অসীম একাকিত্ব!
রেজুয়ান আহম্মেদ
কামরাঙ্গীরচরের সেই পুরনো পাড়ার সরু গলির ভিতর এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে একটি জরাজীর্ণ বাড়ি। বৃষ্টিতে দেয়ালগুলো ক্ষয়ে গেছে, জানালার কাঠগুলো জীর্ণ হয়ে প্রায় ভেঙে পড়ার মতো। বাড়িটির ভিতর আলো-আঁধারির খেলায় সময় যেন থেমে আছে, আর তারই মাঝে এক বৃদ্ধ মানুষ বসে থাকেন। নাম তার জামাল উদ্দিন আহমেদ। একসময় যে মানুষটি দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, আজ তার জীবন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সময়ের প্রলাপে এখন তিনি একা, সম্পূর্ণ একা।
২০ বছর আগে, যখন তিনি সরকার থেকে অবসর নিলেন, হাতে এল রিটায়ারমেন্টের কিছু টাকা। সেই টাকাই ছিল তার সারা জীবনের সঞ্চয়। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার একমাত্র ছেলে আবির আহমেদ একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে। মেধাবী ছেলে ছিল আবির, তাকে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাষ্ট্র পাঠালেন। সব স্বপ্ন, সব আশা আবিরের উপরেই গড়ে উঠেছিল। আবিরের মা অনেক আগেই, ৩০ বছর আগে চলে গেছেন, সেই থেকে বাবা-ছেলের সম্পর্কটাই ছিল জামাল উদ্দিনের জীবনের একমাত্র অবলম্বন।
প্রথমদিকে চিঠি আসত, ফোন আসত, ছেলের কথা শুনে জামাল উদ্দিন আনন্দে মুখ উজ্জ্বল করতেন। ছেলের সাফল্যের গল্প শুনতেন, ভাবতেন, আর কয়েক বছরের মধ্যেই ছেলে ফিরে আসবে, আর সেই ফেরা হবে এক নতুন শুরু—বাবার দুঃখ ঘোচানোর এক দিন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই চিঠি আর ফোন কমতে শুরু করল। যেন আবিরের জীবনের নতুন পথের সাথে পুরনো সম্পর্কগুলো ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, ব্যস্ততা হয়তো ছেলে আর ফোন দিতে পারে না। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেল, আর একদিন যখন সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল, তখন জামাল উদ্দিনের মনে সংশয় দানা বাঁধতে শুরু করল।
তিনি বারবার চেষ্টা করলেন ছেলের সাথে যোগাযোগ করার, একের পর এক চিঠি পাঠালেন, কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি। সময়ের ভারে বৃদ্ধ মানুষের হাত কাঁপতে শুরু করল, কিন্তু তার সন্তানের জন্য অপেক্ষার তীক্ষ্ণ ব্যথা কখনো হালকা হলো না। দিনে দিনে বাড়িটি তার নিজের মতো করেই ভেঙে পড়তে থাকল, আর ভেতরে ভেঙে পড়তে থাকল একজন অসহায় বাবা।
কামরাঙ্গীরচরের সেই সরু রাস্তাগুলোর মানুষজন জানত যে বৃদ্ধ জামাল উদ্দিন একসময় কেমন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী মানুষ ছিলেন। তারা দেখত, এখন তিনি সারাদিন সেই ভাঙা বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকেন। অনেক সময় কেউ কেউ এসে জিজ্ঞেস করত, "আবির ভাই কি ফিরবেন?" তার ঠোঁটে তিক্ত হাসি ফুটত, কিন্তু মুখে কোনো উত্তর আসত না। ভিতরের কান্না তখন দমবন্ধ অবস্থায় বুকের মধ্যে চেপে রাখতেন তিনি।
সন্ধ্যার পর বাড়িটি আরও অন্ধকার হয়ে যেত। কোনোদিন হয়তো তিনি কিছু খেতেন, আবার কোনোদিন হয়তো শুধুই পানির গ্লাসে ভরসা করতেন। আবিরের সাথে তার ছোটবেলার গল্পগুলো মনে পড়ে যেত। জামাল উদ্দিন তার ছেলেকে পড়াতে কত পরিশ্রম করেছিলেন! আবির ছোটবেলায় বাবার সাথে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করত। জামাল উদ্দিন সেই সময় হাসিমুখে বলতেন, “তোমার মা আমাদের উপরই চোখ রাখছে, একদিন তুমি যখন অনেক বড় হবে, তখন মাও গর্ব করবে।”
কিন্তু সেই গর্ব আর হলো কই? এক এক করে দিন কেটে যায়, মাস কেটে যায়। বাড়ির দেওয়ালে ধুলো জমে, মাকড়সার জাল হয়তো পুরো ঘরটাকে ঢেকে ফেলে, কিন্তু ছেলের কোনো খবরই আসে না। একসময় তিনি ভাবলেন, হয়তো ছেলেটা ভুলেই গেছে যে এই ছোট্ট বাড়িতে তার বাবা একা বসে তার জন্য অপেক্ষা করছে।
প্রতিদিনের একাকিত্ব আর বেদনার ভেতর তার মনের ভাঙন আরও গভীর হতে থাকে। এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি বারবার ভাবেন, "কী ভুল করলাম? ছেলেকে কেন পাঠালাম এত দূর? এত টাকা খরচ না করলেই কি ভালো হতো?" নিজেকে শাসন করেন, কিন্তু তার মনের কষ্ট কোনোভাবেই কমে না।
প্রতিটি রাত তার জন্য দীর্ঘ হয়, আর প্রতিটি ভোর তাকে মনে করিয়ে দেয় যে আজও কোনো চিঠি আসেনি, কোনো ফোন বাজেনি। মানুষজন মাঝে মাঝে আসতে আসতে বন্ধ করে দেয়। তার ভেতরে যে আত্মসম্মান ছিল, সেটাও ক্রমে ক্রমে চুরমার হতে থাকে। তার কোনো অভিযোগ নেই, কেবল মনের মধ্যে জমে থাকা একরাশ হতাশা তাকে ক্রমশ গ্রাস করে। ছেলের জন্য যে আশ্রয়টুকু দিয়েছিলেন, সেটাও হারিয়ে গেছে। বৃদ্ধ মানুষটি জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাচ্ছেন অপেক্ষা আর বেদনার ভেতর।
জামাল উদ্দিনের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন ছিল তার ছেলে ফিরবে, তার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন, সবাই সব স্বপ্ন পূরণ করতে পারে না। অনেকেই একা থেকে যায়, আর সেই একাকিত্বেই শেষ হয়ে যায় তাদের জীবনের সব কল্পনা, সব আশা।
এভাবেই অন্ধকারে ডুবে থাকা জরাজীর্ণ বাড়ির ভেতর জামাল উদ্দিন একা বসে আছেন—অপেক্ষায়, আর হয়তো সেই অপেক্ষারও কোনো শেষ নেই।