শ্রীমঙ্গলে হাইল হাওরের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে: সঙ্ঘবদ্ধ প্রভাবশালীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে
সংগ্রাম দত্ত: মৌলভীবাজার জেলার চা অধ্যুষিত উপজেলা শ্রীমঙ্গল এবং মৌলভীবাজার সদর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃত বিস্তৃত এই হাইল হাওর।
ছোট-বড় অসংখ্য বিলের সমন্বয়ে জীব-বৈচিত্রে ভরপুর দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম হাইল হাওর। কালের পরিক্রমায় সেই বিলগুলো অনেকটা কমে গেছে। জেলার মৌলভীবাজার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজেলায় অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় হাইল হাওর আজ বিপন্ন।
সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব ও একশ্রেণীর প্রভাব প্রতিপত্তিশালী রাজনৈতিক নেতারা একশ্রেণীর দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে বিলগুলো ঘিরে গড়ে উঠেছে মৎস্য খামার। ফলে বিলীন হয়ে যাচ্ছে একের পর এক বিলগুলো ও দেশীয় প্রজাতির মাছ। শহরের ময়লা ও আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে জলের পরিবেশ। তাই হাজারও সমস্যায় জর্জরিত হাইল হাওরের অস্তিত্ব বিলীনের পথে। ফলে উৎকণ্ঠায় আছেন এই হাওরের উপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা।
একশ্রেণীর প্রভাবশালী মহল হাইল হাওরের চইড়া বিল দখল করে মৎস্য খামার করেছেন। চইড়া বিলে এখন হাইব্রিড মাছের ফিসারি গড়ে তোলা হয়েছে বলে জানা গেছে। হাইল হাওরের অধিকাংশ সরকারি বিলই এখন ব্যক্তিগত মৎস্য খামারে পরিণত হয়েছে।
এই হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় পড়েছে ১০ হাজার হেক্টর। এর ভেতরে বিল রয়েছে ৫৯টি। যার মধ্যে ২০ একরের নিচে ৩৯টি এবং ২০টি ২০ একরের ওপরে। অবশিষ্ট ৪ হাজার হেক্টর জলাভূমি মৌলভীবাজার সদর উপজেলায়। যার মধ্যে বিল রয়েছে ৫৫টি। এরই মধ্যে ১০ থেকে ১২ টির কোনও অস্তিত্ব নেই।
এই হাইল হাওর এতদাঞ্চলের মাছের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। হাইল হাওরের অধিকাংশ সরকারি বিলই এখন ব্যক্তিগত মৎস্য খামারে পরিণত হয়েছে।
বিলগুলো হাওরের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। অনেকের ব্যক্তিগত জমির সঙ্গে খাস জমিও পড়েছে। ভূমি দখলদারদের জন্য এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বিল সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়ে গেছে।
হাওরের বিলে প্রায় শত প্রজাতির দেশীয় মাছ পূর্বে পাওয়া যেত। বর্তমানে প্রায় ৩০ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই হাওরে এসে মিশেছে অর্ধশতাধিক ছড়া যা গোফলা নদীতে এসে পড়েছে। অনেকে সেই ছড়াগুলোও দখল করে নিয়েছে, নিচ্ছে। এতে পানিপ্রবাহ পরিবর্তন হচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়ছেন হাওরের বুরো চাষিরাও।
কথিত আছে একসময় ৩৫২ ছড়ার অস্তিত্ব ছিল এই হাইল হাওরে। কিন্তু ভূমি দখল করে মাছের খামারও ভরাটসহ বিভিন্ন কারণে সুপরিচিত এই হাইল হাওর এখন বিলীনের পথে। হাওরের ছোট-বড় মিলিয়ে ১৩১ টি বিলের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। ৩০টি বিলের কোনো হদিস নেই। এছাড়া ৩৫২ ছড়ার হাইল হাওরের দুই-তৃতীয়াংশ ছড়া (খালের মতো পানিপ্রবাহ) হারিয়ে গেছে।
সরকারি হিসাবে হাইল হাওরের আয়তন ১৪ হাজার হেক্টর। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর কর্মীরা বলছেন, বর্তমানে এই হাওরের প্রকৃত আয়তন ৭ হাজার হেক্টরেরও কম।
২০১৪ সালে হাইল হাওরে বাণিজ্যিক মাছ চাষের জন্য তৈরি পুকুরের আয়তন ছিল ৮৬৩ হেক্টর। বর্তমানে তা\' বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩শ হেক্টরে।
স্থানীয়দের মতে, বাস্তবে বাণিজ্যিক মাছ চাষের পুকুরের মোট আয়তন ৩ হাজার হেক্টর হবে।
১৯৮০ সালের পর থেকে বাণিজ্যিক মাছের খামার গড়ে উঠতে থাকে হাইল হাওরে। ২০০০ সালের পর থেকে এর ব্যাপকতা বাড়ে। হাইল হাওরে বাণ্যিজিক মাছ চাষ শুরুর পর থেকে মৎস্য খামারিরা গড়ে তুলছেন বিশাল বিশাল পুকুর।
জানা গেছে, সরকারি কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই একের পর এক মৎস্য প্রকল্প গড়ে তুলছেন এক শ্রেণীর সঙ্ঘবদ্ধ প্রভাবশালী মহল। খাসজমি দখল কিংবা ভূমিহীনদের নামে সরকারের বন্দোবস্ত দেওয়া জমি বিভিন্ন কৌশলে আয়ত্তে নিয়ে প্রভাবশালীরা গড়ে তুলছেন মৎস্য প্রকল্প। শস্য ও মৎস্য ভান্ডার খ্যাত হাইল হাওর।
প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও জীবন-জীবিকার বিবেচনায় স্থানীয়দের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এই জলাভূমি কিছু সংখ্যক প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিবর্গ দখল করে গড়ে তুলেছেন মৎস্য খামার।
