প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সমাহার এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওর
সংগ্রাম দত্ত: বাংলাদেশ তথা এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। এই হাওরের অধিকাংশ অংশ সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। হাওরের মোট আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর, তার মধ্যে শুধুমাত্র বিলের আয়তন ৪,৪০০ হেক্টর। এটি মৌলভীবাজার জেলায় বড়লেখায় (৪০%), কুলাউয়ায় (৩০%), সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জে (১৫%), গোলাপগঞ্জে (১০%) এবং বিয়ানীবাজারে (৫%) এলাকাজুড়ে বিস্তৃত।
ভূতাত্ত্বিকভাবে এর অবস্থান, উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড় এবং পূর্বে ত্রিপুরা পাহাড়ের পাদদেশ। ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উজানে প্রচুর পাহাড় থাকায় হাকালুকি হাওরে প্রায় প্রতি বছরই আকস্মিক বন্যা হতে দেখা যায়।
হাকালুকি হাওরের নামকরণ নিয়ে বেশ ক’টি জনশ্রুতি আছে। কথিত আছে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলনেতা হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এলাকায় গিয়ে ‘লুকি দেয়’ অর্থাৎ লুকিয়ে থাকেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের বিবর্তনে কালক্রমে এই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি’। আরো প্রচলিত আছে যে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে এ এলাকায় প্রচন্ড এক ভূমিকম্প হয় উক্ত ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক নৃপতি ও তার রাজত্ব মাটির নিচে তলিয়ে যায়। এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘আকা+লুকি’ বা ‘হাকালুকি’। আরো শোনা যায় বড়লেখা উপজেলার পশ্চিমাংশে হেংকেল নামে একটি উপজাতি বাস করত। ঐ এলাকার নাম ছিল ‘হেংকেলুকি’ যা পরে ‘হাকালুকি’ নাম ধারণ করে। অপর এক জনশ্রুতি মতে, একসময় উক্ত হাওরের খুব কাছাকাছি কুকি ও নাগা নামে এক উপজাতি সম্প্রদায়ের বসবাস ছিলো। তারা তাদের ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করে ‘হাকালুকি’- যার অর্থ লুকানো সম্পদ।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সমাহার হাকালুকি হাওর। জলবায়ুর ভিন্নতার কারণে হাকালুকি একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে। মনোমুগ্ধকর এ রূপ যেন রূপ নয়, আবহমান বাংলার ঝলমলে এক জীবন্ত ছবি। যা না দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়। শীতকালে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের এ লীলাভূমি বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত শ্যামল প্রান্তরে রূপ নেয়। জেগে ওঠা উর্বর জমিতে শুরু হয় ফসলের আবাদ। শুষ্ক মৌসুমে সেখানেই মাইলের পর মাইল চোখ জোড়ানো সবুজ ধানের ক্ষেত। আউশ-আমন ধানের মৌ-মৌ গন্ধ। সবুজ ধানের গালিচায় বাতাসের লাগামহীন নৃত্য। গরু-মহিষের দল ঘুরে বেড়ায় মনের আনন্দে দলে দলে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরে। রাখালের বাঁশিতে ভাটিয়ালি মিষ্টি সুর আর ডানপিটে কিশোরের মাঠচষা বিচরণ। শীত মৌসুমে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিলের কান্দিগুলো দেখতে অসাধারণ। অগাধ পানিতে মাথা উঁচু করে থাকে সবুজ ঘাসের বাগান। শাপলা শালুক আর পদ্ম ফুলের বাহার হাওরের সৌন্দর্যকে আরো দ্বিগুণ করে তুলে। ঝলমল স্বচ্ছ পানিতে দাঁড়কানা মাছের ছোটাছুটি আর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় হাওরের জলে পড়া সূর্যের আলোর ঝিলিক সত্যই দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর।
