img

জননেতা মওলানা ভাসানীর জীবন ও সংগ্রাম -ড.আজিজুল আম্বিয়া

প্রকাশিত :  ১৯:৩৭, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

জননেতা মওলানা ভাসানীর জীবন ও সংগ্রাম  -ড.আজিজুল আম্বিয়া

ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃনমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক মজলুম জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী । ভাসানীর বলিষ্ঠ কন্ঠের ভাষণ এখনো বেসে বেড়ায় বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে। বিভিন্ন কারণে এই মহান নেতার যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব হয়নি।  ভাসানী  ভক্তরা মনে করেন এখন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর স্মরণে একটা সুযোগ এসেছে। কারণ বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার গঠন হয়েছে এবং উনারা সব সময় নিজেদের দলের প্রধান কে বড় করে দেখা যে একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন সেটা থেকে হয়তো মানুষ মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।  বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর যথার্থ  মূল্যায়ন করে এই মহান নেতা কাছ থেকে দায় মুক্তি নেবে।  এই উপমহাদেশে অনেক নেতা এসেছেন কালের বিবর্তনে তারা হারিয়ে গেছে কিন্তু মওলানা ভাসানীর মত আর কোন দ্বিতীয় নেতা এই জাতি পায়নি, যে নেতা মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন তিনি সামাজিক বিপ্লব থেকে শুরু করে রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়াও ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব করে গেছেন তাই তিনি মানুষের মনে অমর আসল লাভ করেছেন । আসুন আমরা এই মহান নেতার  জীবন সম্পর্কে জেনে নেই। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ই ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের সয়াধানগড়া পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী। মোঃ আব্দুল হামিদ খান সবার ছোটো। তার ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া। ছেলে-মেয়ে বেশ ছোটো থাকা অবস্থায় হাজী শারাফত আলী মারা যান। কিছুদিন পর এক মহামারীতে বেগম শারাফত  মারা যায়। বেঁচে থাকেন ছোট্ট শিশু আব্দুল হামিদ খান।পিতৃহীন হামিদ প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে থাকেন। ওই সময় ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসির উদ্দীন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তার আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন পূর্বে ১৮৯৩ সালে তিনি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর বাড়িতে যান। সেখানে তিনি মাদ্রাসার মোদাররেসের কাজ করেন এবং জমিদারের ছেলে-মেয়েকে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে পীর সৈয়দ নাসীরুদ্দীনের সাথে আসাম গমন করেন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ইসলামি শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯০৭ সালে দেওবন্দ যান। দুই বছর সেখানে অধ্যয়ন করে আসামে ফিরে আসেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ময়মনসিংহ সফরে গেলে তার ভাষণ শুনে ভাসানী অণুপ্রাণিত হন। ১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৫ সালে তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন মহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তার সহধর্মিণী আলেমা খাতুনকে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক-প্রজা আন্দোলনের সুত্রপাত ঘটান।

১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এখান থেকে তার নাম রাখা হয় \"ভাসানীর মওলানা\"। এরপর থেকে তার নামের শেষে ভাসানী শব্দ যুক্ত হয়।আর তিনি মওলানা ভাসানী নামেই সমধিক পরিচিত। তিনি  বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক, যিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে “মজলুম জননেতা” হিসাবে সমধিক পরিচিত। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার অনুসারীরা অনেকে এজন্য তাকে \"লাল মওলানা\" নামেও ডাকতেন। তিনি কৃষকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তান কৃষক পার্টি করার জন্য সারাদেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা। তিনি পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের “আস্ সালামু আলাইকুম” বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা।দেশ প্রেমের আলোকবর্তিকা মাওলানা ভাসানীকে বঙ্গবন্ধু পিতাতুল্য মনে করতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মাওলানা ভাসানীর প্রথম পছন্দ। তাদের এই সম্পর্ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিক থেকে ছিল শ্রদ্ধার  আর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর  দিক থেকে ছিল  স্নেহের।  দীর্ঘদিন একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন । তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল তাদের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল সে দলটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কান্ডারী । যদিও পরবর্তীতে সময়ে মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু সব সময় তিনি প্রগতিশীলতা ও নিয়নীতির পক্ষে কথা বলেছিলেন।

