রুবেল প্রথমবার বুঝতে পারল, ভালোবাসা শুধু শরীরের নয়, হৃদয়ের টান। রেশমার বেদনাময় জীবন তাকে আরও কাছে টানতে লাগল। রুবেল চেয়েছিল রেশমাকে মুক্ত করতে, কিন্তু সে জানত, এ কাজ সহজ নয়।

একদিন রুবেল সাহস করে রেশমাকে বলল, “চলো, পালিয়ে যাই। আমরা অন্য কোথাও গিয়ে নতুন জীবন শুরু করব।”

রেশমা হতবাক হয়ে তাকাল। তার মনে মিশে ছিল আশা ও ভয়। সে জানত, পালানো সহজ নয়, তার ওপর এই নিষিদ্ধ পল্লী থেকে বেরিয়ে যাওয়া মানে মৃত্যুর ঝুঁকি। তবুও, রুবেলের চোখের মধ্যে এমন একটা দৃঢ়তা ছিল যে, সে একটু হলেও বিশ্বাস করতে শুরু করল। তার অন্তরে যে ছোট্ট একটা আশার আলো জ্বলে উঠেছে, সেটাকে সে নিভতে দিতে চায়নি।

তারা পরিকল্পনা করল পালানোর। রুবেল কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিল, সেটাই ছিল তাদের সম্বল। কিন্তু এই নিষিদ্ধ পল্লীর লোকেরা এত সহজে কাউকে ছাড়তে রাজি নয়। পল্লীর দালালরা রেশমার পিছু নিতে লাগল। তারা খবর পেল যে রেশমা পালানোর চেষ্টা করছে। এক রাতে, যখন তারা পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক তখনই দালালদের একজন তাদের দেখে ফেলল।

রুবেল ও রেশমা দৌড়াতে শুরু করল। তারা একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে ছিল, যেন জীবনের শেষ মুহূর্তেও একে অপরকে ছাড়বে না। দালালরা তাদের পিছু নিয়ে তাড়া করতে লাগল। পদ্মার পাড় ধরে তারা ছুটছিল, যেন সেই নদীর স্রোত তাদের নতুন জীবনের দিকে নিয়ে যাবে।

কিন্তু জীবনের নিষ্ঠুর বাস্তবতা এত সহজে ছাড়ে না। দালালরা তাদের ধরে ফেলল। রুবেলকে মারধর করে দূরে ফেলে দিল আর রেশমাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো সেই অন্ধকারে, যেখানে আর কোনো আলো ছিল না।

রুবেল যখন চেতনা ফিরে পেল, তখন চারদিকে অন্ধকার। সে জানত রেশমাকে বাঁচাতে না পারার যন্ত্রণা তাকে আজীবন তাড়া করবে। সে ছুটে গেল পল্লীর দিকে, কিন্তু সেখানে কেউ রেশমার নাম শোনেনি। রুবেলের চোখের জল শুকিয়ে গেল। সে পদ্মার দিকে তাকিয়ে অনুভব করল, তার ভালোবাসা পদ্মার মতো গভীর ছিল, কিন্তু সেই ভালোবাসা সমাজের নিষ্ঠুরতার স্রোতে হারিয়ে গেল।

কয়েকদিন পর, রুবেল খুঁজে পেল রেশমার মৃতদেহ। নিষ্ঠুর দালালদের অত্যাচারে তার প্রিয় মানুষটি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। রুবেলের মনে হল, এই নিষিদ্ধ পল্লী তার ভালোবাসাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে।

পদ্মার ঢেউগুলো ক্রমাগত ভাঙছিল, যেমন ভেঙে পড়েছিল রুবেলের স্বপ্ন। সে পদ্মার পাড়ে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করল, তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রেশমার স্মৃতি সে হৃদয়ে বহন করে চলবে। কিন্তু সমাজের নিষ্ঠুরতা আর অমানবিকতার এই অন্ধকার কখনও শেষ হবে না।

এই নিষিদ্ধ পল্লীতে হাজার হাজার রেশমা আর রুবেলের গল্প আছে, যেগুলো সমাজ কখনও শোনে না। তাদের ভালোবাসা হারিয়ে যায় পদ্মার স্রোতে, সমাজের বঞ্চনায়। কিন্তু তাদের হৃদয়ের গভীরে বেঁচে থাকে সেই নিষিদ্ধ ভালোবাসা, যা তাদের জীবনের একমাত্র আলো হয়ে থাকে।

img

বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নয়, তাহলে কোথায় বসবে?

