img

যৌনতা এবং শারীরিক চাহিদা থেকে জীবনের পরিধি আরও অনেক বড় – এ আর রহমানের আত্মোপলব্ধি

প্রকাশিত :  ০৭:৩২, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ০৮:১১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

যৌনতা এবং শারীরিক চাহিদা থেকে জীবনের পরিধি আরও অনেক বড় – এ আর রহমানের আত্মোপলব্ধি

রেজুয়ান আহম্মেদ

অস্কারজয়ী সঙ্গীতশিল্পী এ আর রহমান, যিনি পৃথিবীকে সুরের মাধ্যমে নতুনভাবে চিনিয়েছেন, সম্প্রতি নিজের জীবনের এক অদেখা অধ্যায় প্রকাশ্যে এনেছেন। সায়রা বানুর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের পর, এক দীর্ঘ নীরবতার শেষে রহমান তাঁর ব্যক্তিগত যাত্রা সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে জীবনের উদ্দেশ্য এবং মানবিক সম্পর্কের মধ্যে শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার সীমা থাকে না; জীবনের পরিধি আরও অনেক বড় এবং গভীর।

তিনি তাঁর একটি বক্তব্যে বলেন, ‘‘যৌনতার মতো শারীরিক চাহিদা মেটানোই জীবনের সব নয়, কখনও…’’ তাঁর এই উক্তি শুধু একটি সঙ্গীতশিল্পীর দৃষ্টিকোণ নয়, বরং একটি জীবনদৃষ্টি, যেখানে আত্মিক পরিপূর্ণতা এবং মানসিক শান্তি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। রহমানের মতে, আমাদের জীবনে একটি গভীর শূন্যতা রয়েছে, যা শুধুমাত্র শারীরিক সুখ দ্বারা পূর্ণ হতে পারে না। আমাদের আধ্যাত্মিক বা মানসিক উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত, যা জীবনকে অর্থবহ এবং পূর্ণতা দেয়।

প্রায়ই সমাজে যৌনতা এবং শারীরিক সম্পর্ককে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু রহমানের অভ্যন্তরীণ জগতের এই খোলামেলা উক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের জীবনের অঙ্গনের অনেক বৃহৎ ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে আনন্দ, শান্তি এবং পূর্ণতা আসতে পারে। ‘‘শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদা মেটানোই জীবনের সব নয়’’—এই কথায় তিনি একদিকে যেমন জীবনের উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করছেন, তেমনি মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বও তুলে ধরছেন।

এ আর রহমানের মতে, একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য তখনই ভালো থাকতে পারে, যখন সে জীবনের গভীরে প্রবাহিত হতে পারে। তিনি বলছেন, ‘‘অবসাদ ঘিরে ধরে, কারণ আমার মনে হয়, আমাদের সবার মধ্যেই একটা শূন্যতা রয়েছে।’’ এরই মধ্যে গল্পকাররা, দর্শন, বিনোদন, এমনকি কখনও কখনও ওষুধের মাধ্যমে এই শূন্যতা পূর্ণ করা যায়। কিন্তু জীবনের উদ্দেশ্য সেই সব জিনিসে সীমাবদ্ধ নয়।

এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, রহমানের ব্যক্তিগত জীবনের অধ্যায়গুলো। তাঁর স্ত্রী সায়রা বানুর সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একটি অন্তর্দৃষ্টি দেয়, যে যেখানে তিনি তাঁর শূন্যতা, দুঃখ এবং সঙ্কটের মধ্যে থেকেও জীবনের একটি বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ খুঁজে পেয়েছেন। ‘‘এমনকি ভগ্ন হৃদয়ের ভারে ঈশ্বরের সিংহাসনও কেঁপে উঠতে পারে’’—রহমান তাঁর নিজের দুঃখ এবং সংগ্রামকে পৃথিবীর বৃহত্তর দুঃখের সঙ্গে তুলনা করছেন, যেখানে ক্ষতি এবং হতাশা একে অপরকে অনুসরণ করে। তবুও, তিনি এই ভঙ্গুরতার মধ্যে জীবনের অন্য অংশগুলির জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

এ আর রহমানের এই বক্তব্যে প্রতিটি মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রশংসা করা হয়েছে—মানসিক শান্তি, আত্মিক উন্নতি, এবং অন্যের জন্য বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। তিনি বলেছেন, ‘‘যখন তুমি অন্যের জন্য বাঁচবে, তখন তোমার মধ্যে এই চিন্তাগুলি আসবে না।’’ এর মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে জীবনকে শুধুমাত্র নিজের সুখের জন্য না, বরং একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বাঁচার পরামর্শ দিয়েছেন। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এমন একটি নৈতিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া উচিত, যা শুধুমাত্র আমাদের শারীরিক চাহিদা পূরণে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের আধ্যাত্মিক এবং মানসিক উন্নতি, আমাদের জীবনের বাস্তব মূল্যমানের পরিচয় দেয়।





রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম
img

নতুন প্রজন্মকে মানবিক মূল্যবোধের দিকে পরিচালিত করতে হবে

প্রকাশিত :  ১৮:৩৬, ২০ নভেম্বর ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ২০:৩৭, ২০ নভেম্বর ২০২৪