১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ গাইবান্ধায় বিশাল কৃষক সম্মেলন করেন। ১৯৩৭-এ মওলানা ভাসানী কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। সেই সময়ে আসামে \'লাইন প্রথা\' চালু হলে এই নিপীড়নমূলক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। এসময় তিনি \"আসাম চাষী মজুর সমিতি\" গঠন করেন এবং ধুবরী, গোয়ালপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ১৯৪০ সালে শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সঙ্গে মুসলিম লীগের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ভাসানী আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫-৪৬ সালে আসাম জুড়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে \"বাঙ্গাল খেদাও\" আন্দোলন শুরু হলে ব্যাপক দাঙ্গা দেখা দেয়। এসময় বাঙালিদের রক্ষার জন্য ভাসানী বারপেটা, গৌহাটিসহ আসামের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেড়ান। পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আসামে গ্রেফতার হন। ১৯৪৮-এ মুক্তি পান। এরপর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে ফিরে আসেন।১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্যবস্থাপক সভার কার্যাবলি বাংলায় পরিচালনা করার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান এবং এই দাবি নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। ১৯ মার্চ বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়ে বলেন, যেসব কর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ প্রদেশ থেকে সংগ্রহ করে তার শতকরা ৭৫% প্রদেশকে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ আমলে বঙ্গপ্রদেশ জুটেক্স ও সেলসট্যাক্স রাজস্ব হিসেবে আদায় করত এবং এই করের ভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিতে হতো না। পাকিস্তান সৃষ্টির পর কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববঙ্গ সরকারের হাত থেকে এই কর ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরাই আদায় করতে থাকে যার ফলে পূর্ববঙ্গ সরকার আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এই সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের বার্ষিক বাজেট ছিল মাত্র ৩৬ কোটি টাকা। যাই হোক, মুসলিম লীগ দলের সদস্য হয়েও সরকারের সমালোচনা করায় মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন সদস্যরা মওলানা ভাসানীর ওপর অখুশী হয় এবং তার নির্বাচনে ত্রুটি ছিল এই অজুহাত দেখিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করে এবং মওলানা ভাসানীকে নানাভাবে হয়রানি করতে থাকে। পরিশেষে মওলানা ভাসানী ব্যবস্থাপক সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এতদসত্ত্বেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর এক নির্বাহী আদেশ বলে মওলানা ভাসানীর নির্বাচন বাতিল করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জনবিরোধী কার্যকলাপের ফলে মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলিতে রোজ গার্ডেনে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করেন। ২৩ জুন ওই কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রধান অতিথি। ২৩ জুন পূর্ববঙ্গের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী সর্বসম্মতিক্রমে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত হলেন।২৪ জুন আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের মধ্যভাগে পূর্ববঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১১ অক্টোবর আরমানীটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থতার জন্য পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবী করা হয় এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মওলানা ভাসানী ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ভূখা মিছিলে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ১৯৪৯-এর ১৪ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাবরণ করেন।১৯৫০ সালে সরকার কর্তৃক রাজশাহী কারাগারের খাপরা ওয়ার্ড এর বন্দীদের উপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘট পালন করেন এবং ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২-র ৩০ জানুয়ারি ঢাকা জেলার বার লাইব্রেরি হলে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সহযোগিতার কারণে গ্রেফতার হয়ে ১৬ মাস কারানির্যাতনের শিকার হন। অবশ্য জনমতের চাপে ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল মওলানা ভাসানীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়।পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি শের-এ-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দীকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামক নির্বাচনী মোর্চা গঠন করেন। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল বিজয় অর্জন করে এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ২৩৭ টির মধ্য ২২৮ টি আসন অর্জনের মাধ্যমে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করার পর ২৫শে মে ১৯৫৪ মওলানা ভাসানী বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে যান এবং সেখানে বক্তব্য প্রদান করেন।৩০ মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন জারি করে এবং মওলানা ভাসানীর দেশে প্রত্যাবর্তনের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। ১১ মাস লন্ডন, বার্লিন, দিল্লী ও কলকাতায় অবস্থান করার পর তার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হলে ১৯৫৫-র ২৫ এপ্রিল দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব বাংলায় খাদ্যজনিত দুর্ভিক্ষ রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবিতে ১৯৫৬-র ৭ মে ঢাকায় অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সরকার দাবি মেনে নিলে ২৪ মে অনশন ভঙ্গ করেন। একই বছর ১২ সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে মাওলানা ভাসানী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করে নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণকালে মাওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।  ১৯৫৬তে পাকিস্তান গণপরিষদে যে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয় তাতে পাকিস্তানকে ইসলামিক রিপাবলিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল,তখন মওলানা ভাসানী পল্টনের জনসভায় তার বিরোধিতা করে সুস্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছিলেন৷ কাগমারী সম্মেলনে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে অণুষ্ঠানটি আরম্ভ হয়। এই সভায় মওলানা ভাসানীও বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তিনি বলেন, পূর্ববাংলা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের দ্বারা শোষিত হতে থাকলে পূর্ববঙ্গবাসী তাদের সালামু ওআলায়কুম জানাতে বাধ্য হবে। এছাড়া কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহ্‌রাওয়ার্দী সেই দাবি প্রত্যাখান করলে ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। একই বছর ২৫ জুলাই তার নেতৃত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে \'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি\' (ন্যাপ) গঠিত হয়। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভাসানী প্রকাশ্যে বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এর পর থেকে সবসময় বাম ধারার রাজনীতির সাথেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন।১৯৫৮-র ৭ অক্টোবর দেশে সামরিক শাসন জারি হলে আইয়ুব খান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১২ অক্টোবর মওলানা ভাসানীকে কুমুদিনী হাসপাতাল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৪ বছর ১০ মাস কারারুদ্ধ থাকেন।বন্দী অবস্থায় ১৯৬২-র ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত বন্যাদুর্গতদের সাহায্য ও পাটের ন্যায্যমূল্যসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। ৩ নভেম্বর মুক্তিলাভ করেন এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রাটিক ফ্রন্ট-এর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হন। ১৯৬৩-র মার্চ মাসে আইয়ুব খানের সাথে সাক্ষাত করেন। একই বছর ২৪ সেপ্টেম্বর চীনের বিপ্লব দিবস-এর উৎসবে যোগদানের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন এবং চীনে সাত সপ্তাহ অবস্থান করেন।