অবৈধ দখল ও অপরিকল্পিত পুকুর খননে হাওর হারাচ্ছে তার অস্তিত্ব। ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র, জীববৈচিত্র্য পড়ছে হুমকির মুখে।
জানা গেছে, কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী মহল ভূমিহীনদের নামে লিজ নিয়ে জমিগুলো অল্প দামে কিনে বাকি ৯০ ভাগ সরকারি খাস জমিই ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তুলেছেন বাণিজ্যিক মাছের খামার । সম্পূর্ণ অবৈধভাবে অতীতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে সরকারি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। অবৈধভাবে হাওরের জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বাণিজ্যিক ফিশারি করার কারণে দিন দিন হাওর সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ।
এলাকার কৃষকরা গবাদি পশুর খাবার হিসেবে সংগ্রহ করতেন। কিন্তু এসব এখন আর তেমন একটা পাওয়া যায় না বললেই চলে। এই চিত্র শুধু চইড়া বিলে নয়, হাওরের অধিকাংশ বিলই এখন বাণিজ্যিক মৎস ফিশারিতে পরিণত হয়েছে। এই খাস জমির বেশ কিছু অংশ সরকার ভূমিহীনদের নাম দিয়েছেন। কিন্তু ভূমিহীনরা সেখানে যেতেই পারে না। বরং প্রভাব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিবর্গ সামান্য টাকায় ভূমিহীনের খাসজমি লীজের সেই কাগজ সংগ্রহ করে ও কৌশলে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো নিয়ে নেয়। পরে খাস জমিগুলোও তারা কৌশলে তাদের আয়ত্তে নিয়ে বাণিজ্যিক ফিশারি গড়ে তুলে ।
এই হাওরের হাজার হাজার একর বিলের ভূমি দখল করে ফিশারি করেছেন প্রভাবশালী একটি চক্র। ধনাঢ্য প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্টপোষকতায় দিনের পর দিন হাইল -হাওর গিলে গিলে খাচ্ছে।’ফলে হুমকির মুখে পড়ছে হাইল-হাওর, জীববৈচিত্র্য ।
হাইল হাওরের চারপাশে প্রায় ১০ হাজারের বেশি মৎসজীবি পরিবারের বসবাস। যেখানে বসবাসরত জনসংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি। ইতিমধ্যে মৎস্যজীবীদের অর্ধেকেরও বেশি জীবিকা পরিবর্তন করে অন্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন । তাছাড়া এ পেশা ছাড়ার অপেক্ষায় আছেন হাইল -হাওর অঞ্চলে বসবাসকারী কয়েক হাজার মৎসজীবি পরিবার ।
জানা যায় , হাইল হাওরের ১৩১টি বিলের মধ্যে ১০১টি বিল ইজারার রেকর্ড পাওয়া গেছে। বাকি ৩০টি বিলের কোনো হদিস নেই। আর যেগুলোর অস্তিত্ব আছে সেগুলোরও অধিকাংশই দখলে।‘দখল আর দৌরাত্ম্যে হাওর এখন এমন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এখন বিশাল হাওরে গবাদি পশুদের বিচরণের জন্য একটু টুকরো খালি জমি খোঁজে পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। এক সময় সরকারি খাস জমিগুলোতে কৃষকরা দলবদ্ধভাবে ধান মাড়াই করতেন। এখন সে সুযোগটিও নেই। সবই এখন দখলের কবলে । হাইল হাওরের পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি খাস জমি দখলমুক্ত এবং এর শ্রেণি পরিবর্তনকারীদের কঠোর আইনের আওতায় আনা অতীব জরুরি বলে অনেকের অভিমত।
শোনা যায়, একসময় হাইল হাওর ছিল প্রচুর গভীর ফলে একসময় এই হাইল-হাওর অঞ্চল দিয়ে প্রচুর জাহাজের চলাচল ছিল । শ্রীমঙ্গল উপজেলার শহরতলির উত্তর ভাড়াউড়ায় এলাকার হাওর অভিমুখে জেটি ছিল। সখনো এই স্থানটি জেটি রোড নামে সকলের কাছে পরিচিত ।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, জনস্বার্থে হাওর ও উন্মুক্ত জলাশয়কে রক্ষা করতে হবে। জলাভূমি দখল করে ফিসারি তৈরি করা প্রভাবশালীদের কঠোভাবে দমন করতে হবে। একইসঙ্গে হাইল হাওরে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা শতভাগ বন্ধ করতে হবে। তা না হলে সামনে বড় রকমের বিপর্যয় ঘটবে।।
পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে এখনই হাইল হাওরের বিলগুলো খনন করা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি পাহাড়ি ছড়ার নিচের অংশ খনন করে গোফলা পর্যন্ত পানি চলাচলের পথ পরিষ্কার করে হাই হাউ আর কে দেশ জাতি ও পরিবেশের জন্য রক্ষা করা উচিত।
ইতোপূর্বে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় হাইল হাওর দখলের বিষয়ে খবর বেরিয়েছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা হাইল হাওর পরিদর্শনক্রমে এসে অভিযান চালিয়ে দখলমুক্ত করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে হাওড়াঞ্চলের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়কে জীবন জীবিকা, প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য হাইল হাওর এ যাবৎ দখল মুক্ত হয়নি।