
বিকিরণ চিকিৎসাসেবা বন্ধ ধুঁকছেন ক্যান্সার রোগীরা

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ক্যান্সারের বিকিরণ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ছয়টি যন্ত্রের মধ্যে চারটি আগে থেকেই নষ্ট। বাকি দুটি যন্ত্রের একটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল, আরেকটিতে কোনোরকম সেবা দেওয়া হতো। এক সপ্তাহ ধরে সেই দুটি যন্ত্রও বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কার্যত সরকারি পর্যায়ের ক্যান্সার চিকিৎসায় বিকিরণ সেবা (রেডিওথেরাপি) বন্ধ হয়ে গেছে। সামর্থ্যবানদের একই সেবা পেতে বেসরকারি হাসপাতালে গুনতে হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ গুন বেশি টাকা। তবে দরিদ্র রোগীদের পক্ষে এই সেবা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে হাজার হাজার ক্যান্সার রোগী বিকিরণ না পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
গত ২১ ডিসেম্বর বিকেলে একটি বিকিরণ যন্ত্র নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ২২ ডিসেম্বর থেকে ওই যন্ত্রের সেবা বন্ধ রয়েছে। ওই যন্ত্রটি নষ্টের ঠিক এক দিন পর ২৩ ডিসেম্বর অবশিষ্ট যন্ত্রটিও বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিন থেকে মূলত ক্যান্সার হাসপাতালের বিকিরণ সেবা বন্ধ রয়েছে।
হাসপাতালের একটি সূত্র জানিয়েছে, যন্ত্র দুটির মেরামতের কাজ খুব ধীরগতিতে করা হচ্ছে। এভাবে কবে নাগাদ ঠিক হবে, তা অনিশ্চিত। একটা সময় দিনে ৭০০ থেকে ৮৫০ জন রোগীকে বিকিরণ সেবা দেওয়া হতো, চারটি যন্ত্র বিকল হওয়ার পর সেবা নেমে আসে ৮০ থেকে ১০০ জনে। দুটি বিকিরণ যন্ত্র চলমান অবস্থায় একজন রোগীকে একটি বিকিরণ সেবা পেতে প্রায় ছয় মাস অপেক্ষা করতে হতো। বর্তমানে তাদের কতদিন অপেক্ষা করতে হবে বা আদৌ সেবা পাবেন কি না, তা অনিশ্চিত।
যদিও জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, যন্ত্র দুটি দ্রুত ঠিক করার চেষ্টা চলছে। তবে হাসপাতালের একটি সূত্র বলছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিনের অবহেলা এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতার কারণেই দেশের দরিদ্র রোগীরা জীবন ঝুঁকিতে পড়েছেন।
হাসপাতালের বিকিরণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীর চাপ সামলাতে এই মুহূর্তে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে অন্তত ১০টি বিকিরণ যন্ত্র সচল রাখা প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে সচল কোনো যন্ত্র নেই। নতুন দুটি যন্ত্র স্থাপনের কাজ চলমান। তবে সব ঠিকমতো চললেও ২০২৫ সালের মার্চের আগে ওই যন্ত্রগুলো দিয়ে রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।
সরকরি পর্যায়ের বিকিরণ সেবা: সরকারি পর্যায়ে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বিকিরণ যন্ত্র ছয়টি। এর মধ্যে লিনিয়ার এক্সিলারিটের চারটি এবং কোবাল্ট-৬০ দুটি। যার সবগুলোই এখন বিকল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি, বগুড়া, ময়মনসিংহ, রংপুর ও বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি করে যন্ত্র থাকলেও সবকটি বর্তমানে বিকল। রাজশাহী, ফরিদপুর ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি করে লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্র থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে চট্টগ্রাম ও সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুটি যন্ত্র চলছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে বিকিরণ যন্ত্র যত নষ্ট হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় বসছে ততবেশি সংখ্যক যন্ত্র। কয়েক বছর আগেও তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে মাত্র চারটি যন্ত্র ছিল। বর্তমানে সেখানে ছয়টি হাসপাতালে ১৫টি বিকিরণ যন্ত্রে চলছে রমরমা ব্যবসা।
বেসরকারি হাসপাতালে যত যন্ত্র: বেসরকারি পর্যায়ে রাজধানীর ডেলটা হাসপাতালে বিকিরণ যন্ত্র আছে পাঁচটি। আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালে আছে তিনটি। ইউনাইটেড হাসপাতালে দুটি, ল্যাবএইড হাসপাতালে দুটি, সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে একটি যন্ত্র রয়েছে।
কোথায় কেমন ব্যয়: জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, এখানে কোবাল্ট-৬০ যন্ত্রে একবার রেডিও থেরাপি বা বিকিরণ সেবা বা একটি এক্সপোজার পেতে রোগীকে দিতে হয় মাত্র ১০০ টাকা। অন্যদিকে লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্রে থেরাপি নিতে দিতে হয় ২০০ টাকা। সব সরকারি হাসপাতালে একই খরচ। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালে রেডিওথেরাপির প্ল্যানিং ফি ৫০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা। অর্থাৎ একজন রোগীকে রেডিওথেরাপির একটি কোর্স সম্পন্ন করতে যদি ছয়বার থেরাপি নিতে হয়, তাহলে ব্যয় হবে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৫০০ টাকা।
অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে (কোবাল্ট-৬০) একই সেবা পেতে রোগীকে গুনতে হয় কমপক্ষে ৮৭ হাজার টাকা। প্রতি এক্সপোজার ২ হাজার ৫০০ টাকা, এর সঙ্গে প্ল্যানিং বাবদ ২৫ হাজার টাকা। একই থেরাপি লিনিয়ার এক্সিলারেটর যন্ত্রে পেতে হলে রোগীকে গুনতে হবে ১ লাখ ২২ হাজার টাকা।
বিশেষজ্ঞ মতামত: যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর গবেষণারত জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যান্সার রোগীদের চার ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। শল্যচিকিৎসা, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি ও হরমোন থেরাপি। বেশিরভাগ রোগীরই এ চার ধরনের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। নির্ধারিত সময়ে যদি কোনো একটার ব্যত্যয় ঘটে, সেক্ষেত্রে ক্যান্সার ফিরে আসে এবং রোগী মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েন। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে দ্য গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরির দেওয়া ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। এ রোগে মৃত্যু হয় ১ লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষের।
এ বিষয়ে ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোল্লা ওবায়েদুল্লাহ বাকী বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় কেনাকাটা সম্পন্ন করতে অনেক সময় লাগে। সব মিলিয়ে একটা স্থবিরতা তৈরি হয়। কেনাকাটার সঙ্গে অডিট আপত্তির বিষয়টিও সম্পৃক্ত। ফলে পরিচালকরা নিজ দায়িত্বে এগুলো করতে চান না। নষ্ট যন্ত্র তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক করতে হলে পরিচালককে ক্ষমতা দিতে হবে।