প্রকাশিত :
০৯:২০, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ সর্বশেষ আপডেট: ০৯:২৪, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪
রেজুয়ান আহম্মেদ
মেঘলা আকাশ, গুমোট বাতাস, সিলেটের জৈন্তাপুর ফেরিঘাট এলাকার মেঠোপথে এক অদৃশ্য দুঃস্বপ্নের ছায়া। দূরে এক পাহাড়ি নদীর স্রোত যেন ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বন্যার খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আর লোকজন দলবেঁধে নিরাপদ স্থানে ছুটছে। তবে গ্রামের শেষপ্রান্তে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘরে তখনও এক মা তার ছোট্ট সন্তানকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বসে আছে। সুলতানা, এই মায়ের নাম, আর তার ছোট্ট ছেলের নাম নাবিল।
সুলতানার জীবন ছিল সংগ্রামের এক নিঃশেষ পরিসংখ্যান। তিন বছর আগে সে তার প্রিয়জন, তার স্বামীকে হারিয়েছে। একাকী, অদম্য শক্তি আর সাহস নিয়ে, গ্রামীণ জীবনে সংসারের হাল ধরেছিল। তার দিন গিয়েছিল অন্যের বাড়িতে হাঁড়ি ধুয়ে, কাজ করে, আর রাতে বাড়ি ফিরে তার একমাত্র ছেলেকে স্নেহের মাঝে মানুষ করার চেষ্টা। নাবিল ছিল তার জীবনের একমাত্র আশ্রয়, জীবনের একমাত্র প্রেরণা। মায়ের মুখে সবসময় শুনত, “তোর জন্যই আমি বাঁচি, রে। তুই-ই আমার স্বপ্ন।”
কিন্তু সে দিনটা ছিল অন্যরকম। বন্যার স্রোত যখন বাড়তে লাগল, প্রতিবেশীরা এসে বলল,
“সুলতানা, তুই এখনো বসে আছিস? পানি কিন্তু সব ডুবিয়ে দিচ্ছে। চল, আমাদের সঙ্গে চল।”
সুলতানা তার চোখে একবার তাকাল তার ছেলেকে। কোলের নাবিল তখন গভীর ঘুমে। তার ছোট্ট নিঃশ্বাসে যেন পৃথিবীর সমস্ত শান্তি ছিল। সুলতানা মৃদু হেসে বলল,
“তোমরা যাও। আমার ছেলে ঘুমাচ্ছে। ওকে নিয়ে কীভাবে বেরোব? ঘুম থেকে জাগলেই যাব।”
কিন্তু এই কথাগুলো ছিল শুধু সন্তানকে সুরক্ষিত রাখার অজুহাত। তার বুকের ভেতরে চলছিল এক গভীর দ্বন্দ্ব। “আমি যদি বের হই, নাবিলকে বাঁচাতে পারব তো?”
ঘরের ভেতর পানি ঢুকতে শুরু করল। সময় ছিল না, তাড়াহুড়া করে সুলতানা ঘরের কোণায় রাখা একটি পুরনো কাঠের বাক্স টেনে আনল। ভাবল, যদি এই বাক্সে ছেলেকে রাখে, তবে হয়তো স্রোতের হাত থেকে রক্ষা পাবে। দ্রুত সে তার গায়ের চাদর দিয়ে বাক্সটি মুড়িয়ে দিল, যেন পানি ভেতরে না ঢোকে।
ছেলেকে বাক্সে রেখে সুলতানা নিজে বসে রইল বাক্সের পাশে। তার হাত শিশুটির গায়ে রেখে বারবার অনুভব করছিল, “আমার জীবন যাক, কিন্তু ও যেন বাঁচে।” ঘরের ভেতর পানি আরও বেশি বাড়তে লাগল, সুলতানা বাক্সটি শক্ত করে ধরে রেখে পানির স্রোতের সঙ্গে লড়াই করল। তার কণ্ঠে একটিই প্রার্থনা ছিল,
“হে আল্লাহ, আমার সন্তানকে বাঁচাও। ওর জীবন যেন আমার চেয়েও বেশি দামি হয়।”
বন্যার স্রোতে ভেসে গেল কুঁড়েঘর। সুলতানা এক হাত দিয়ে বাক্সটি ধরে রেখেছিল, আর অন্য হাত দিয়ে একটি গাছের ডাল আঁকড়ে রইল। অনেকক্ষণ ধরে লড়াই করার পর সুলতানা বুঝতে পারল, তার শরীর আর স্রোতের সঙ্গে লড়তে পারছে না। কিন্তু মায়ের মন যেন দেহের শারীরিক শক্তি ছাড়িয়ে এক অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করছিল। শেষবারের মতো ছেলেকে চুমু খেয়ে, বাক্সটি ঠেলে দিল পানির বিপরীতে। তার শরীর আর শক্তি ছিল না, কিন্তু বুকের ভেতর তার একক সাধনা ছিল—“আমার সন্তান যেন বাঁচে।”
সুলতানা নিজের হাত ছেড়ে দিয়ে স্রোতের সঙ্গে মিলিয়ে গেল। পরদিন ভোরে গ্রামবাসী একটি ভাসমান বাক্স দেখতে পেল। বাক্সটি খোলার পর তারা দেখল, নাবিল জীবিত আছে, শুকনো চাদরে মুড়ে রাখা। কিন্তু তার মা আর নেই।
গ্রামের মানুষ কাঁদল। সবাই বলল, “মায়ের ভালোবাসা এমনই। নিজের জীবন দিয়ে সন্তানকে বাঁচায়।”
মায়ের ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্বার্থ অনুভূতি। এটি সময়, স্থান বা পরিস্থিতি মেনে চলে না। মা তার সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তা আর কেউ কখনো করতে পারবে না। মায়ের ভালোবাসা শুধুমাত্র প্রেম নয়, এটি এক আত্মত্যাগ, এক বিশাল শক্তি, যা পৃথিবীর সমস্ত শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে সন্তানকে রক্ষা করে। মা শুধুই মা নয়, সন্তানের পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রক্ষাকবচ।
এটাই মা-বাবার প্রতি সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা যেন কখনো শেষ না হয়। মা তার সন্তানকে শুধু জন্মই দেয় না, তাকে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলে, আর সেই ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য রত্ন।
এই ভালোবাসার কোনও সীমা নেই। এটি নিজস্বতায়, জীবনের প্রতি অটুট বিশ্বাসে ভরা। সত্যিকার অর্থে, একজন মা তার সন্তানের জন্য যা করতে পারেন, তা আর কেউ কখনো করতে পারবে না, কারণ মা যেন এক পৃথিবী, যা তার সন্তানকে লালন-পালন করার জন্য এক অনবদ্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখে।