
উচ্চস্বরে ওয়াজ, ধর্ম প্রচার নাকি সমাজে অশান্তি?

রেজুয়ান আহম্মেদ
ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তি ও সৌহার্দ্যের বার্তা নিয়ে পবিত্র কোরআন এবং রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ আমাদের সামনে আদর্শ জীবনব্যবস্থার দিকনির্দেশনা দেয়। ইসলামের মূলনীতি হলো মানবিক কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং সমাজে সম্প্রীতি বজায় রাখা। কিন্তু বর্তমান সময়ে লক্ষ্য করা যায়, ওয়াজ মাহফিলের নামে অতিরিক্ত উচ্চস্বরে মাইক ব্যবহারের ফলে জনজীবনে এক প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। এটি যেমন ধর্মের মূল আদর্শের পরিপন্থী, তেমনি সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য।
পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
“তুমি তোমার রবের পথে মানুষকে আহ্বান করো প্রজ্ঞার সাথে এবং উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।” (সূরা নাহল: ১২৫)
এখানে "প্রজ্ঞা" এবং "উত্তম উপদেশ" শব্দ দুটির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে, ধর্ম প্রচার এমনভাবে করতে হবে যেন তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এবং কারো ওপর জোর বা অসুবিধা সৃষ্টি না হয়। ইসলাম শান্তির পথে আহ্বান করতে বলেছে, কিন্তু সেটি অন্যের কষ্টের কারণ হলে তা ইসলামি শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে জোর-জবরদস্তি বা কোলাহল সৃষ্টি করেননি। বরং তিনি তার আচরণ ও মৃদুভাষী উপদেশের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছেন। সহীহ বুখারির একটি হাদিসে এসেছে:
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ মৃদুভাষী এবং নম্র মানুষকে পছন্দ করেন, আর কঠোর, উগ্র এবং উচ্চস্বরে কথা বলা মানুষকে অপছন্দ করেন।”
এ থেকেই স্পষ্ট হয়, উচ্চস্বরে ওয়াজ বা বক্তৃতা দেওয়া রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহর পরিপন্থী।
উচ্চ শব্দের নেতিবাচক প্রভাব:
বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় রাতভর উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে ওয়াজ করা হয়, যা সমাজের অনেক শ্রেণির মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত তিনটি শ্রেণির মানুষের ওপর এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলে:
১. শিশুদের মানসিক অবস্থা:
শিশুরা অত্যন্ত সংবেদনশীল। উচ্চ শব্দে তারা সহজেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এতে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
২. বয়স্ক ও অসুস্থ রোগী:
বয়স্ক ও অসুস্থ রোগীদের শরীর এমনিতেই দুর্বল। অতিরিক্ত শব্দ তাদের জন্য অস্বস্তিকর এবং রোগের তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ঘুমের ব্যাঘাত তাদের শারীরিক অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে।
৩. গর্ভবতী মা ও নবজাতক:
গর্ভবতী মা এবং নবজাতকদের জন্য উচ্চ শব্দ মানসিক চাপ ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করে, যা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ধর্ম প্রচারের প্রকৃত উদ্দেশ্য:
ইসলামে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর বার্তা মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়া। এটি হওয়া উচিত শান্তিপূর্ণ, বিনয়ী ও মানবিক পদ্ধতিতে। কিন্তু বর্তমান সময়ে দেখা যায়, অনেক বক্তা শুধুমাত্র নিজেকে জনপ্রিয় করার জন্য উচ্চস্বরে ওয়াজ করেন। কেউ কেউ এটিকে ব্যবসায় পরিণত করেছেন।
রাসুল (সা.) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি দুনিয়ার অর্থ বা সম্মান অর্জনের জন্য ধর্ম প্রচার করে, তার জন্য জাহান্নামের শাস্তি অপেক্ষা করছে।” (সহীহ মুসলিম)
এ ধরনের প্রবণতা ইসলামি শিক্ষার পরিপন্থী এবং সমাজে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সমাধানের জন্য প্রস্তাবনা:
১. মৃদু ও বিনয়ী ভাষা:
ধর্ম প্রচার এমন ভাষায় করতে হবে, যা মানুষের হৃদয়ে প্রভাব ফেলবে এবং কাউকে কষ্ট না দেয়।
২. নীরব প্রচার:
কোরআনে বলা হয়েছে:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন যারা নীরবে ইবাদত করে এবং প্রচার করে।” (সূরা বাকারা)
৩. প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার:
মাইকের ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ না হলেও এর শব্দ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আবাসিক এলাকায় ও রাতে উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো বন্ধ করতে হবে।
৪. মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি:
ধর্ম প্রচারের সময় বক্তাদের বোঝা উচিত, তাদের শব্দ অন্যের অসুবিধার কারণ হতে পারে।
ইসলাম আমাদের শান্তি, সম্প্রীতি এবং মানবিকতায় উদ্বুদ্ধ করে। উচ্চস্বরে ওয়াজ মাহফিল করা কোনোভাবেই ইসলামি শিক্ষা ও রাসুল (সা.)-এর আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং এটি সমাজের দুর্বল, অসুস্থ ও শিশুদের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ধর্ম প্রচার করতে হবে এমনভাবে, যেন মানুষ তা সহজে গ্রহণ করতে পারে। সেলিব্রেটি হওয়ার লোভ বা অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য শান্তিপূর্ণভাবে তার বার্তা পৌঁছে দেওয়াই একজন সত্যিকারের আলেমের দায়িত্ব।
আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং ধর্ম প্রচারের নামে যেন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সেই তাওফিক দান করুন। আমিন।