রেজুয়ান আহম্মেদ

মানব সভ্যতা যখন জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে অগ্রসর হচ্ছে, তখন এক অশনি সংকেতের মতো অন্ধকার যেন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সভ্যতার এই মহাসমুদ্রে, যেখানে প্রযুক্তি, বিজ্ঞানে উদ্ভাবন এবং মানবিক উন্নতির পতাকা উড়ছে, ঠিক সেখানে যেন এক বিষণ্ণ বাস্তবতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এক ধরনের অজ্ঞতার, অসচেতনার অন্ধকার, যা আমাদের সভ্যতার সফলতার প্রতিচ্ছবির সঙ্গে বিরোধিতা করছে। অতীতে যে মানবিকতা আমাদের অগ্রগতির প্রধান শক্তি ছিল, আজ সে নিজেই যেন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এমন একটি সময় আসছে, যখন সভ্যতার অগ্রগতি নিজেই যেন মানবিকতার গতি হারিয়ে ফেলছে।

আজকের সমাজে, মানবিকতার যে গৌরবময় ইতিহাস একসময় আমাদের আলোড়িত করেছিল, তা আজ এক নতুন আকারে পরিবর্তিত হয়েছে। যে মানবিক মূল্যবোধ একদিন পৃথিবীকে সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও সৃজনশীল করে তুলেছিল, তা যেন আজ কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। মানবিকতার আগুন একসময় যেখানে পৃথিবীকে উজ্জ্বল করত, আজ সেই আগুন যেন নিভে যাওয়ার উপক্রম। যতই সভ্যতা উন্নতির শিখরে পৌঁছাচ্ছে, ততই মানুষের মধ্যে মানবিক সহানুভূতি, ভালোবাসা, ও শ্রদ্ধা হারিয়ে যাচ্ছে।

আজ আমরা যে পৃথিবীতে বাস করছি, সেখানে মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের যে নিঃশব্দ সঙ্কোচ শুরু হয়েছে, তা এক অস্বস্তিকর সংকেত। একসময় মানুষ অপরের কষ্টে সহানুভূতিশীল ছিল, কিন্তু আজ সে সহানুভূতি ক্রমেই কমে যাচ্ছে। যে সমাজ একসময় সম্পর্কের বন্ধনে শক্ত ছিল, আজ সেই সম্পর্কগুলো যেন কোনো এক অজানা কারণে ভেঙে পড়ছে। বিবাহ বিচ্ছেদের হার যেন বেড়ে চলেছে, বন্ধুত্বের স্থায়ীত্ব কমছে, আর একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা যেন কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দূরে সরে যাচ্ছে।

যখন আমরা দেখি সমাজে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটছে, তখন প্রশ্ন আসে: এই পরিবর্তন কি শুধুমাত্র বাহ্যিক, নাকি এর পেছনে একটি গভীর তাত্পর্য রয়েছে? আমরা কি হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সেই মানবিক গুণাবলী, যা একসময় আমাদের সম্পর্কগুলোকে শক্তিশালী করে তুলেছিল? সভ্যতার গতি বেড়েছে, কিন্তু কি আমরা মনুষ্যত্বের গতি হারিয়েছি? যখন সামাজিক সংহতি, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সমঝোতা, ও বিশ্বাসের ভিত্তি সঙ্কুচিত হচ্ছে, তখন কী আমাদের মধ্যে কেবল বাহ্যিক উন্নতি থেকেই যাবে, নাকি অন্তর্দৃষ্টি ও মানবিক সম্পর্কের সুস্থতা আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারব?

আমরা যখন সমাজের দিকে তাকাই, দেখি আধুনিক প্রযুক্তি, ডিজিটাল যোগাযোগের মাধ্যম, এবং সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটগুলির প্রভাবে আমাদের জীবন হয়ে উঠছে আরও সংকীর্ণ। একসময় যেখানে মানুষ মুখোমুখি কথা বলত, এখন সেখানে স্ক্রিনের মাধ্যমে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। সম্পর্কের সঙ্গতি এবং মানবিক স্পর্শের অনুভূতি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ নিজেদের মনের গভীরতা আর শেয়ার করতে পারছে না, এবং সেগুলো যেন শুধু বাহ্যিক প্রয়োজনে পরিণত হচ্ছে।

তবে, এই পরিবর্তন কি চিরকাল থাকবে? আমাদের কি মানবিকতার এই অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থাকতে হবে? না, এই সময়েই আমাদের নিজেদের দিকে তাকাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, একটি সমাজের উন্নতির পেছনে যে মানবিক গুণাবলী রয়েছে, তা কখনোই বাহ্যিক উন্নতির থেকে বড় হতে পারে না। আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যে বিশ্বাস, ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং সম্মান ছিল, তা ফিরে আনতে হবে। মানবিক সংহতি ও সম্পর্কের ভিত্তি নতুন করে শক্তিশালী করতে হবে।

এটা শুধুমাত্র সামাজিক পরিবর্তন নয়, এটি আমাদের মন ও মনোভাবের পরিবর্তনও। মানবিক সম্পর্কের সেই গভীরতা আর মানসিকতা পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তখনই আমরা পৃথিবীকে পুনরায় মানবিকতার আলোকবর্তিকা দিয়ে পূর্ণ করতে পারব, যা একদিন আমাদের অন্ধকারের কষ্টকে দূর করতে পারে।

সমাজের আড়ালে থাকা একেবারে ক্ষুদ্র, অনুভূতির নিঃশব্দ সংকট আজ বাস্তবতা হয়ে উঠেছে, এবং আমাদের জন্য এটি একটি সময়ের দাবী। আমাদের এই সংকটকে অতিক্রম করতে হবে, মানবিক সম্পর্কের পুনর্গঠন করতে হবে, এবং নতুন প্রজন্মকে আবার সেই মানবিক মূল্যের দিকে পরিচালিত করতে হবে। তবেই আমাদের সভ্যতা, আমাদের জীবন, আর সম্পর্কগুলো নতুন এক আলোয় পূর্ণ হবে, যা একদিন পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করবে।

রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম

মতামত এর আরও খবর