
ক্ষুধার জ্বালা -রেজুয়ান আহম্মেদ

ক্ষুধা—শুধু একটি শব্দ নয়, এটি এক চিরন্তন বাস্তবতা। এটি মানুষের শারীরিক ও মানসিক অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত একটি অনুভূতি। ক্ষুধা যখন তীব্র হয়ে ওঠে, তখন এটি আর শুধু একটি শারীরিক প্রয়োজন থাকে না; এটি হয়ে ওঠে জীবনের প্রতি এক নির্মম প্রশ্ন। ক্ষুধার জ্বালা আমাদের প্রয়োজনের গভীরতাকে প্রকাশ করে এবং মানব সমাজের অসাম্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
মানুষসহ পৃথিবীর প্রতিটি জীবের জন্য ক্ষুধা হলো এক স্বাভাবিক চাহিদা। ক্ষুধার তাগিদে পাখি সকালবেলা খাবারের সন্ধানে উড়ে যায়, বাঘ শিকার করে, আর মানুষ মাটি থেকে ফসল ফলায়। কিন্তু যখন এই প্রয়োজন মেটানোর উপায় সীমিত হয়ে পড়ে, তখন ক্ষুধা এক দুঃসহ যন্ত্রণায় রূপ নেয়। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ক্ষুধা মেটানোর এই সংগ্রামই সভ্যতার অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি।
ক্ষুধা কেবল শারীরিক দুর্বলতা সৃষ্টি করে না; এটি মানুষের মানসিক শক্তিকেও ভেঙে দেয়। ক্ষুধার্ত মানুষ অনেক সময় নৈতিকতা ভুলে যায়, ভালো-মন্দের বোধ হারিয়ে ফেলে। ক্ষুধার্ত পেটের সামনে মূল্যবোধ, ধর্ম, নীতিবোধ—সবই অর্থহীন হয়ে পড়ে।
মানব ইতিহাসের অনেক ভয়াবহ অধ্যায় ক্ষুধার জ্বালার সাক্ষ্য বহন করে। মধ্যযুগের দুর্ভিক্ষ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বন্দিশিবিরে ক্ষুধার্ত মানুষের করুণ চিত্র, কিংবা বাংলার ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর—এই সবকিছুই ক্ষুধার নির্মম রূপকে তুলে ধরে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘দুর্বোধ’ কবিতায় ক্ষুধার জ্বালা সম্পর্কে লেখেন:
\"ক্ষুধার লাগি ত্রিভুবনে ধরিয়া করো আড়ি,
দেখ যদি তোমার ক্ষুধার বসন জুটে তাহারও ঘাড়ে।\"
এই পংক্তি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ক্ষুধা কোনো একক ব্যক্তির সমস্যা নয়; এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।
ক্ষুধার জ্বালা কেবল দরিদ্রদের কষ্ট দেয় না; এটি সমাজের অসাম্যের একটি চিহ্ন। ধনী-গরিবের বৈষম্যের কারণে কেউ খাদ্যের অভাবে ভোগে, আবার কেউ অপচয়ের দায়ে অভিযুক্ত। আধুনিক পৃথিবীতে যেখানে একজনের খাবার নষ্ট হয়, সেখানে আরেকজন ক্ষুধার কারণে মৃত্যুবরণ করে।
মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে খাদ্যই সর্বাগ্রে। অথচ সমাজের একাংশ প্রতিদিন পর্যাপ্ত খাবার পায় না। এই বৈষম্যের কারণে ক্ষুধা মানবতার লজ্জার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
ক্ষুধা মেটানোর সংগ্রাম কেবল ব্যক্তিগত নয়; এটি একটি সামাজিক দায়িত্ব। যে সমাজ ক্ষুধার্তদের জন্য ব্যবস্থা করতে পারে না, সে সমাজ তার মানবতাকেই অস্বীকার করে। ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া কেবল দানের কাজ নয়; এটি একটি মানবিক কর্তব্য।
লালন সাঁই তাঁর গানে বলেছেন:
\"খায়া দায়া পইড়ে থাকিস, ক্ষুধায় কেউ করে মরে।
একতারে তোর ধর্মসুখী হইল কোথায়রে?\"
এই পংক্তি আমাদের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করার অর্থ শুধু খাদ্য বিতরণ নয়; বরং সমাজের সম্পদকে সুষমভাবে বণ্টন করা।
ক্ষুধা কেবল দুর্বলতা সৃষ্টি করে না; কখনো কখনো এটি সৃষ্টিশীলতার উন্মেষ ঘটায়। অনেক সাহিত্যিক, কবি, শিল্পী তাঁদের ক্ষুধার জ্বালাকে সৃষ্টিশীলতার রূপ দিয়েছেন। কাফকার ‘ক্ষুধার্ত শিল্পী’ বা জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ক্ষুধার একটি গভীর রূপ উঠে এসেছে।
ক্ষুধা একটি শাশ্বত বাস্তবতা, কিন্তু এর মুক্তি সম্ভব। আমাদের সমাজ যদি সুষমভাবে সম্পদ বণ্টন করতে পারে, যদি প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো যায়, তবে ক্ষুধার জ্বালা লাঘব করা সম্ভব।
ক্ষুধার জ্বালা শুধু শারীরিক নয়; এটি মানুষের আত্মাকে আঘাত করে। তাই, এই দুঃখ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে বের করাই মানবতার অন্যতম বড় দায়িত্ব। ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর মধ্যে নিহিত আছে জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য।