img

স্বার্থপরতার আড়ালে মানুষ

প্রকাশিত :  ১৮:৩৩, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ২০:২১, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

স্বার্থপরতার আড়ালে মানুষ

রেজুয়ান আহম্মেদ

রাতের অন্ধকারে কুয়াশায় ঢাকা শহর। নিঃসঙ্গ একটি রিকশা রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে। রিকশাচালক হরিদাস ক্লান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, “আজকের দিনটা শেষ হলো। কাল আবার নতুন করে শুরু হবে এই লড়াই।” তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে নিজের সন্তানদের মুখ। বড় মেয়ে রাধা—এবার তার নতুন বইয়ের খরচ, আর ছোট ছেলে দীপক—স্কুলের বেতন এখনো বাকি।

কিছুটা দূরে একটি বিলাসবহুল গাড়ি থেমে আছে। গাড়ির ভেতরে বসা রায়হান, এক বিশাল ব্যবসায়ী। আজকের দিনে একটি বড় চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। রায়হানের মনের কোণে এক ধরনের স্বস্তি—ব্যবসায় আরও বড় মুনাফা আসবে। কিন্তু তার মনের গভীরে কোথাও যেন এক ধরনের অস্বস্তিও কাজ করছে। তার সামনে দিয়ে এক বয়স্ক ভিক্ষুক হেঁটে যাচ্ছে। ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকটি কাঁপা হাতে একটি পুরোনো শাল জড়িয়ে রেখেছে। রায়হান একটু নড়ে বসল। ভিক্ষুককে কিছু দিতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু এক মুহূর্তেই সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “আমার কি এত সময় আছে?”

হরিদাস আর রায়হান—দু’জনই দুই ভিন্ন জগতে বাস করে। একজন প্রতিদিন নিজের ক্ষুধার্ত পরিবারকে বাঁচানোর লড়াইয়ে ব্যস্ত, আর অন্যজন নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নে। কিন্তু দু’জনের মধ্যে একটি গভীর মিল রয়েছে। দু’জনেই স্বার্থপর, নিজেদের জীবনের দায়িত্ব নিজেরাই নিতে চায়। হরিদাসের স্বার্থ তার সন্তানের সুখে, আর রায়হানের স্বার্থ তার ব্যবসার সাফল্যে।

হরিদাসের জীবনের প্রতিটি দিন একটি চাহিদা নিয়ে কাটে—পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়া। একদিন রাতে রিকশায় একজন যাত্রী উঠল। যাত্রীর কাছে একটি মোবাইল ফোন ছিল। হঠাৎ ফোনটি ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায়। হরিদাস সেটা তুলে নিল। তখন তার মনে এক দ্বন্দ্ব শুরু হলো। ফোনটা ফেরত দিলে কিছুই পাবে না। কিন্তু রেখে দিলে হয়তো বিক্রি করে কিছু টাকা জোগাড় হবে।

অন্যদিকে, রায়হানের জীবনেও ঠিক এমন একটি দ্বন্দ্ব। একটি বড় চুক্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির কৌশল ফাঁস হয়ে গেছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে ব্যবসার সুযোগ বাড়ানো সহজ। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এটা কি সঠিক কাজ হবে?

মানুষের এই অস্তিত্বের লড়াই যেন স্বার্থপরতার শেকড়। হরিদাস আর রায়হান দু’জনেই জীবনের এই জটিলতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।

হরিদাস ফোনটি ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তার ভেতরে যে লোভ কাজ করছিল, সেটাকে সে হার মানিয়েছে। তবে এই মানবিক আচরণও এক ধরনের স্বার্থপরতা। সে জানে, অন্যের জিনিস নিজের কাছে রেখে দিলে তার মনে একটি ভার জমা হবে, যা তার সুখের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।

রায়হানও ঠিক একইভাবে নিজের ব্যবসার তথ্য সঠিকভাবে ব্যবহার করে। প্রতিদ্বন্দ্বীর গোপন তথ্য সে ব্যবহার করেনি। কারণ, তার নিজের সম্মানের কাছে এই লোভ হার মানে।

মানুষের স্বার্থপরতার নেতিবাচক দিকও রয়েছে। রায়হানের এক সহযোগী, তার নিজের ভাই, তাকে প্রতারণা করে। বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যায়। তখন রায়হানের মনে প্রশ্ন জাগে, “আমার নিজের মানুষই যদি এভাবে আমাকে ফাঁকি দেয়, তবে কি আমি ভুল পথে আছি?”

হরিদাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। একদিন সে নিজের পুরোনো বন্ধু রতনের থেকে কিছু টাকা ধার চেয়েছিল। কিন্তু রতন তার স্বার্থের জন্য সেই টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন হরিদাসের চোখে ভরসার আলো নিভে যায়।

মানুষের স্বার্থপরতা শুধু নেতিবাচক নয়। হরিদাস যখন নিজের সন্তানদের জন্য নিরন্তর কাজ করে, তার পরিশ্রমই তার সন্তানদের জীবন গড়ে তোলে। রাধা লেখাপড়ায় ভালো করছে। তার মেধা আর বাবার ত্যাগ একদিন সমাজে আলো ছড়াবে।

রায়হানও তার ব্যবসা বাড়ানোর সময় অনেক চাকরির সুযোগ তৈরি করেছে। তার কারখানায় কাজ করে অনেক অসহায় মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। তার এই স্বার্থপর উদ্যোগ একসময়ে সামাজিক উন্নয়নে রূপান্তরিত হয়েছে।

মানুষ স্বার্থপর, কিন্তু এই স্বার্থপরতার গভীরে মানবিকতার এক শক্তিশালী ধারা প্রবাহিত। হরিদাস আর রায়হানের জীবন দুটো ভিন্ন পথে এগোলেও তাদের স্বার্থের গভীরে একটাই উদ্দেশ্য—নিজেদের এবং অন্যদের ভালো রাখা।

মানুষ স্বার্থপর। কিন্তু এই স্বার্থপরতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করলে তা শুধু নিজের নয়, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে কাজ করে। গল্পের শেষে হরিদাস আর রায়হানের পথ এক মুহূর্তের জন্য মিলিত হয়। তারা একে অপরকে চিনে না, কিন্তু তাদের স্বার্থপরতা থেকে জন্ম নেওয়া মানবিকতাই তাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সংযোগ গড়ে তোলে।

“মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা অরণ্য,” যেখানে একদিকে রয়েছে লোভ আর অন্যদিকে রয়েছে ত্যাগ। এই অরণ্যের ভেতর দিয়ে হাঁটতে শিখলেই মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষ হয়ে ওঠে।

img

বংশের পরিচয়!

প্রকাশিত :  ১২:০০, ১২ মে ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

আষাঢ়ের এক ভিজে বিকেল। আকাশের গর্জন থেমে গেছে বটে, কিন্তু বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। উঠোনে জমে আছে নিঃশব্দতা। দূরের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গান—যেন সময় থেমে গেছে, কিংবা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।  

রতন মাস্টার বসে আছেন পুরোনো আমগাছটার ছায়ায়। হাতে নাইলনের সুতো, বাঁধছেন মাছ ধরার জাল। দেখে মনে হয়, এই জালের ফাঁকেই তিনি বুনে চলেছেন জীবনের গল্প—ভাঙা স্বপ্ন, না বলা কথা, হারিয়ে যাওয়া সময় আর কিছু গোপন কষ্ট।  

ঠিক এমন সময়, গ্রামের পেছনের কাদা-ঢালা পথ বেয়ে এসে দাঁড়াল সজল। আধময়লা ছেঁড়া জিন্স, হাঁটুর কাছ থেকে ঝুলে থাকা ইয়ারফোনের তার, আর চোখজোড়া যেন কিছু হারানোর গ্লানিতে ঘোলাটে।  

সে আমগাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, একটু নিচু গলায় বলল,  

— “মাস্টার চাচা... শহরের বন্ধুরা মজা করে বলে ‘রংপুরের মফিজ’। তাদের পূর্বপুরুষরা কেউ জমিদার, কেউ ব্যারিস্টার। আর আমার শিকড় তো চাষার ঘরে...”

রতন মাস্টার চশমাটা একটু উঁচু করে তাকালেন। চোখের কোণায় বয়সের ভাঁজ হলেও, দৃষ্টিতে ছিল একরাশ কোমলতা। ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললেন,  

— “চা খাবি সজল? পাতলা লেবু চা, না কি গাঢ় দুধ চা?”

সজলের গলা কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল,  

— “যে চায়ের কাপে বংশের গরিমার সুবাস থাকে, সেই চা চাই…”

রতন মাস্টার জালটা থামিয়ে পাশে রাখলেন। একটু নীরব হয়ে বললেন,  

— “আয়, আজ তোকে একটা গল্প শোনাই। এক চাষার গল্প, যার হাতে ছিল না জমিদারি দলিল, কিন্তু মুঠোয় ছিল বিশুদ্ধ স্বপ্ন আর সৎ ইচ্ছে।” 

এ গল্প আসলে তাঁর নিজের—রতন মাস্টারের। মাটির ঘরে জন্ম তাঁর, টিনের চাল ভেদ করে বৃষ্টির পানি যে ঘরে প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে দিত। বাবা শিবু মণ্ডল, গরিব কৃষক; আধ বিঘা জমি, আর সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। মা পদ্মা দেবী রোজ ভোরে বলে উঠতেন,  

— “মানুষের উপকার করিস রতন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তো সবচেয়ে বড় ধর্ম।”

রতনের বয়স তখন বারো, সেদিনই তাঁর বাবা না-ফেরার দেশে চলে যান। সেই ছোট্ট কাঁধে সংসারের ভার। গরুর পিঠে চড়ে দুধ বিক্রি করতেন সকালে, আর রাতে স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে পড়তেন। পাড়ার ছেলেরা হাসত, বলত—“দুধওয়ালা পণ্ডিত!” 

