
"প্রবাহমান নদীর পাশে বসে অজু করলেও প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা যাবেনা"

\"একদিন রাসুল (সাঃ) দেখলেন, একজন সাহাবি অজু করার সময় অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করছেন। তিনি তাঁকে প্রশ্ন করলেন, এমন কেন করছো? প্রতি উত্তরে সাহাবি জানতে চাইলেন- \"হে রাসুল (সাঃ) অজু করার সময়ও কি একটু বেশি পানি ব্যবহার করা যাবে না?\" উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন, \"নাহ, করা যাবেনা। এমনকি যদি তুমি প্রবাহমান নদীর পানি দিয়েও অজু করো। (সুত্র: ইবনে মাজাহ)।
অজু করার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার ও অপচয় প্রসঙ্গে রাসুল (সাঃ)-এর উপরোক্ত হাদীসটি জুমার খুতবায় উদ্বৃত করেন ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম ও খতীব শায়খ আব্দুল কাইয়ুম। ২৯ নভেম্বর শুক্রবার জুমার খুতবায় তিনি ফেইথ ইন এনভায়রনমেন্ট (ধর্মের আলোকে পরিবেশ) বিষয়ে খুতবা দেন।
তিনি বলেন, আমরা ইস্ট লন্ডন মসজিদে ফেইথ ইন এনভারনমেন্ট বা ধর্মের আলোকে পরিবেশ বিষয়ে বিভিন্ন প্রচার প্রচারণা অব্যাহত রেখেছি। এই প্রচার প্রচারনায় পানির অপচয় রোধকে আমরা অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার হিসাবে দেখছি। তাই আজকের খুতবায় আমি অজু এবং পরিবেশের মধ্যকার সুন্দর সংযোগ নিয়ে আমার কিছু চিন্তাভাবনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। এটি এমন একটি বিষয় যা সারা বিশ্বে দিন দিন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
তিনি বলেন, অজু আমাদের ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা নামাজের প্রস্তুতি ছাড়াও আরো অনেক কিছু বহন করে। আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) অজুকে উচ্চ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন, আমাদের শিক্ষা দিয়ে বলেছেন, \"পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক\" (সহীহ মুসলিম)। তিনি আমাদের সুসংবাদ দিয়েছেন যে, যারা নিয়মিত অজু করেন কিয়ামতের দিন তাদের শরীরের ধোয়া অংশগুলো বিশেষ এক আলোর মাধ্যমে আলোকিত হবে—তাদের মুখ হবে দীপ্তিমান, তাদের হাত হবে ঝলমলে এবং তাদের পা হবে জ্যোতিময় (সুত্র: সহীহ বুখারি ও মুসলিম)।
তিনি বলেন, সঠিক নিয়মে অজু করার পুরস্কার অনেক বড় । সহীহ মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদিসে নবী (সাঃ) বলেছেন, যখন কেউ সতর্কতার সাথে অজু করে, তার শরীরের প্রতিটি অংশ থেকে পাপ দূর হয়ে যায়, এমনকি নখের নিচ থেকেও।
বাড়িতে অজু তৈরি করে মসজিদে যাওয়া একটি বিশেষ ফজিলত বহন করে। নবী (সাঃ) বলেছেন, (মসজিদের পথে হেঁটে যাওয়ার সময়) একটি পা পাপ মোচন করে এবং অন্য পা জান্নাতে মর্যাদা বৃদ্ধি করে\"। এছাড়াও, তিনি (রাসুল সাঃ) আমাদের শিখিয়েছেন যে, যারা ঘরে অজু করে মসজিদে যায় নামাজের জন্য, তাদের জন্য বিশেষ পুরস্কার রয়েছে (সহীহ মুসলিম)।
এটি লক্ষণীয় যে, (নবী সাঃ) মাত্র ৬৫০ গ্রাম (এক মুদ) পানি ব্যবহার করে অজু সম্পন্ন করতেন এবং গোসলের জন্য এক সা\' অর্থাৎ ২.৬ লিটার পানি ব্যবহার করতেন । এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন আমরা অজু করার সময় টেপ ছেড়ে রেখে প্রচুর পানি অপচয় করি। মসজিদের অজুখানায় আমরা প্রায়ই দেখি, পানির টেপ ছেড়ে দেওয়ার পর পুরো গতিতে পানি পড়তে থাকে, কখনও কখনও কয়েক মিনিট ধরে পানি পড়তে থাকে। এই অভ্যাস আমাদের ধর্মীয় শিক্ষা এবং পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্বের বিপরীত।
পবিত্র কুরআনে আমাদেরকে অপচয় সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সতর্ক করা হয়েছে: সূরা আল-আরাফের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন \"অপচয় করো না; নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না\"
এটি আমাদের প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিশেষ করে অজু করার সময় পানির ব্যবহারের ক্ষেত্রে । যখন আমরা দেখি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ মানুষ পরিষ্কার পানির অভাবে ভুগছেন, তখন পানির সংরক্ষণ আমাদের জন্য আরও জরুরী হয়ে পড়ে।
অজুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মিসওয়াক ব্যবহার । রাসুল (সাঃ) বলেছেন, \"যদি আমার উম্মতের জন্য এটি কষ্টদায়ক না হতো, তবে আমি তাদের প্রতি ওয়াক্তের নামাজের জন্য মিসওয়াক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতাম\" (সহীহ আল-বুখারি)। এই সুন্নাহ কেবল মৌখিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে না, বরং নামাজের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাও বাড়িয়ে তুলে।
যারা সঠিক পন্থায় অজু করে পানি ব্যবহারে সচেতন থাকে, তাদের জন্য একটি বিশেষ দোয়া রয়েছে। অজু সম্পন্ন করার পর রাসুল (সাঃ) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন এই দোয়া পড়তে: \"আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শরীকা লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু।\" রাসুল (সাঃ) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, যে কেউ সঠিকভাবে অজু করে এই দোয়া আন্তরিকভাবে পড়বে, জান্নাতের আটটি দরজা তার জন্য খুলে দেওয়া হবে (সহীহ মুসলিম)।
আমাদের মসজিদে, আমরা মুসল্লিদের অজুর সময় পানি ব্যবহারে যত্নবান হতে বাস্তবমুখী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। পানি সাশ্রয়ী টেপ স্থাপন করেছি এবং পানি অপচয় রোধের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য অজুর স্থানগুলোতে নোটিশ দিয়েছি। এই প্রচেষ্টা আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব এবং পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্বের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
আসুন, আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই শিক্ষাগুলো চর্চা করি। আমরা যেন অজুকে পরিপূর্ণ করতে পারি এবং একইসাথে পানি ব্যবহারে যত্নবান হতে পারি। এভাবেই আমরা আল্লাহর সৃষ্টির যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে আমাদের ঈমান এবং দায়িত্ব উভয়কে পালন করতে পারি। প্রতিটি বাঁচানো পানির ফোঁটা আমাদের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একেকটি পদক্ষেপ।
আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে ভেতর ও বাইরের দিক থেকে পরিশুদ্ধ মানুষের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তাঁর অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণের প্রচেষ্টাগুলো কবুল করেন । আমিন।