শীতকালে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দের্যকে সমৃদ্ধ করে তুলে বিভিন্ন ধরনের অতিথি পাখির আগমন। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অতিথি পাখিরা আসে হাকালুকি হাওরে খাদ্য ও আবাসস্থলের সন্ধানে। হাকালুকি হাওর পরিণত হয় তখন দেশী ও বিদেশী পাখির এক মিলনকেন্দ্রে। হাওরপাড়ের হিজল, করচ, বরুণ গাছেই গড়ে তুলে তারা তাদের অস্থায়ী নিবাস। দুপুর বা বিকেলে পাখিদের খাবার নিয়ে ঝগড়া কিংবা খাবার সংগ্রহের দৃশ্য তখন হাকালুকি হাওরের প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। অতিথি পাখিরা একটা ক্ষণিক সময়ের জন্য এলেও তারা স্থানীয় লোকজন ও পর্যটকদের আত্মার আত্মীয় হিসেবে অতিথিপনা করে যায় নির্বিঘ্নে। হাওর এলাকার মানুষ তাদের ভালোবাসে প্রাণ খুলে। তাই তারা তাদের জন্য মিষ্টি মিষ্টি নামও দিয়েছে আদর করে। তেমনি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অতিথি পাখির নাম যেমন বালি হাঁস, লেঞ্জা হাঁস, পাতারি হাঁস, বৈকাল হাঁস, গিরিয়া হাঁস, ধূসর রাজহাঁস, ভূতি হাঁস, চিতি হাঁস, বারো ভূতি হাঁস, বৌমুনিয়া হাঁস, জাল কবুতর, গঙ্গা কইতর, আরো আছে পান্তামুখী, লালশির, নীলশির, রাঙ্গামুরি, পাথরঘুরানি বাতান, কালো কূট, চিত্রা ক্রেক, জলছড়ি রেইল, পেড়িভুতি, চখাচখি, গিরিয়া, খঞ্জনা, পাতারি, জলপিপি, পানি মুরগি, নর্থ গিরিয়া, পাতিবাটান, কমনচিল, কটনচিল প্রভৃতি।
শুকনো মৌসুমে যেখানে ধু-ধু প্রান্তর, বর্ষায় তা সম্পূর্ণ বিপরীত। বর্ষার ভরা বাদলে হাওর তার আগ্রাসী যৌবন ধারণ করে। সমুদ্রসম আকার নিয়ে সে তার বিজয়ধ্বনি প্রকাশ করে ঢেউয়ের প্রতিটি ছন্দে। যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। অথৈ জলরাশির মধ্যে ছোট-বড় ঢেউ ক্রমাগত গর্জন করে আছড়ে পড়ে হাওরতীরে। দূর বহু দূর চোখে ভাসে ছোট ছোট গ্রাম। হঠাৎ দেখলে গ্রামগুলোকে অনেকটা দ্বীপের মতো মনে হয়। মনে হয় যেন ঢেউয়ের তালে তাল রেখে গ্রামগুলো হাওরের পানিতে নাগরদোলায় দুলছে। আর এ দিকে ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি করে মাছ ধরতে ব্যস্ত থাকেন এখানকার জেলেরা। উত্তাল ঢেউ কাটিয়ে হাওরের মাঝ বুকে নৌকা নিয়ে ছোটেন মাঝি-মাল্লা। ঘোমটি আর ডিঙ্গি নাওয়ের পাশাপাশি শত শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা, পাল তোলা নৌকাও দেখা যায় হাওরের মধ্যখানে। জাহাজ আকৃতির ন্যায় মালামাল বহনকারী বড় বড় কার্গোও সদা চোখে পড়ে। দাঁড় বেয়ে নৌকা চালায় মাঝি। কণ্ঠে তাদের মিষ্টি সুরেলা গান, শোনা যায় হাওরের মাঝ থেকে ভাটিয়ালি, জারিসারি আর মুর্শিদি গানের অপূর্ব ঝঙ্কার। দুর থেকে দেখা যায় এ বাড়ি ও বাড়ির ঘাটে বাঁধা ডিঙ্গি। আবার নৌকা বেয়ে ওড়াল জাল দিয়ে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, যা এখানকার নিত্যদিনকার চিত্র।
হাকালুকির জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে
হাকালুকি হাওরে ৫২৬ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪১৭ প্রজাতির পাখি, এর মধ্যে ১১২ প্রজাতির অতিথি পাখি ও ৩০৫ প্রজাতির দেশীয় পাখি দেখা যায়। এ ছাড়া ১৪১ প্রজাতির অন্যান্য বন্যপ্রাণী, ১০৭ প্রজাতির মাছ, তন্মধ্যে ৩২ প্রজাতির বিভিন্ন পর্যায়ে বিপন্ন প্রায়। এ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরনের কীট-পতঙ্গ, জলজ ও স্থলজ ক্ষুদ্র অনুজীব। স্থায়ী ও অতিথি পাখিদের আবাসস্থল হিসেবে হাকালুকি হাওর সুপরিচিত। বন্যার পানি চলে যাওয়ার পর হাওরে প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন প্রকার ছোট-বড় মাছ, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে জেগে ওঠে পশুচারণভূমি। বনাঞ্চলে একসময় জলসহিষ্ণু উদ্ভিদ, যেমন- হিজল, করচ, বরুণ, ভুই ডুমুর, জলডুমুর (এক ধরনের ঋরপঁং), হোগল, নল, খাগড়া, বনতুলসী, বলুয়া প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে জন্মাত। সেটা আগের তুলনায় এখন নেই বললেই চলে।
