
রক্তাক্ত ইয়ামিন!

রেজুয়ান আহম্মেদ
সাভারের অদূরে হাজীপাড়া গ্রাম। এমন একটি গ্রাম, যেখানে জীবনের প্রতিটি ছন্দ মিশে আছে প্রকৃতির মাঝে। ভোরবেলা পাখির কলরব, মাঠে কৃষকের কাঁচা ঘামের গন্ধ, আর সন্ধ্যায় আলো জ্বালিয়ে গল্পে মেতে থাকা মানুষেরা—সব মিলিয়ে গ্রামটি যেন এক কবিতা। এই গ্রামেই জন্ম ইয়ামিনের। বাবা করিম মিয়া ছিলেন একজন সৎ কৃষক। সারাদিন পরিশ্রম করেও তার মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়ত না। মা জমিলা খাতুন সংসারের প্রতিটি কাজে দক্ষ, ধৈর্যশীল একজন নারী।
ইয়ামিন ছোট থেকেই আলাদা। তার চোখে ছিল অদ্ভুত এক স্বপ্ন—নিজের গ্রামকে দেশের সেরা গ্রাম বানানোর। সে পড়াশোনায় দারুণ, কিন্তু ততটাই আন্তরিক গ্রামের মানুষের প্রতি। স্কুল ছুটি হলে অন্য ছেলেমেয়েরা খেলায় মত্ত থাকলেও ইয়ামিন বই নিয়ে বসত। তার ইচ্ছা ছিল গ্রামের প্রতিটি শিশুর চোখে শিক্ষার আলো জ্বালানো।
“গ্রামের স্কুলটাকে দেশের সেরা বানাব,”—এটাই ছিল তার প্রতিজ্ঞা। শিক্ষকরা তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। তারা বলতেন, “ইয়ামিন একদিন অনেক বড় কিছু করবে। আমাদের গ্রাম তার জন্য গর্বিত।”
কিন্তু ইয়ামিনের এই স্বপ্ন দেখার অধিকার যেন কেউ সহ্য করতে পারল না।
২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। দিনটি ছিল অন্য দিনের মতোই সাধারণ। ইয়ামিন সাভারের বাজারে গিয়েছিল। তার হাতে ছিল কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু ভাগ্য সেদিন তার জন্য নির্মম এক চক্রান্ত তৈরি করেছিল।
বাজারের মাঝখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সমাবেশ চলছিল। উত্তেজনা তুঙ্গে। হঠাৎ এক নেতা মাইকে চিৎকার করে বলল, “ওই ছেলেটা গুপ্তচর! ধরো ওকে!” কথাটি শুনে চারদিকের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ল ইয়ামিনের ওপর।
“আমি কিছু জানি না। আমি নির্দোষ,”—চিৎকার করেও নিজেকে বাঁচাতে পারল না ইয়ামিন।
পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে গেল। সাভারের থানায় শুরু হলো এক নির্মম অধ্যায়।
“কোন দলের হয়ে কাজ করছ? তোর নেতা কে?” পুলিশের এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের কোনো উত্তরই ইয়ামিনের মুক্তি আনতে পারল না। তার মুখে লাঠির আঘাত, শরীরে বিদ্যুৎ শকের তীব্র যন্ত্রণা। ইয়ামিন কাঁদছিল, কিন্তু তার চোখে ছিল একধরনের দৃঢ়তা।
“আমি নির্দোষ,”—এই কথাটি ছাড়া সে আর কিছু বলল না।
ভোরবেলা তাকে পুলিশের গাড়ির ছাদে উঠিয়ে আনা হলো। যেন জনসম্মুখে এক অপমানজনক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। হঠাৎ রাস্তার মাঝে ছাদের উপর থেকে একজন পুলিশ সদস্য তাকে টেনে রাস্তায় ফেলে দিল।
এমন বর্বরতার দৃশ্য দেখে রাস্তার মানুষগুলো চুপ হয়ে গেল। কারও সাহস হলো না প্রতিবাদ করার। এক পুলিশ অফিসার পিস্তল বের করে তার পায়ে গুলি করল। ইয়ামিন কাতরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার শরীর ক্রমশ নিথর হয়ে গেল।
পরদিন সকালে জমিলা খাতুন হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানে তার ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। তার কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।
“আমার ছেলে নির্দোষ ছিল। ওর কী দোষ ছিল? কে আমার ছেলেকে মেরেছে?” তার চিৎকার সাভারের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেল।
ইয়ামিনের মৃত্যু শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, পুরো গ্রামের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়াল।
ইয়ামিনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। “ইয়ামিনের হত্যাকারীদের বিচার চাই”—এই স্লোগান ছড়িয়ে পড়ল গ্রাম থেকে শহরে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো ঘটনার নিন্দা জানাল। তারা বলল, এটি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের উদাহরণ। কিন্তু সরকার শুরুতে গুরুত্ব দেয়নি।
জমিলা খাতুন তার ছেলের জন্য সুবিচার চাইলেন। তিনি প্রতিটি ঘরে গিয়ে মানুষকে আন্দোলনের জন্য আহ্বান জানালেন। তার এই লড়াই শুধু তার একার ছিল না, বরং এটি হয়ে উঠল নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর।
সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করল। কিন্তু রিপোর্টে বলা হলো, “ইয়ামিনের মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা।”
এই রিপোর্ট মানুষকে আরও ক্ষুব্ধ করে তুলল। প্রতিবাদের ঢেউ এবার আরও জোরালো হলো। সারা দেশে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে এলো।
ইয়ামিনের মৃত্যু থামিয়ে দিতে পারেনি একটি জাতির স্বপ্ন। তার মা জমিলা খাতুন আজ একটি প্রতীক। তার সংগ্রাম মানুষকে শিখিয়েছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস।
ইয়ামিন বেঁচে নেই, কিন্তু তার স্বপ্ন আজও বেঁচে আছে। তার মৃত্যু একটি জাতিকে শিখিয়েছে, “ক্ষমতার অপব্যবহার জীবন কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু সত্য এবং ন্যায়ের শক্তি কখনো মরে না।”
রক্তাক্ত ইয়ামিন একটি জীবনের গল্প নয়, এটি একটি জাতির জাগরণের গল্প। তার আত্মত্যাগ মানুষের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম