
শেষ ভরসা!

রেজুয়ান আহম্মেদ
রোদঝলমলে এক দুপুর। রাস্তায় মানুষের ভিড়, কিন্তু কারো মুখেই সুখের ছাপ নেই। পেটের ক্ষুধা, দ্রব্যমূল্যের চাপ আর অজানা ভবিষ্যতের ভয় যেন সবাইকে চেপে ধরেছে। সেই ভিড়ের মধ্যেই দাঁড়িয়ে ছিল রাজু। কাজ নেই, পকেটে মাত্র দশ টাকা।
বাজারের গলিতে ঢুকে সে দেখল, আলুর দাম প্রতি কেজি আশি টাকা। আর ডালের দাম শুনে তো মাথা ঘুরে পড়ার উপক্রম—একশ চল্লিশ টাকা!
“ভাই, একটু দাম কমান। না হলে নিতে পারব না,” দোকানদারকে অনুরোধ করল সে।
দোকানদার কটমট করে তাকিয়ে বলল, “সবকিছুই তো বাড়তি। কমাব কীভাবে? না নিতে পারলে বাড়ি যান।”
হতাশ রাজু কাঁচাবাজার ছেড়ে বেরিয়ে এল। ছোট বোন মিতুর জন্য কিছু কিনতে হবে, কিন্তু কী করবে? তার মনে পড়ল বাবার মুখ। বাবা বলতেন, “রাজু, নেতা হতে হলে ক্ষমতাবান হওয়া লাগে না, লাগে হৃদয়বান হওয়া। আগে দেশকে ভালোবাসো, তারপর জনগণকে। তাহলেই তুমি সবার কাছে সম্মান পাবে।”
কিন্তু আজকের দিন? নেতারা সবাই নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে ব্যস্ত। মানুষ যে ক্ষুধার জ্বালায় পুড়ছে, তা দেখার সময় তাদের নেই। রাজুর মনে হলো, বাবার সেই কথা এখনো বাতাসে ভাসছে, কিন্তু বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই।
সন্ধ্যায় রাজু বাড়ি ফিরল। ঘরে ঢুকেই দেখল, ছোট বোন মিতু চুপচাপ বসে আছে। তার সামনে একটি প্লেটে ভাত আর পাশে লবণের কৌটা। রাজু বুঝতে পারল, আজও তাদের রান্নাঘরে কোনো তরকারি নেই।
“ভাইয়া, তুমি খেয়ে নাও। আমি খেয়ে নিয়েছি,” বলল মিতু।
রাজুর বুক ভেঙে গেল। চুপচাপ জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল, কিন্তু মন তার অতীতে চলে গেল।
রাজুর বাবা ছিলেন গ্রামের একজন শিক্ষক। গ্রামের সবাই তাকে সম্মান করত। রাজুর শৈশব ছিল বাবার সততার জন্য গর্বে ভরা। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর যেন পরিবারটি সমাজের চোখ থেকে হারিয়ে গেল। রাজু বুঝতে পারল, সমাজে টিকে থাকতে হলে নিজের লড়াই নিজেকেই করতে হবে।
সেই রাতে রাজু ঘুমাতে পারল না। বারবার বাবার কথা আর মিতুর মুখ মনে পড়ছিল। হঠাৎ তার মনে একটি ভাবনা এল। যদি এমন একজন নেতা থাকত, যে শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, বরং মানুষের জন্য কাজ করতে চায়? সেই ভাবনা থেকেই রাজু লিখতে শুরু করল। গল্পের নাম দিল “শেষ ভরসা”।
গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে একজন শিক্ষক। গ্রামের মানুষ যখন দ্রব্যমূল্যের চাপে দিশাহারা, তখন সেই শিক্ষক নিজেই উদ্যোগ নিলেন। এলাকার যুবকদের নিয়ে শুরু করলেন কৃষিকাজ। তিনি বললেন, “নিজেদের খাবার নিজেরাই উৎপাদন করব। কেউ আমাদের বাঁচাতে আসবে না। আমাদের নিজেদেরই বাঁচতে হবে।”
কিন্তু তখন এল বড় প্রশ্ন। এলাকার নেতারা এসে বলল, “সরকারের সাহায্য নিন। নিজেরা এত কষ্ট করছেন কেন?”
শিক্ষক হেসে বললেন, “সরকার যদি দায়িত্ব নিতে পারত, তবে তো আমাদের এই দশা হতো না।”
রাজুর লেখা গল্পটি স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হলে গ্রামের সবাই তা পড়ল। মানুষের মনে নতুন আশা জাগল। গল্পের সেই শিক্ষকের মতো অনেকেই বাস্তবে কাজ শুরু করল।
কিন্তু সরকার চুপ করে বসে থাকেনি। তারা গল্পটিকে “বিদ্রোহী লেখা” বলে ঘোষণা করল। রাজুকে ধরতে পুলিশ পাঠানো হলো। কিন্তু ততদিনে রাজু গ্রামে গ্রামে ঘুরে এক নতুন আন্দোলনের সূচনা করে ফেলেছে।
“আমরা আর অপেক্ষা করব না। নিজেরাই নিজের দেশের দায়িত্ব নেব,” বলল রাজু। তার কথায় যুবক, বৃদ্ধ এমনকি নারীরাও এগিয়ে এল।
ধীরে ধীরে রাজুর এই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। মানুষ বুঝতে পারল, একটি দেশকে বদলাতে হলে সৎ নেতৃত্বের প্রয়োজন। শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, দেশের জন্য নিবেদিত একজন নেতা চাই।
একদিন, এক বৃদ্ধ এসে রাজুর হাতে একটি চিঠি দিয়ে গেলেন। চিঠিতে লেখা ছিল:
“তোমার গল্প আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। তুমি শুধু গল্প লিখে থেমে থেকো না। আমাদের নেতা হয়ে যাও। আমরা তোমার সাথে আছি।”
রাজু প্রথমে দ্বিধায় পড়ল। সে কি সত্যিই এই দায়িত্ব নিতে পারবে? কিন্তু মিতুর মুখ মনে পড়তেই সে সিদ্ধান্ত নিল।
রাজু একটি নতুন দলের ঘোষণা দিল। দলের নাম রাখল “মানুষের জন্য মানুষ”। এই দলে কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। ছিল শুধু দেশের জন্য কাজ করার ইচ্ছা।
দেশের মানুষ রাজুকে গ্রহণ করল। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করল। দ্রব্যমূল্যের চাপ কমল। যুবকরা কর্মসংস্থানে যুক্ত হলো। আর রাজু তার বাবার কথা মেনে একজন সত্যিকারের হৃদয়বান নেতা হয়ে উঠল।
পাঁচ বছর পর, দেশের এক নামকরা সাংবাদিক একটি প্রতিবেদনে লিখলেন:
“আমাদের দেশে একসময় মানুষ হতাশায় ডুবে ছিল। কিন্তু একজন রাজু আমাদের দেখিয়েছে, প্রকৃত নেতা কীভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। ক্ষমতাবান হওয়া বড় কথা নয়, মানুষের জন্য নিবেদিত হওয়াই আসল।”
রাজুর নেতৃত্বে দেশ ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। তার জন্য দেশের মানুষ তাকে “শেষ ভরসা” বলে ডাকতে শুরু করল।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়। কারণ প্রকৃত পরিবর্তন শুরু হয় তখনই, যখন মানুষ নিজেদের মধ্যে পরিবর্তনের আগুন জ্বালাতে পারে।
“ক্ষমতাবান নয়, দরকার একজন প্রকৃত হৃদয়বান নেতা। কারণ দেশটা ক্ষমতার নয়, মানুষের।”