এই হাওরে রয়েছে ১২ প্রজাতির উভচর, ৭০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। যার বিরাট একটি অংশ আজ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে উদ বিড়াল, মেছোবাঘ, বাগডাশসহ আরো কয়েকটি। এখানকার নদীগুলোতে এখনও মাঝে মধ্যে শুশুকের দেখা পাওয়া যায়। পরিবেশ অধিদফতরের হিসাবে ১২ প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে ১১ প্রজাতির কচ্ছপ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ধুম কাছিমের দেখা মিলছে না। তবে আরো দু-এক প্রজাতির কচ্ছপ থাকার সম্ভাবনা থাকলেও দীর্ঘ দিন ধরে তাদের কোন সন্ধান নেই। এ ছাড়া হাকালুকি হাওরে এক সময় ১০৭ প্রজাতির মাছ ছিল। এর মধ্যে টিকে আছে ৬৫ প্রজাতির মাছ আর বিলুপ্তির পথে রয়েছে ৩৪ প্রজাতির মাছ। এখনও হাকালুকি হাওরে জালে ধরা দেয় বিরল প্রজাতির মধু পাবদা, কালি বাউশ, রানী, বাঘা গুতুম, মেনী, কাকিলা, টেংরা, বাইম মাছ ইত্যাদি। অপর দিকে উকল-মাখনা, স্থলপদ্ম, লাল শাপলা, লাল সিঙ্গাইর, শতমূল, আকন্দ, প্যারাবহা, উলটকম্বল, মালাক্কা জাঙ্গি, পানি সরিষা উদ্ভিদ এখন রয়েছে বিপদসঙ্কুল অবস্থায়। কৃষিজমিতে আগাছানাশক, ছত্রাকনাশক, পতঙ্গ নিবারকের অবাধ ব্যবহার, অবৈজ্ঞানিক পন্থায় প্রাণী বিশেষ করে উভচর পাখি, সরীসৃপ প্রভৃতি নিধনে হাওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যের গুণাবলি হারাচ্ছে।
হাকালুকি হাওর এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকা
হাওর তীরবর্তী দারিদ্র্যপীড়িত কৃষক ও জেলে সম্প্রদায়ের দুঃখগাথা জীবন। প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতার ভেতর সংগ্রাম করে তাদের বেঁচে থাকতে হয়। জীবন-জীবিকা সর্বদাই থাকে হুমকির সম্মুখীন। একবেলা আহার জোগাতে দিনের সারা বেলা কোন না কোন কাজে গতর খাটাতে ব্যস্ত থাকতে হয়। সুখপাখি ধরার লক্ষ্যে নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয় প্রতিনিয়ত। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। ভাগ্যবিধাতা তাদের কষ্টকেই যেন সঙ্গী করে দিয়েছেন। ‘পেটে আহার নেই মাথায় চালাও নেই’ এ যেন হাওর এলাকার মানুষের নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস। সাত-আট জন সদস্য নিয়ে একই চালাঘরে বাস করে একাধিক পরিবার। জীবনের সকল চাওয়া-পাওয়াকে পেছনে ফেলে কোনভাবে বেঁচে থাকাটাই তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একটি অস্বস্তিকর পরিবেশে বেড়ে উঠছে তাদের আগামী প্রজন্ম। মুখে কথা ফোটার সাথে সাথে মা-বাবার সংসারের বিরাট দায়িত্ব নিতে হয় তাদের। পাঠশালার গন্ডি পেরিয়েছে এমন শিশুদের বের করা সত্যিই বিরাট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে ৯০ ভাগই কৃজিকাজের ওপর নির্ভরশীল। বাকিরা মৎস্য আহরণ, মৎস্য চাষ, ব্যবসা, চাকরি ও অন্যান্য পেশায় জড়িত। হাওরের ভূপ্রকৃতি যেমন আলাদা, তেমনি এ এলাকার জীবন-জীবিকাও অন্য এলাকা থেকে ভিন্ন।
সম্ভাবনার অফুরন্ত দিক বিবেচনায় এনে বেকার জনগোষ্ঠীকে একত্র করে দীর্ঘমেয়াদি দূরদর্শী পরিকল্পনা নিলে হাওর এলাকার বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শুধু ধান চাষ করার ওপর নির্ভর করলে চলবে না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এলাকার জনগোষ্ঠীকে কৃষি বহুমুখীকরণের সুযোগ করে দিতে হবে। বহুমুখী ব্যবহারের জন্য কৃষি বিন্যাস, ফার্মিং সিস্টেম, সমন্বিত বালাই দমন ও শস্য ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করতে হবে। হাওরে ধান রোপণ ও কর্তন উপোযোগী যন্ত্র দিতে হবে। বিদ্যুৎ বা বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে। বহুমুখী ব্যবহারের জন্য উঁচু ভিটা, কাটা ধান আনা- নেয়ার জন্য হালকা কিন্তু টেকসই পরিবহন এবং বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে দাদনের ছোবল থেকে এ দরিদ্রগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হবে। হাওরপাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির ফসলি গাছ রোপণ করত মৌসুমি শাক-সবজির বাগান করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগির খামার করতে অত্র এলাকার মানুষকে স্বাবলম্বী করতে সহযোগিতা করতে হবে। আর এসব বাস্তবায়ন করতে রাষ্ট্র, সরকার, দাতাসংস্থা ও এনজিও, প্রতিষ্ঠানকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে অভিজ্ঞ মহলে অভিমত।