
মাধ্যমিক শিক্ষায় অচলাবস্থা

শিক্ষা ভবন হিসেবে পরিচিত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সারাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা স্তরের সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে । অথচ গত তিন মাস প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক পদ শূন্য। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকছে। ভোগান্তি বেড়েছে সারাদেশের লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর। মাউশির একজন পরিচালককে মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি গত সরকারের আমলে নিযুক্ত হওয়ায় তাঁর আদেশ-নির্দেশ মানতে চান না অপর পরিচালকরা। সব মিলিয়ে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় চলছে অচলাবস্থা, বিশেষ করে পরিদর্শন ও মনিটরিং ব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে।
মাউশি সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বিগত সরকার পরিবর্তনের পর গত ২৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগের পর মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) এ বি এম রেজাউল করীমকে মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে তিনিও চলতি মাসে অবসরে যাবেন।
এরই মধ্যে মহাপরিচালকের পদ পেতে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের বেশ কয়েকজন শীর্ষ অধ্যাপকের মধ্যে শুরু হয়েছে ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ। তবে গত তিন মাসেও এ পদে যোগ্য কাউকে খুঁজে পায়নি মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনা অনুসারে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর সারাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করে। এই অধিদপ্তর মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও ত্রৈমাসিক স্তরের প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রায় ২২ হাজার ৫৬৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে।
যাতে প্রায় ৪ লাখ ১২ হাজার ৫২৬ জন শিক্ষক ও ১ কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার ১৬৪ শিক্ষার্থী রয়েছে।
এদিকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সাতটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য। এগুলো হলো শেরেবাংলা নগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (বালিকা), আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মতিঝিল বালক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, টিকাটুলী সরকারি কামরুননেসা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, কলেজিয়েট হাই স্কুল, মনু মিঞা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় এবং গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল।
স্কুল-সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা চলমান। সামনে ভর্তি মৌসুম। এ সময়ে প্রধান শিক্ষক না থাকায় স্কুলগুলোতে সংকট দেখা দিয়েছে। মাউশিতে কোনো মহাপরিচালক না থাকায় প্রধান শিক্ষক বাছাই করে পদায়নের কাজও ঝুলে আছে। এ সুযোগে একটি সিন্ডিকেট বদলি বাণিজ্য করার জন্য সারাদেশের আগ্রহী প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা তুলতে শুরু করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এর বাইরেও মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ ফাঁকা রয়েছে। মাউশির ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালকের কার্যালয়ের দুটি স্কুল পরিদর্শক (প্রধান শিক্ষক পদমর্যাদা) পদও দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা।
গাজীপুর ও নরসিংদীতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পদেও কেউ নেই। বাগেরহাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পদও শূন্য। একাধিক কর্মকর্তা জানান, মাউশি মহাপরিচালকের পদ শূন্য থাকায় তাদের পদোন্নতি আটকে গেছে। কারণ, পদাধিকারবলে মহাপরিচালক তাদের বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। শিক্ষা খাতের একাধিক প্রকল্প পরিচালক জানান, তাদের প্রকল্পের সব ধরনের কেনাকাটা আটকে গেছে। এতে প্রকল্পগুলো ধুঁকছে। এর বাইরে সারাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মনিটরিং ও সুপারভিশন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মাউশি মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেতে আগ্রহীদের দৌড়ঝাঁপ তিন মাস ধরেই চলছে। এ পদের জন্য এখন চলছে ব্যাপক লবিং। রাজনৈতিক আনুকূল্য পেতেও চলছে বিভিন্ন পর্যায়ে দেন-দরবার। কেউ কেউ ছাত্রজীবনে ছাত্রদল সমর্থক রাজনীতির অভিজ্ঞতার প্রমাণ ও পারিবারিক সংশ্লিষ্টতাও তুলে ধরছেন সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে।
মাউশি মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১ (সচিব) পদমর্যাদার। তবে অতীতে অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন ও নেহাল আহমেদ ছাড়া অন্যরা অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদা নিয়ে অবসরে গেছেন। এটি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ। মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে পদটি খুবই আকর্ষণীয় বলে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাছে বিবেচিত হয়। এ পদে নিয়োগের জন্য সরকারপ্রধানের অনুমোদন প্রয়োজন। নিয়মানুসারে, শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের মধ্য থেকে চাকরির জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ডিজি নিয়োগের কথা থাকলেও ২৫-৩০ বছর ধরে রাজনৈতিক বিবেচনাতেই এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে।
শিক্ষা খাতের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, অসংখ্য পদপ্রত্যাশীর মধ্য থেকে এ পদের জন্য ঘুরেফিরে কয়েকজনের নাম শিক্ষা প্রশাসনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। পদপ্রত্যাশীরা নানাভাবে চেষ্টা করছেন। যারা এ পদে আলোচনায় আছেন তারা হলেন– মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের অধ্যাপক মো. আবদুস সবুর, মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দীন আল মাহমুদ সোহেল, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. তৌহিদ আহম্মেদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রুহুল কাদীর এবং পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক কাজী আবু কাইয়ুম শিশির।
জানা গেছে, আলোচিতদের মধ্যে সবাই ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অধ্যাপক সবুর, অধ্যাপক তৌহিদ ও অধ্যাপক রুহুল বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের ১৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা। আর অধ্যাপক সোহেল ১৬তম ব্যাচের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, আলোচিত পাঁচজনের মধ্যে অন্তত দু’জনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে আর্থিক দুর্নীতির জোরালো অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া অপর একজনের লেখা শেখ মুজিবকে নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন তাঁরই সহকর্মীরা।