প্রকাশিত :  ০৫:৪৮, ১৩ নভেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৬:১৮, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

বাংলা একাডেমির পাশাপাশি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত এক দশকের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী আয়োজিত হচ্ছে না আগামীর অমর একুশে বইমেলা। 

আসন্ন একুশে বইমেলার জন্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বরাদ্দ পায়নি বাংলা একাডেমি। গত ৬ নভেম্বর বাংলা একাডেমিকে দেওয়া এক চিঠিতে এমন তথ্য জানিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

সেক্ষেত্রে আগামী মেলার আয়োজন কোথায় কীভাবে হবে, সে প্রশ্নই এখন সকলের কাছে ঘুরে ফিরে আসছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বাংলা একাডেমিকে চিঠি দিয়ে বলেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিবর্তে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই ‘অমর একুশে বইমেলা, ২০২৫’ আয়োজন করতে হবে।

তবে বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে করতে আবারও চেষ্টা করবেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অমর একুশে বইমেলা করা যাবে না, এমন সিদ্ধান্ত জানিয়েছে গণপূর্ত ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়। 

তারা বলেছে— একাডেমির চত্বরের ভেতরে মেলার আয়োজন করার কথা। তবে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে আপিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা করতে চাই।’

১৯৭২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির গেইটে চট বিছিয়ে বই বিক্রি শুরু করেন প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারা’র প্রতিষ্ঠাতা চিত্তরঞ্জন সাহা।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানমালার সাথে সঙ্গতি রেখে একাডেমির ভেতরে ছোট একটি স্টল স্থাপন করে বই বেচে মুক্তধারা। ১৯৭৭ সালে মুক্তধারার সঙ্গে আরও অনেকে যোগ দেয়, সেই থেকে একুশে বইমেলার সূচনা।

১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক আশরাফ সিদ্দিকী একাডেমিকে এ বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন। এর পরের বছরই বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়।

মনজুরে মওলা বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকার সময় ১৯৮৩ সালে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে এ মেলা আয়োজনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও তা করা যায়নি। পরের বছর থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে সূচনা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে মেলা পরিচালনা করছে। ২০২১ সাল থেকে মেলার প্রাতিষ্ঠানিক নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে বইমেলা’।

মেলা শুরু থেকেই একাডেমি প্রাঙ্গণে হয়ে এলেও ধীরে ধীরে পরিসর বাড়তে থাকায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আর জায়গা সংকুলান হচ্ছিল না। পরে একাডেমির সামনের সড়কেও বইমেলার স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়।

২০১৪ সালে সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বরাদ্দ দেওয়া হয় এবং সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে বরাদ্দ দেওয়া হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। তবে মেলার মূল মঞ্চ এবং তথ্যকেন্দ্র রাখা হয় একাডেমি প্রাঙ্গণেই।

বিগত এক দশক ধরে বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হচ্ছে বইমেলা। চলতি বছর বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে বসে বইমেলার আয়োজন।

তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল গত মেলার সময়ই। উদ্যান ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরির অংশ হিসেবে মার্চ মাস থেকে কিছু প্রকল্পের কাজ শুরুর পরিকল্পনা করেছিল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। 

সে কারণে ২০২৫ সালের বইমেলার জন্য তারা উদ্যানের জায়গা বরাদ্দ দেবে না বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়ে দিয়েছিল। বইমেলা বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে পূর্বাচলে নিয়ে যাওয়া হবে বলেও গুঞ্জন রটে।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরেনি; গত ৬ নভেম্বরের চিঠিতে সে কথাই স্পষ্ট করা হয়েছে।

তাহলে আগামী মেলার আয়োজন কীভাবে হবে জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘আমরা অবশ্যই চাইব বইমেলা যেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই হয়। সেজন্য আমরা আবারও চেষ্টা করব।’

এদিকে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি তো জানি না এরকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা। 

তবে সরকার যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলা আয়োজনের অনুমতি না দেয়, তাহলে সবাই মিলে সরকারকে বোঝাতে হবে যে বইমেলা এখানে না হলে গুরুত্ব হারাবে।

বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করলেই ভালো। এটা লেখক, প্রকাশকসহ বইমেলা সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তারা সবাই মিলে সরকারকে বোঝালে আশা করি সিদ্ধান্ত পাল্টাবে।’