১৯৬৪-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবিত করে দলের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং একই বছর ২১ জুলাই সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৫-র ১৭ জুলাই আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র নীতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। ১৯৬৬-তে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচীর বিরোধিতা করেন। ১৯৬৭-র ২২ জুন কেন্দ্রীয় সরকার রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ জারি করলে এর প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৭-র নভেম্বর-এ ন্যাপ দ্বি-খন্ডিত হলে চীনপন্থি ন্যাপের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের মুক্তি দাবি করেন। ৮ মার্চ (১৯৬৯) পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে সেখানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে সাক্ষাত করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে একমত হন। ২৬শে ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান কর্তৃক আহুত গোলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখান করে শ্রমজীবীদের ঘেরাও কর্মসূচী পালনে উৎসাহ প্রদান করেন। আইয়ুব খান সরকারের পতনের পর নির্বাচনের পূর্বে ভোটের আগে ভাত চাই, ইসলামিক সমাজতন্ত্র কায়েম ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করেন।আমেরিকান সাংবাদিক ড্যান কোগগিন, টাইমে পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে উসকে দেওয়ার জন্য ভাসানীর প্রশংসা করেছিলেন যে, \"যতটা একজন মানুষ মতো \", যা আইয়ুব খান সরকারের পতনের ঘটিয়েছিল।১৯৭০ সালের ৬-৮ আগস্ট বন্যা সমস্যা সমাধানের দাবিতে অনশন পালন করেন। অতঃপর সাধারণ নির্বচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১২ নভেম্বর (১৯৭০) পূর্ব পাকিস্তানে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় হলে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ব্যবস্থায় অংশ নেয়ার জন্য ন্যাপ প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান।

