
ঝড়ের সন্ধিক্ষণে!

রেজুয়ান আহম্মেদ
মনের ভেতর যেন এক অদ্ভুত ঝড়ের খেলা চলছে। প্রতিটি অনুভূতির ঝাপটা, প্রতিটি ভাবনার ঢেউ মনে এমনভাবে আছড়ে পড়ে, যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কী চাই? কী নিয়ে ভাবছি? উত্তর নেই। স্বপ্নগুলো দূরে চলে যায়, ঠিক যেন মেঘের মতো—ধরা দিতে চায় না, আবার মিলিয়ে যেতে থাকে।
এটি ছিল অর্ণবের জীবনের সন্ধি বয়স। এই সময়টাতে সব কিছুই যেন নতুন। চোখের সামনে ধরা দেয় এক নতুন পৃথিবী। কখনো হাসি, কখনো কান্না, কখনো উত্তেজনা আর কখনো বিরক্তি—সবকিছুই যেন এক অদ্ভুত মিশ্রণ। অর্ণবের ভাবনাগুলো জলে ভাসমান নৌকার মতো দিকভ্রান্ত।
স্কুল থেকে ফিরেই অর্ণব সোজা ছাদে চলে যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশ তাকে খুব টানে—বিশাল, মুক্ত আর রহস্যময়। কিন্তু আজ যেন আকাশটাও তাকে শান্তি দিতে পারছে না। কিশোর মনে হাজারো প্রশ্ন। পথের শেষে কী আছে? এই জীবন, এই পৃথিবী—সবকিছু কেন এমন?
সেদিন সন্ধ্যায় অর্ণব ছাদের কোণায় বসে ছিল। হালকা বাতাস বইছিল। দূরে কুকুরের ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ তার মনে হলো, কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকছে। ভয় পেয়ে চারপাশে তাকালো, কিন্তু কেউ নেই। এই প্রথমবারের মতো অর্ণবের মনে হলো, সে একা নয়।
সেই অদ্ভুত অনুভূতির পর থেকেই অর্ণবের দিনগুলো বদলে যেতে থাকে। তার মনের ঝড় আরও জোরালো হয়ে ওঠে। তার ভেতর যেন কিছু খুঁজে পাওয়ার একটা অস্থিরতা ছিল। একটা উত্তর, একটা আশা—কিন্তু সে জানে না ঠিক কী।
একদিন ক্লাসের পর অর্ণব লাইব্রেরিতে গিয়েছিল। বইয়ের র্যাকে হাত ঘোরাতে ঘোরাতে একটি বইয়ে হাত থেমে গেল। বইটা তুলতে গিয়ে দেখে পাশে মিতা দাঁড়িয়ে। মিতা, ক্লাসের সবচেয়ে চঞ্চল মেয়ে। অর্ণব তাকে খুব একটা পছন্দ করত না। কিন্তু আজ মিতার চোখের দিকে তাকিয়ে অর্ণবের মনে হলো, এই মেয়েটাও হয়তো তার মতো কিছু অনুভব করে।
মিতা বলল, “তোমার কি কখনো মনে হয়েছে, আমাদের চারপাশে যা আছে, তার বাইরেও কিছু আছে? যা আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু অনুভব করতে পারি?”
অর্ণব একটু থমকে গিয়ে বলল, “হয়তো। তবে সেটা কী, জানি না। তোমার কী মনে হয়?”
মিতা বলল, “মনে হয়, আমাদের মধ্যে একেকজন একেকভাবে সেই উত্তর খুঁজছে। আমরা কেউ বুঝি, কেউ বুঝি না।”
সেদিন থেকে মিতা আর অর্ণবের বন্ধুত্ব শুরু হলো। দু’জন মিলে সন্ধ্যায় আকাশের নিচে বসে কত কথা বলত। মিতা কখনো গল্প শোনাত, কখনো নিজের ভাবনার কথা বলত। অর্ণব ধীরে ধীরে তার মনের ঝড়টাকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগল।
মিতা তাকে একদিন বলল, “তুমি জানো, আমাদের স্বপ্নগুলো কখনো আসলেই দূরে চলে যায় না। তারা আড়াল থেকে আমাদের দেখছে। আমরা যদি তাদের ডাকি, তারা ফিরে আসে।”
অর্ণব মিতার কথা শুনে মৃদু হেসে বলল, “তুমি কেমন করে এত গভীর কথা ভাবো? আমার তো কখনো কিছুই বুঝি না। শুধু মনে হয়, কিছু একটা খুঁজছি, যা কোনো দিনই পাব না।”
দিনগুলো আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছিল। মিতা অর্ণবকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবনকে দেখতে শেখাচ্ছিল। একদিন মিতা তাকে একটি খাতার পাতা বাড়িয়ে দিল। পাতায় লেখা ছিল:
“পথের শেষে আলো আছে,
যদি খুঁজে পেতে চাও।
নিজেকে বুঝতে হলে,
নিজেকে খুঁজতে যাও।”
অর্ণব সেই কথাগুলো পড়ে অনেকক্ষণ ভাবল। সে বুঝতে পারল, তার জীবনের ঝড়গুলো হয়তো তাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যই উঠেছে।
অর্ণবের মনের ঝড় থেমে গেল না, তবে তার গতিপথ বদলে গেল। এখন আর অর্ণব শুধু উত্তর খোঁজে না; সে প্রশ্ন করতেও ভালোবাসে। মিতা তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের দরজা খুলে দিয়েছিল। ঝড়ের মাঝে দাঁড়িয়েও সে বুঝতে পেরেছিল, জীবনের আসল সৌন্দর্য হলো সেই ঝড়কে আলিঙ্গন করা।
আর সেই ঝড়ই একদিন অর্ণবকে নিজের আলোয় পৌঁছে দেবে।