img

ধর্মের স্থান ধর্মেই থাকুক!

প্রকাশিত :  ১৮:৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

ধর্মের স্থান ধর্মেই থাকুক!

রেজুয়ান আহম্মেদ

ধর্ম মানুষের আত্মার শক্তি, অন্তরের শান্তি এবং নৈতিকতার পথপ্রদর্শক। এটি আমাদের জীবনে মানবিকতা ও মূল্যবোধের আলো জ্বালায়। কিন্তু যখন ধর্মকে তার পবিত্র আসন থেকে সরিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, তখন তা মানবতার জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

ধর্ম আমাদের শিক্ষা দেয় ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধা।

ইসলামে বলা হয়েছে, “মানুষের সেবা আল্লাহর সেবার সমান।”

হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে, “সবাইকে এক চোখে দেখো, কেউই পৃথক নয়।”

খ্রিস্টধর্ম শিক্ষা দেয়, “প্রেম করো, ঘৃণা নয়।” কিন্তু আমরা কি সেই শিক্ষাগুলো সত্যিই হৃদয় দিয়ে মানি? আজকের দিনে আমরা প্রায়ই দেখি, ধর্মের নামে বিভাজন তৈরি করা হয় এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক চক্রান্ত।

রাজনীতির ময়দানে ধর্মকে টেনে নিয়ে আসা মানে শুধু ধর্মের অপমানই নয়, বরং মানুষের অনুভূতিকে অসম্মান করা। এই প্রতারণা আমাদের সমাজে ঘৃণা, সহিংসতা এবং বিভেদের বীজ বপন করে। ধর্মকে পবিত্র রাখতে হলে তা মানুষের আত্মায় স্থির রাখতে হবে, রাজনীতির হাতে নয়।

কীভাবে ধর্মকে সুরক্ষিত রাখা যায়?

১. সচেতনতা বাড়ানো: ধর্মের প্রকৃত বার্তা এবং মানবিক শিক্ষাগুলো সমাজে প্রচার করতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে, ধর্ম কোনো বিভেদের হাতিয়ার নয়, বরং এটি একতার প্রতীক।

২. রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ রোধ করা: রাজনীতিবিদদের উচিত ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা।

৩. মানবিক মূল্যবোধের চর্চা: সমাজে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে ধর্মের মূল উদ্দেশ্য শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হয়।

ধর্মকে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে সম্মান করতে চাই, তবে তা মানুষের অন্তরে রাখতে হবে। ধর্মের আসল বার্তাগুলো আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের উচিত নিজ নিজ ধর্মের সহিষ্ণুতা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা করা।

আমরা কি এমন এক সমাজ চাই, যেখানে ধর্ম হবে বিভেদের কারণ? নাকি এমন একটি সমাজ চাই, যেখানে ধর্ম হবে একতার মূর্ত প্রতীক, শান্তি ও ভালোবাসার বার্তা নিয়ে আসবে?

আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি প্রতিজ্ঞা করি—ধর্মকে তার স্বাভাবিক ও পবিত্র অবস্থানে রাখি। রাজনীতির কলুষিত হাত থেকে ধর্মকে রক্ষা করি। কারণ ধর্মের আসল কাজ হলো আলোর পথ দেখানো, অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া নয়।

“ধর্মের আলো জ্বালুক শান্তির প্রদীপ, বিভেদের নয়।”


রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম
img

ভার্চুয়াল ওমরাহ!

প্রকাশিত :  ০৫:৪৩, ১৩ মে ২০২৫

প্রথম আলোর ভোরের মতোই নিঃশব্দে একদিন বাচ্চু মিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় আবির্ভূত হয়েছিল। একসময় সে ছিল অচেনা এক মুখ—মাঝারি মানের বক্তা, যার ভিডিওতে লাইক পড়ত সীমিত সংখ্যায়। কিন্তু হঠাৎই সে বদলে গেল। ফেসবুক-ইউটিউবের গণ্ডি পেরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল গ্লোবাল ‘হুজুর ইনফ্লুয়েন্সার’ হিসেবে। আজ সে শুধু বক্তা নয়, উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক, আর কেউ কেউ বলে—‘ঈমানের ডিজিটাল বিপণনকারী’!  

তার নতুন উদ্যোগের নাম—‘উম্মাহ ট্যুর’। প্রথমে শুনলে মনে হতে পারে এটি কোনো পর্যটন সংস্থা। কিন্তু না, এটি একধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সরবরাহকারী। তাদের দেওয়া ‘ওমরাহ প্যাকেজ’-এ পাসপোর্ট, ভিসা বা ফ্লাইট টিকিটের প্রয়োজন নেই। শুধু একটি স্মার্টফোন আর ‘খাঁটি নিয়ত’ থাকলেই চলবে! বাচ্চুর কথায়, ‘ভাই ও বোনেরা! জান্নাত এখন হাতের মুঠোয়, মোবাইলের স্ক্রিনে তাওয়াফ করলেই হজ আদায়!’  

ইউটিউবে লাইভে বাচ্চুর প্রথম আবির্ভাব ছিল ব্যতিক্রমী আয়োজন। ঝকঝকে টুপি, কাবা শরিফের এইচডি ব্যাকগ্রাউন্ড, আর মিষ্টি কণ্ঠে আহ্বান: ‘আমার ভাই ও বোনেরা! যারা জীবনে হজ করতে পারেননি, তাদের জন্য জান্নাতি ডিসকাউন্টে ভার্চুয়াল ওমরাহ প্যাকেজ!’ দর্শকদের চোখ ছানাবড়া। কীভাবে সম্ভব? বাচ্চুর ব্যাখ্যা: মোবাইলে কাবার ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও চালু করুন, আঙুলে ঘোরান স্ক্রিন। নিয়ত খাঁটি হলে সাত চক্করে আমল সম্পন্ন!  