১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জনসভায় \'স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান\' দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। অভিযোগ আছে আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত  মওলানা ভাসানীর যথার্থ  মূল্যায়ন করেনি।  প্রশ্ন আছে  বিএনপি তে বিলীন না লালিত মৌলানা ভাসানীর  রাজনীতি? বিএনপি নির্বাচনী প্রতীক  ধানের শীষ । স্বাধীনতার আগে থেকেই এটি ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির  (ন্যাপ ) মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন  অংশের নির্বাচনী প্রতীক। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩  সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছে ন্যাপ (ভাসানী)। মওলানা ভাসানীর প্রতীকটি   বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ।মওলানা ভাসানী  প্রতীকটিকে  বেছে নিয়েছিলেন কৃষি নির্ভর গ্রাম বাংলার আপামর জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে । তার ক্যারিশম্যাটিক  নেতৃত্ব ও রাজনীতি প্রত্যেকটি গ্রহণযোগ্যতা ও তৈরি করেছিল।

মওলানা  ভাসানীর  মৃত্যুর পর ন্যাপের তৎকালীন মহাসচিব মশিউর রহমান যাদু  মিয়া সহ তার অনেকে রাজনৈতিক শিষ্য ও সহযোগী যোগ দেন বিএনপিতে। সঙ্গে করে নিয়ে যান দলের প্রতীক ধানের শীষকে । বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধানের শীষ প্রতীকটি  এখন বিএনপিরই সমার্থক হয়ে উঠেছে।  প্রতীকটির  রাজনীতি নিয়ে আলোচনায় মওলানা ভাসানী বা তার রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা এখন শোনা যায় কালেভদ্রে । তাই বলা যায়,  আওয়ামী লীগ ও বিএনপির  শাসন আমলে  মওলানা ভাসানীর  যথার্থ মূল্যায়ন করা  সম্ভব হয়নি । তাই ভাসানী  ভক্তরা সবসময়ই একটা আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে আছেন কখন এই মহান ব্যক্তিটির যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। আমাদের কাছে এর নেই কোন উত্তর। পরিশেষে বলা যায় বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে , তাদের রাজনীতির একটা নির্দিষ্ট কাঠামো আছে ।কিন্তু মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর  বেলায় ব্যতিক্রম । তিনি বড় বেখাপ্পা । তাকে সহজে কোন ছাঁচে  ফেলে যায় না। কোন ইজমে ফেলে তার  সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। প্রথাগত রাজনৈতিক সংগঠনের কাঠামোর মধ্যে তাকে আটকানো যায় না । বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বাম ও ডান সবারই অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু বাংলাদেশের পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে সবাই সংকটে তার উপরে আস্থা রাখতে চাইতেন । তার দরগায় গিয়ে আছড়ে পড়তেন। তিনি সঙ্গত সব জায়গায় হুংকার দিতে পিছ পা হতেন না ।  কারো করতলগত  হতেন না। এমন মানুষ বেখাপ্পা  ছাড়া আর কি? তাই এই পাঞ্জাবি পরা মানুষটির জন্য কম বেশি সবারই দরদ রয়েছে । আশা করছি একদিন জাতি উনার যথার্থ মূল্যায়ন দিতে সক্ষম হবে ।


লেখকঃ ড.আজিজুল আম্বিয়া, কলাম লেখক ও গবেষক । email:azizul.ambya.yahoo.co.uk.

