
স্বার্থপরতার আড়ালে মানুষ

রেজুয়ান আহম্মেদ
রাতের অন্ধকারে কুয়াশায় ঢাকা শহর। নিঃসঙ্গ একটি রিকশা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। রিকশাচালক হরিদাস ক্লান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, “আজকের দিনটা শেষ হলো। কাল আবার নতুন করে শুরু হবে এই লড়াই।” তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নিজের সন্তানদের মুখ। বড় মেয়ে রাধা—এবার তার নতুন বইয়ের খরচ, আর ছোট ছেলে দীপক—স্কুলের বেতন এখনো বাকি।
কিছুটা দূরে একটি বিলাসবহুল গাড়ি থেমে আছে। গাড়ির ভেতরে বসা রায়হান, এক বিশাল ব্যবসায়ী। আজকের দিনে একটি বড় চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। রায়হানের মনের কোণে এক ধরনের স্বস্তি—ব্যবসায় আরও বড় মুনাফা আসবে। কিন্তু তার মনের গভীরে কোথাও যেন এক ধরনের অস্বস্তিও কাজ করছে। তার সামনে দিয়ে এক বয়স্ক ভিক্ষুক হেঁটে যাচ্ছে। ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকটি কাঁপা হাতে একটি পুরোনো শাল জড়িয়ে রেখেছে। রায়হান একটু নড়ে বসল। ভিক্ষুককে কিছু দিতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু এক মুহূর্তেই সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “আমার কি এত সময় আছে?”
হরিদাস আর রায়হান—দু’জনই দুই ভিন্ন জগতে বাস করে। একজন প্রতিদিন নিজের ক্ষুধার্ত পরিবারকে বাঁচানোর লড়াইয়ে ব্যস্ত, আর অন্যজন নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে। কিন্তু দু’জনের মধ্যে একটি গভীর মিল রয়েছে। দু’জনেই স্বার্থপর, নিজেদের জীবনের দায়িত্ব নিজেরাই নিতে চায়। হরিদাসের স্বার্থ তার সন্তানের সুখে, আর রায়হানের স্বার্থ তার ব্যবসার সাফল্যে।
হরিদাসের জীবনের প্রতিটি দিন একটি চাহিদা নিয়ে কাটে—পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়া। একদিন রাতে রিকশায় একজন যাত্রী উঠল। যাত্রীর কাছে একটি মোবাইল ফোন ছিল। হঠাৎ ফোনটি ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায়। হরিদাস সেটা তুলে নিল। তখন তার মনে এক দ্বন্দ্ব শুরু হলো। ফোনটা ফেরত দিলে কিছুই পাবে না। কিন্তু রেখে দিলে হয়তো বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় হবে।
অন্যদিকে, রায়হানের জীবনেও ঠিক এমন একটি দ্বন্দ্ব। একটি বড় চুক্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির কৌশল ফাঁস হয়ে গেছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে ব্যবসার সুযোগ বাড়ানো সহজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এটা কি সঠিক কাজ হবে?
মানুষের এই অস্তিত্বের লড়াই যেন স্বার্থপরতার শেকড়। হরিদাস আর রায়হান দু’জনেই জীবনের এই জটিলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
হরিদাস ফোনটি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তার ভেতরে যে লোভ কাজ করছিল, সেটাকে সে হার মানিয়েছে। তবে এই মানবিক আচরণও এক ধরনের স্বার্থপরতা। সে জানে, অন্যের জিনিস নিজের কাছে রেখে দিলে তার মনে একটি ভার জমা হবে, যা তার সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
রায়হানও ঠিক একইভাবে নিজের ব্যবসার তথ্য সঠিকভাবে ব্যবহার করে। প্রতিদ্বন্দ্বীর গোপন তথ্য সে ব্যবহার করেনি। কারণ, তার নিজের সম্মানের কাছে এই লোভ হার মানে।
মানুষের স্বার্থপরতার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। রায়হানের এক সহযোগী, তার নিজের ভাই, তাকে প্রতারণা করে। বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়। তখন রায়হানের মনে প্রশ্ন জাগে, “আমার নিজের মানুষই যদি এভাবে আমাকে ফাঁকি দেয়, তবে কি আমি ভুল পথে আছি?”
হরিদাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। একদিন সে নিজের পুরোনো বন্ধু রতনের থেকে কিছু টাকা ধার চেয়েছিল। কিন্তু রতন তার স্বার্থের জন্য সেই টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন হরিদাসের চোখে ভরসার আলো নিভে যায়।
মানুষের স্বার্থপরতা শুধু নেতিবাচক নয়। হরিদাস যখন নিজের সন্তানদের জন্য নিরন্তর কাজ করে, তার পরিশ্রমই তার সন্তানদের জীবন গড়ে তোলে। রাধা লেখাপড়ায় ভালো করছে। তার মেধা আর বাবার ত্যাগ একদিন সমাজে আলো ছড়াবে।
রায়হানও তার ব্যবসা বাড়ানোর সময় অনেক চাকরির সুযোগ তৈরি করেছে। তার কারখানায় কাজ করে অনেক অসহায় মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। তার এই স্বার্থপর উদ্যোগ একসময়ে সামাজিক উন্নয়নে রূপান্তরিত হয়েছে।
মানুষ স্বার্থপর, কিন্তু এই স্বার্থপরতার গভীরে মানবিকতার এক শক্তিশালী ধারা প্রবাহিত। হরিদাস আর রায়হানের জীবন দুটো ভিন্ন পথে এগোলেও তাদের স্বার্থের গভীরে একটাই উদ্দেশ্য—নিজেদের এবং অন্যদের ভালো রাখা।
মানুষ স্বার্থপর। কিন্তু এই স্বার্থপরতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করলে তা শুধু নিজের নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে কাজ করে। গল্পের শেষে হরিদাস আর রায়হানের পথ এক মুহূর্তের জন্য মিলিত হয়। তারা একে অপরকে চিনে না, কিন্তু তাদের স্বার্থপরতা থেকে জন্ম নেওয়া মানবিকতাই তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সংযোগ গড়ে তোলে।
“মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা অরণ্য,” যেখানে একদিকে রয়েছে লোভ আর অন্যদিকে রয়েছে ত্যাগ। এই অরণ্যের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শিখলেই মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে ওঠে।