
ভাইরাসের অভিশাপ!

রেজুয়ান আহম্মেদ
হেমন্তের সন্ধ্যা। পাতাঝরার শব্দে প্রকৃতির নীরব সংগীত বেজে চলেছে। একসময়কার ব্যস্ত শহর মধুমালা আজ যেন হারিয়ে গেছে এক অজানা শঙ্কার গভীরে। আকাশে অসংখ্য তারা, কিন্তু মাটির পৃথিবীতে মানুষের মনে শুধুই অন্ধকার। ক’দিন ধরেই একটি অদ্ভুত ঘটনা চারদিকে আলোড়ন তুলেছে। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, একটি নতুন ধরনের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। কারও মুখে সঠিক তথ্য নেই, তবে ভয়টা যেন সবখানে।
রাহুল, একজন তরুণ বিজ্ঞানী, তার ল্যাবরেটরিতে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করে। ভাইরাস নিয়ে তার গবেষণা নতুন কিছু নয়, কিন্তু এবারের বিষয়টা তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। একের পর এক তথ্য জোগাড় হচ্ছে, কিন্তু সমাধানের পথ এখনও অজানা। তার সহকর্মী সোফি, একজন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ, তার মতোই ব্যস্ত। তাদের গবেষণাগারে প্রতিদিনই নতুন নমুনা আসে, কিন্তু প্রতিটি নমুনার পেছনে লুকিয়ে থাকে এক নতুন ধাঁধা।
রাহুল জানত, ভাইরাসের উৎপত্তি খুঁজে বের করা সহজ নয়। হয়তো কোনো বন্যপ্রাণী থেকে এটি মানুষের শরীরে এসেছে, হয়তো জলবায়ুর পরিবর্তন এই সংক্রমণকে সহজতর করেছে। সোফি একদিন তাকে বলেছিল, “রাহুল, আমরা জানি না সামনে কী অপেক্ষা করছে। তবে একটা কথা নিশ্চিত, যদি আমরা দ্রুত কিছু না করি, তবে মানব সভ্যতা এক নতুন সংকটের মুখে পড়বে।”
সেই রাতের কথা রাহুল ভুলতে পারে না। এক অদ্ভুত শীতলতা যেন তার মনের ভেতর ঢুকে বসেছিল। নতুন ভাইরাসটি অদ্ভুতভাবে দ্রুত মিউটেট করছে। একেক দিন একেক ভেরিয়েন্ট। কোনো লক্ষণ নেই, কোনো প্রতিরোধ নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিরা বুঝতেই পারছে না, তারা কতটা বিপদের মধ্যে আছে।
মধুমালা শহরে ভাইরাসের প্রভাব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করল। প্রথমে পাখিদের আচরণে পরিবর্তন দেখা গেল। গাছের ডালে বসে থাকা নিরীহ পাখিরা হঠাৎ করে একে অপরকে আক্রমণ করতে লাগল। পশু আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা গরু-ছাগলও অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করল। এবং তারপর, মানুষের শরীরেও এর প্রভাব ধরা পড়ল।
রাহুল এবং তার দল দ্রুত কাজ শুরু করল। তারা জানত, ভাইরাসটির উৎস যদি খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। একদিন সোফি একটি নমুনা নিয়ে এলো। এটি ছিল এক পাখির রক্ত থেকে পাওয়া ভাইরাস। পরীক্ষা করে তারা বুঝতে পারল, এই ভাইরাসটি একটি প্রাকৃতিক ভাইরাস নয়। এর জিনগত গঠন এমন যে এটি মানুষের শরীরে সহজেই প্রবেশ করতে পারে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ দুর্বল করে দিতে পারে।
ভাইরাসটির এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য রাহুলকে ভাবিয়ে তুলল। “এটা কি প্রকৃতির প্রতিশোধ?”—রাহুল একদিন সোফিকে বলল। “প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারিয়েছে। আমাদের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ হয়তো এই ভাইরাসকে জন্ম দিয়েছে।” সোফি মাথা নেড়ে বলল, “হয়তো। তবে আমাদের কাজ এই প্রতিশোধের শেষ সীমা টেনে দেওয়া।”
রাহুল এবং তার দল একের পর এক পরীক্ষা চালাতে লাগল। কিন্তু ভাইরাসটির প্রতিরোধ গড়ে তোলা সহজ ছিল না। প্রতিদিনই নতুন কোনো মিউটেশনের খবর আসত। একদিন তারা জানতে পারল, ভাইরাসটির একটি নতুন ভেরিয়েন্ট মানুষের শরীরের শক্তি শোষণ করে, এবং এটি এমনভাবে কাজ করে যেন আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুই টের পায় না।
এরই মধ্যে মধুমালার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেল। হাসপাতালগুলো রোগীতে উপচে পড়ল। আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রাথমিকভাবে সুস্থ মনে হলেও, কয়েকদিনের মধ্যেই তাদের শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করল। এই দৃশ্য দেখে রাহুলের মন ভেঙে যাচ্ছিল।
একদিন রাতে রাহুল একা বসে ছিল তার ল্যাবরেটরিতে। হঠাৎ করেই একটি চিন্তা তার মাথায় এলো। “ভাইরাসটি যদি এত দ্রুত মিউটেশন করে, তবে কি আমরাও আমাদের প্রযুক্তিকে তত দ্রুত পরিবর্তন করতে পারি না?” সে তার কম্পিউটারে বসে নতুন একটি মডেল তৈরি করতে শুরু করল।
পরের দিন, সোফিকে সে তার আইডিয়া বোঝাল। “আমরা যদি ভাইরাসটির প্রতিরোধ ব্যবস্থা না গড়তে পারি, তবে আমাদের উচিত একটি প্রতিরোধী জিন তৈরি করা, যা ভাইরাসের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করবে। এটি হবে মানব শরীরের জন্য একটি সুরক্ষার আবরণ।”
সোফি এবং তার দল এই প্রস্তাবে একমত হল। তারা দ্রুত কাজ শুরু করল। রাহুল জানত, সময় অতি সীমিত। প্রতিদিনই নতুন কোনো ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার বিশ্বাস ছিল, মানুষ প্রকৃতির শক্তির চেয়ে বড়।
মাসখানেক পর, তারা একটি প্রতিরোধী জিন তৈরি করতে সক্ষম হল। এটি ভাইরাসটির প্রতিটি মিউটেশনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা রাখে। মধুমালার মানুষদের ওপর এটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হল। এবং ধীরে ধীরে, শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করল।
রাহুল জানত, এটাই শেষ নয়। ভাইরাসের যুদ্ধ চলতেই থাকবে। তবে সে এটাও জানত, মানুষের মনের শক্তি, বিজ্ঞান আর ঐক্যের মাধ্যমে সবকিছু জয় করা সম্ভব।
সেই সন্ধ্যায়, রাহুল আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারাদের আলোয় ভরা আকাশ যেন তাকে নতুন এক প্রত্যয় দিচ্ছে। “আমরা পারব,”—সে মনে মনে বলল। “আমরা পৃথিবীকে বাঁচাব। কারণ আমরা মানুষ, আর আমরা কখনো হার মানি না।”