মতামত এর আরও খবর

img

দেশটা যাচ্ছে রসাতলে, আর আমরা ঠাঁই নিচ্ছি বাসার তলে! –হেঁটে চলা এক হতাশ নাগরিকের আর্তি

প্রকাশিত :  ১৬:৫৯, ২৯ মে ২০২৫

“দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে”—এই বাক্যটি এখন এতটাই পরিচিত এক প্রচারণায় পরিণত হয়েছে যে ঘুমের মধ্যেও শুনতে পাই। এতবার, এতভাবে বলা হয়েছে যে এখন মনে হয়—এ যেন সরকারের মুখে বাজতে থাকা একটি পুরোনো ক্যাসেটমাত্র। অথচ বাস্তব চিত্র কী? চলার মতো একটি সাইকেলও যেন এখন নাগালের বাইরে! যার গাড়ি আছে, সে ছুটছে হরিণের গতিতে; আর যার কিছুই নেই, সে বসে থাকে রাস্তার পাশের ফাটলে। এই বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে বলা যায়—দেশ কোনো মহাসড়কে নয়, বরং ধাবিত হচ্ছে রসাতলের দিকেই।

আমরা সাধারণ মানুষ। দিন গুনে, কষ্ট গুনে বেঁচে থাকি। আমাদের নেই ঝকঝকে গাড়ি, নেই সুগন্ধময় নীতিমালা। ঘাম ঝরাই, মাথা খাটাই, আর প্রতিদিন বাস্তবতার কাছে হেরে যাই। আমাদের স্বপ্ন ভাঙে, ব্যবসা ধসে পড়ে, তবুও থেমে থাকি না। কারণ কষ্ট আমাদের জীবনের রুটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আর দেশের যাঁরা ‘বিলিয়নিয়ার’, তাঁদের জীবন আবর্তিত হয় গলফ কোর্স, কফিশপ আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুম ঘিরে। আমাদের হাঁচি-কাশিও তাঁদের কাছে যেন একধরনের শব্দদূষণ।

আর প্রধান উপদেষ্টার কথা কী বলব? তাঁর দিনরাত কাটে উন্নয়নের অঙ্ক কষে। কোন প্রকল্পে কত কোটি টাকা যাবে, কোন বিদেশিকে কোন রঙের গালিচায় অভ্যর্থনা জানানো হবে—এসব নিয়েই তাঁর ব্যস্ততা। অথচ দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কীভাবে বাঁচছে, আদৌ বাঁচছে কি না—সেই খোঁজ তাঁর এজেন্ডায় নেই। তাঁর কাছে উন্নয়ন মানে শুধু টাকা-পয়সার হিসাব।

আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীরা এখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছি। দোকানের ভাড়া বাকি, কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না, পণ্য স্টকে জমে আছে—বিক্রি নেই। এমনকি পিঁপড়েও যদি দোকানে ঢুকে পড়ে, মনে হয়—চিনিটা অন্তত কেউ খেয়ে গেল! এটাই বা কম কী?

ব্যাংকে গেলেও আশার আলো নিভে যায়। ঋণের আবেদন করলেই বলা হয়—“ফাইন্যান্সিয়াল রিস্ট্রাকচারিং চলছে, স্যার।” অর্থাৎ—এখন কিছুই পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নিজেই বলছেন—দশটিরও বেশি ব্যাংক দেউলিয়ার পথে। তাহলে প্রশ্ন উঠে—আমরা যাব কোথায়? কোথায় সেই আশ্বাস, সেই নিরাপদ সঞ্চয়ের ভরসা?