রতন হেসে বলত, “এক গরু দিচ্ছে শরীরের শক্তি, আরেকটা মনকে দিচ্ছে জ্ঞানের আলো—দুটোই দরকার মানুষ বাঁচাতে।”

একবার পরীক্ষার হলে সবাই নকল করছে। রতন সাদা খাতা জমা দেয়। শিক্ষক রেগে গিয়ে বললেন, “তুই ফেল করলি!”  

রতনের জবাব ছিল—“খাতায় ফেল, কিন্তু বিবেকের খাতায় তো একশো!” 

দিন গড়াতে গড়াতে তাঁর পাঠশালায় ভিড় বাড়ে। গরিব, অনাথ, পথশিশু—সবাই তাঁর ছাত্র। একদিন গ্রামের চেয়ারম্যান ঠাট্টা করে বললেন, “চাষার ঘরে জন্ম নিয়ে এত পড়া শিখে কী করবি?”

রতনের উত্তর ছিল, “জন্ম তো আমার হাতে ছিল না। কিন্তু আমি মানুষের মতো মানুষ হবো, এটা আমার সিদ্ধান্ত!”

মুসলিম-হিন্দু, জাত-পাত তাঁর কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঈদের সকালে গোপাল কাকার বাড়ি গিয়ে হাতে মিষ্টি তুলে দিতেন, আবার দুর্গাপূজায় মুসলিম ছেলেদের সাথে মিলে মণ্ডপে আলপনা আঁকতেন।  

একবার মন্দিরে আগুন ধরলে, তিনি দৌড়ে ঢুকে যান আগুনে। হাত পুড়ে গেলেও মুখে শুধু বললেন, “মানুষের ধর্মে আগুন লাগলে, পানি ঢালাটাই তো আমার কাজ।”

একদিন এক রাজনীতিবিদ এলেন ভোট চাইতে। রতন জিজ্ঞেস করলেন, “গ্রামের সেই অন্ধ মা যার চোখে অস্ত্রোপচারের টাকা নেই, আপনি কি তাঁর জন্য কিছু করেছেন?”

তিন দিন পর রাজনীতিবিদ এসে প্রণাম করে বললেন, “আপনি শিখিয়ে দিলেন, রাজনীতি মানে পকেট ভরা না, হৃদয় ভরা!”

সজল নীরবে শুনছিল। সেদিন থেকে তার ভেতরটা বদলে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও আর শহরের চাকরির পেছনে ছুটল না। গড়ে তুলল ‘মাটির পাঠশালা’। সেখানে এখন রাস্তার শিশুরা শেখে অক্ষর চিনতে, আর স্বপ্ন দেখতে। রতনের কথা সে লিখে রেখেছে ডায়েরির প্রথম পাতায়—  

“বংশের পরিচয় রক্তে নয়, কর্মে।” 

পঁচিশ বছর কেটে গেছে...  

গ্রামের মেলায় মাইক হাতে সজল দাঁড়িয়ে বলছে,  

— “আমার পেছনে নেই জমিদার বংশ, নেই ইতিহাসের ভারি গরিমা। আছে এক মাটির মানুষ, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন—মানুষের পরিচয় তার আদর্শে, তার কাজে।”

মাঠজুড়ে করতালির শব্দ। ছাপড়া ঘর থেকে হেঁটে এলেন এক বৃদ্ধ—রতন মাস্টার। পায়ের জুতা নেই, কিন্তু চোখে জল। গ্রামের মানুষ চিৎকার করে উঠল,  

— “এই তো আমাদের গর্ব, আমাদের বংশ!”  

রতন মাস্টার চোখ মুছে শুধু বললেন,  

— “বংশ মানে জন্ম নয়। বংশ মানে নদীর মতো হওয়া—নিজের পথ নিজেই বানিয়ে, সবার পিপাসা মেটানো।”

তোমার জন্ম হয়তো মাটির ঘরে, কিন্তু কর্ম যদি হয় আকাশ ছোঁয়া, তবে সেই কর্মই তোমার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। কারণ, সত্যিকারের বংশ পরিচয় রক্তে নয়—আদর্শে।