কমেন্টবক্সে একের পর এক প্রশ্ন: ‘ভাই, ফোনের স্ক্রিন ছোট হলে তাওয়াফ ঠিক হবে?’ বাচ্চুর উত্তর: ‘নিয়ত বড় হলেই সব কবুল, স্ক্রিন ছোট হলে গুনাহ নেই!’ অন্য জিজ্ঞাসা: ‘তাওয়াফ করতে ফোন গরম হয়ে গেলে?’ বাচ্চুর মজাদার জবাব: ‘ফ্যানের নিচে বসুন। ফোন গরম, নিয়ত ঠাণ্ডা থাকলেই চলবে!’  

এরপর আসে প্যাকেজের বিবরণ। প্রিমিয়াম ভার্সন ৯৯৯ টাকায় মিলবে লাইভ হুজুরের গাইডেন্স—‘এখন আপনি হাজরে আসওয়াদের সামনে...’ ইকোনমি ভার্সন ২৯৯ টাকায় ভিডিও ডাউনলোড করে অফলাইনে আমল। বাড়তি সুবিধা: নফল নামাজের অডিও গাইড, যাতে নামাজে ‘কষ্ট’ না হয়!  

আরো আছে বোনাস! কমেন্টে ‘আমি জান্নাত চাই’ লিখলেই মিলবে বাচ্চুর বিশেষ ভিডিও মেসেজ—‘তুমি জান্নাতের যোগ্য, মাশাআল্লাহ!’ সাথে ফ্রি ‘জান্নাতি সুরা বুকমার্ক’—ইসলামি বইয়ে রাখলে ঈমানি অনুভূতি বাড়বে!  

এই উদ্যোগে হতভম্ব ঢাকার হজ দালালরা। পুরান ঢাকার জাফর ভাই, দশ বছরের অভিজ্ঞ হজ এজেন্ট, কফিশপে বললেন: ‘এ কী হুজুর! মোবাইলে হজ করায়?’ পাশের বন্ধু ঠাট্টা করল: ‘আপনি প্রথাগত, বাচ্চু ডিজিটাল। আপনার হজ কষ্টসাধ্য, ওরটা ক্লিকসাধ্য!’  

বাচ্চুর ‘উম্মাহ স্টুডিও’ অ্যাপে এখন ইসলামি ফিল্টার। ইনস্টাগ্রামে সেলফি তুললেই অটো-ক্যাপশন: ‘ইয়া আল্লাহ, হেদায়েত দাও!’ টিকটকে ভিডিও পোস্ট করলে স্ক্রলে ভেসে উঠবে: ‘দুনিয়ার ধুলোয় ঢেকে থাকলেও জান্নাতে ঝলমকে হবো!’ এক অদ্ভুত ধর্মীয় ইনফ্লুয়েন্স!  

আন্তর্জাতিক সফরে প্লেনে উঠেই বাচ্চু লাইভ শুরু করে: ‘ভাই ও বোনেরা! প্লেন উঠছে, যেমন আমরা জান্নাতে উঠব। সবাই বলুন—সুবহানাল্লাহ!’ যাত্রীরা প্রথমে অবাক, পরে জিকিরে মগ্ন। এয়ার হোস্টেসের প্রশ্ন: ‘স্যার, জিকিরের জন্য অ্যাপ লাগবে?’ বাচ্চুর হাসি: ‘না বোন, নিয়তই যথেষ্ট!’  

এরপর ‘হালাল হোটেল’ চালু—মেনুতে ‘ঈমান এক্সপ্রেসো’, ‘তাকওয়া টোস্ট’, আর ‘সুরা হালিম’! এক গ্রাহকের মন্তব্য: ‘হালিম খেয়ে মনে হলো জান্নাতের ট্রায়াল ভার্সন পেলাম!’ এমনকি বিয়ের প্যাকেজও: ‘হালাল বিয়ে, হাই রেজুলেশনে!’ কমেন্টে কেউ লিখল: ‘এই জুটি নিশ্চয় জান্নাতের টিকিট পাবে!’  

সবশেষে ঘোষণা: ‘খুলছি উম্মাহ ট্যুর ইন্টারন্যাশনাল! দুনিয়ার সব গুনাহের দোকানে তালা দিয়ে জান্নাতি প্যাকেজ আনব!’ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখা: ‘জান্নাত এখন গুগল ম্যাপে। নিয়ত দিয়ে সার্চ করুন!’  

বাচ্চু মিয়া—একজন বিপণনকারী, বক্তা, উদ্যোক্তা, প্রযুক্তিবিদ, আর ঈমানের ডিজিটাল দূত। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়: এটা ঈমানের নবজাগরণ নাকি কনটেন্ট-বেসড বাণিজ্যিক ছলনা?  

যেখানে ধর্মের স্থান হওয়া উচিত ছিল আত্মিক অনুশীলনে, সেখানে তা পরিণত হচ্ছে বাণিজ্যের হাতিয়ারে। বাচ্চু মিয়াদের কর্মকাণ্ড যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—ধর্ম এখন পণ্য! হয়তো এর মাধ্যমে কেউ ঈমানের পথ পাবে, কিন্তু যদি এটা শুধু প্রযুক্তি ও মুনাফার খেলায় পরিণত হয়, তবে ভাবনা জাগে: আমরা কি ঈমানের ‘মোবাইল ভার্সনে’ ঢুকে পড়েছি?  

জান্নাত কী এখন অ্যাপে কেনার পণ্য? এই প্রশ্ন আজ সমাজ, চিন্তা আর আত্মার দরজায় জোরালো আঘাত করছে।