এই দেশের আরেক অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য হলো—প্রত্যেকে যেন একেকজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী! চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কিংবা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দেশ ও উন্নয়ন নিয়ে বড় বড় তত্ত্ব দেন। কিন্তু বাস্তবায়নের সময় পাশে থাকেন না কেউ। উন্নয়নের ট্রেন কখনোই প্ল্যাটফর্মে আসে না—আমরা শুধু দাঁড়িয়ে থাকি আর চুল পাকতে দেখি। এমনকি মনে হয়, মেট্রোরেল ফরিদপুরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমরা কবরে চলে যাব।

আর পুঁজিবাজার? সেখানে এখন যা চলছে, তা দিয়ে একটি ‘হরর-ট্র্যাজেডি’ সিনেমা বানানো সম্ভব! সূচক পড়ছে, আর বিনিয়োগকারীরা একে একে ফাঁদে পড়ছেন। এই বাজারের ভিত্তি কী? উত্তর আসে—“আস্থা।” আমরা বলি—“আস্থার স্টকটা কোথায়?”

এই বিপর্যয়ের অন্যতম রচয়িতা বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তাঁর একটি মাউস ক্লিকেই সূচক যেন তলানিতে নেমে যায়! পুঁজিবাজারের পতন এমনভাবে হচ্ছে, যেন আকাশে না-ওড়া ঘুড়িকেও কেউ গুলি করে নামিয়ে দিচ্ছে! অফিসের দরজায় নাকি লেখা থাকে—“Investor beware: Survival not guaranteed.”

অন্যদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেউদ্দিন আহমেদের ভাবনা এমন—উন্নয়নের প্রসঙ্গ উঠলেই বলেন, “দেখা যাবে, ভাবা যাবে; না হলেও সমস্যা নেই।” তাঁর এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উন্নয়ন নয়, বরং হতাশার এক করুণ চিত্রপটই আঁকা যায়।

আমরা যাঁদের জন্য দিনরাত খেটে যাচ্ছি, তাঁরা আমাদের কণ্ঠ শোনেন না। বড়লোকেরা কফির কাপ হাতে ভাবেন—“গরিব মানেই অলস।” তাঁরা জানেন না, আমরা প্রতিদিন সকালে দোকানের ঝাঁপ তুলি, বিক্রি না হলে রাতে স্ত্রীর চোখের জবাব দিই, সন্তানের স্কুল ফি বাকি রাখি—তবুও মন থেকে চেষ্টা থামাই না।

উন্নয়ন মানে শুধু বড় বড় প্রকল্প নয়। উন্নয়ন মানে হচ্ছে—একজন দোকানদার যেন দিনের শেষে হাঁফ ছেড়ে ঘুমাতে পারেন; একজন মা-বাবা যেন সন্তানের স্কুলের বেতন দিতে পারেন; একজন কর্মচারী যেন মাসের শেষে বেতন হাতে পান। এটাই উন্নয়নের মৌলিক রূপ।

আশার কথা হলো, এখনো কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা হার মানেননি। ঝড় এলেও তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন, কান্না গিলে হাসেন। তাঁরা দেশ ছাড়েন না, কারণ বিশ্বাস করেন—এই দেশ আমাদের, সাধারণ মানুষের। এই দেশ সরকারের নয়, উপদেষ্টাদের নয়, ধনীদেরও নয়—এই দেশটা আমাদের, যাঁরা কোনো ব্যালান্সশিটে নেই, কিন্তু কাঁধে করে দেশটাকে টেনে নিয়ে চলেছেন।

একদিন যদি এই দেশ ঘুরে দাঁড়ায়, তাহলে ইতিহাসে লেখা থাকবে—“এই দেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন সেই মানুষগুলো, যাঁদের গায়ে ঘাম ছিল, কিন্তু নাম ছিল না খবরে।”

আর যদি কিছুই না হয়, যদি সত্যিই দেশ রসাতলে যায়—তবুও অন্তত বলতে পারব, আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। যেমন ফুটপাতে বসে থাকা এক শিশুটি বলে—“আমরা তো খাটছি ভাই। যারা উপরে আছেন, তাঁরা যদি একটু নিচে তাকান, তাহলে হয়তো আমরাও বাঁচার একটা রাস্তা পাব।” আর যদি তাঁরা না তাকান, তাহলে আমাদেরই গড়তে হবে সেই পথ—হোক বাঁশের সাঁকো, হোক কাঁধে তুলে নেওয়া—আমরা চলতেই থাকব।