
দুঃখের জাল, কষ্টের পাহাড়

রেজুয়ান আহম্মেদ
বৃন্দাবনপুর গ্রামের শেষ সীমানায় প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট কুঁড়েঘরটি। সেই কুঁড়েঘরে বাস করেন চন্দ্রা আর তার নাতি রবি। চন্দ্রার জীবনের প্রতিটি দিন যেন এক অনন্ত দীর্ঘশ্বাস। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে চন্দ্রার দুঃখের গল্প। তবে চন্দ্রার নিজের ভাষায়, তার জীবন কেবল দুঃখে ভরা নয়; তা কষ্টে পূর্ণ।
একদিন সকালে রবি স্কুলে যাওয়ার সময় চন্দ্রাকে জিজ্ঞেস করল,
“ঠাম্মা, দুঃখ আর কষ্টের মধ্যে পার্থক্য কী?”
চন্দ্রা তখন উঠোনে শুকনো কাঠের আঁচে ভাত রান্না করছিল। আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। বলল,
“তোর জীবনে একদিন এই পার্থক্য নিজে থেকেই বুঝতে পারবি। তবে আজ বলি, দুঃখ হলো আকাশের মেঘের মতো—এটা আসবে আর চলে যাবে। কিন্তু কষ্ট হলো গাছের শেকড়ের মতো—মাটির গভীরে বসে থাকে। চাইলেও তা সহজে তাড়ানো যায় না।”
রবি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। সে কথাগুলো বুঝল না, কিন্তু ঠাম্মার কথাগুলো তার মনে গেঁথে গেল।
চন্দ্রার জীবন এক সময় ছিল শান্ত, সুখী। তার স্বামী সুশীল ছিলেন গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। গ্রামের সবাই সুশীলকে সম্মান করত। তাদের একমাত্র ছেলে রমেশ ছিল মেধাবী। চন্দ্রা ভেবেছিলেন, রমেশ একদিন বড় হয়ে তার সুখের আশীর্বাদ হবে। কিন্তু জীবনের পথ বড্ড কঠিন।
এক কালবৈশাখীর রাতে বজ্রপাতে সুশীল মারা গেলেন। চন্দ্রার জীবনে প্রথমবারের মতো নেমে এলো দুঃখের কালো মেঘ। তিনি ভেবেছিলেন, সময়ের সঙ্গে দুঃখ সরে যাবে।
কিন্তু দুঃখের চেয়েও কঠিন ছিল কষ্ট। রমেশ শহরে কাজ করতে গিয়েছিল পরিবারের ভবিষ্যৎ গড়তে। প্রথম কয়েক বছর চিঠি আসত, টাকা পাঠাত। তারপর সব বন্ধ হয়ে গেল। রমেশ যেন কোথাও হারিয়ে গেল।
চন্দ্রা একদিন বুঝতে পারলেন, দুঃখ সরে গেলেও কষ্ট তার জীবন থেকে যাবে। এই কষ্ট ছিল রমেশের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর রবিকে কীভাবে মানুষ করবেন সেই চিন্তা।
একদিন রবি স্কুল থেকে ফিরে বলল,
“ঠাম্মা, আমি এক ছেলের বাবার মৃত্যু দেখে এলাম। সে খুব কাঁদছিল। ও কি কষ্টে আছে?”
চন্দ্রা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন,
“না রে, ও দুঃখে আছে। দুঃখ কাঁদায়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানুষ তা ভুলে যায়। কষ্ট এমন কিছু, যা মানুষকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খায়।”
রবি গভীরভাবে চিন্তা করল। সে ভাবল, ঠাম্মার কষ্টের কারণ কি তবে সে নিজে? কারণ সে জানে, তার জন্যই ঠাম্মার জীবন কঠিন হয়ে উঠেছে।
একদিন গ্রামের বড়লোক জমিদারের ছেলে শংকর চন্দ্রার কাছে এসে খবর দিল,
“চন্দ্রা মাসি, শহর থেকে খবর এসেছে। তোমার ছেলে রমেশ আর নেই। সে এক কারখানায় দুর্ঘটনায় মারা গেছে।”
চন্দ্রার হাত থেকে কলসিটি পড়ে গেল। কিন্তু তিনি কাঁদলেন না। চন্দ্রা জানতেন, চোখের জল দিয়ে এই কষ্ট ধুয়ে ফেলা যাবে না। তার কষ্টের পাহাড় আরেকটু ভারী হয়ে গেল।
দিনগুলো কেটে গেল। রবি বড় হলো। সে বুঝতে শিখল, দুঃখ হলো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু কষ্ট চিরস্থায়ী। একদিন সে ঠাম্মাকে বলল,
“ঠাম্মা, আমি অনেক বড় হয়ে অনেক টাকা উপার্জন করব। তোমার কষ্ট দূর করব।”
চন্দ্রা রবির মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আমার কষ্ট দূর করতে চাইলে বড় মানুষ নয়, ভালো মানুষ হবি। টাকা দিয়ে সব কষ্ট দূর হয় না রে। মানুষের কষ্ট দূর হয় ভালোবাসা আর সহানুভূতির মাধ্যমে।”
দুঃখ হলো এমন এক মেঘ, যা জীবনের আকাশে এসে কাঁদায়, আবার সময়ের সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু কষ্ট হলো সেই পাহাড়, যা মানুষকে জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয়।
জীবন যতই কঠিন হোক, ভালো মানুষ হওয়ার মধ্যেই এর আসল সার্থকতা। কষ্টের মধ্যেও যদি ভালোবাসার আলো থাকে, তবে সেই জীবন প্রকৃত অর্থে পূর্ণ হয়ে ওঠে।