img

গাছে ফুল নয়, ফুটছে লাশ: গণিত ভবনের মেধাবী ছাত্রের আত্মহননের শোকগাথা!

প্রকাশিত :  ১৭:৪৭, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

গাছে ফুল নয়, ফুটছে লাশ: গণিত ভবনের মেধাবী ছাত্রের আত্মহননের শোকগাথা!

রেজুয়ান আহম্মেদ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র গণিত ভবন, যেখানে একসময় জ্যামিতি আর ক্যালকুলাসের জটিল সমীকরণে মেধাবীরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনত, আজ সেই ভবন নিস্তব্ধ। গাছের শাখায় ঝুলে থাকা একটি তরুণ জীবনের নিথর দেহ কেবল একটি প্রশ্নই বারবার সামনে নিয়ে আসে—\"কেন আমরা ব্যর্থ হলাম?\"

এই মৃত্যুর কালো ছায়া শুধু এক পরিবারের নয়, গোটা ক্যাম্পাসের বুকে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। যে ক্যাম্পাস একসময় তরুণদের কোলাহল, স্বপ্ন আর উৎসবের রঙে ভরপুর ছিল, তা আজ শোক আর হাহাকারে মোড়ানো। গণিত ভবনের প্রতিটি দেয়াল আজ যেন সাক্ষী—কীভাবে অমানবিক প্রতিযোগিতা আর সহানুভূতির অভাব এক মেধাবী জীবনকে শেষ করে দিল।

একটি স্বপ্নের শেষ অধ্যায়:

পরীক্ষার ফলাফল কি একটি জীবনের সমাপ্তি ঘটাতে পারে? পরিবার, বন্ধু, শিক্ষক সবাই মিলে যে তরুণের জীবনে স্বপ্নের বীজ বুনেছিল, সেই জীবন এভাবে নিভে যেতে পারে? প্রতিযোগিতা আর সামাজিক চাপ যেন ধীরে ধীরে আমাদের তরুণদের শিকড়টিই দুর্বল করে দিচ্ছে।

সেই ছাত্রটি যিনি একদিন গণিত ভবনের ক্লাসরুমে মনোযোগ দিয়ে লেকচার নিতেন, তার নোটগুলো আজ অনাথ হয়ে পড়ে আছে টেবিলে। গণিতের সমীকরণ আজ তার কাছেও যেন জটিল থেকে জটিলতর। অথচ প্রশ্নটি খুব সহজ—\"কেন?\"

কেন এই ব্যর্থতা?

বিশ্ববিদ্যালয় কি সত্যিই শুধু জ্ঞানচর্চার স্থান? নাকি এটি একটি নির্মম প্রতিযোগিতার অঙ্গন, যেখানে জীবনের মূল্য শূন্যে নেমে আসে? এই নির্মম বাস্তবতা আমাদের সমাজের গভীর সমস্যা তুলে ধরে। প্রতিযোগিতা যদি মানবিকতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়, তাহলে সেই সমাজ তরুণদের স্বপ্ন নয়, কেবল হতাশার বীজ বুনতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল, ক্লাসরুমের বেঞ্চ, করিডোরের প্রতিটি কোণ জানে সেই মেধাবী ছাত্রের গল্প। কিন্তু তার কষ্ট, তার নিঃসঙ্গতা কেউই বুঝতে চায়নি।

শোক নয়, সমাধান চাই:

আজ ক্যাম্পাসের প্রতিটি গাছ যেন আরেকটি প্রশ্ন করে—\"কবে আমরা শুনবো এই কান্নার ভাষা?\" এই তরুণ জীবনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে, পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি রাষ্ট্রের পর্যায়ে, আমাদের আরও মানবিক হতে হবে। প্রতিটি জীবনই অমূল্য, প্রতিটি স্বপ্নই পবিত্র।

শেষ কথা:

গাছে লাশ নয়, ফুটুক ফুল। প্রতিটি তরুণের জীবনকে সযত্নে লালন করতে হবে। এমন এক দিনের প্রত্যাশা করি, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী জীবনকে ভালোবাসবে, হতাশায় হারিয়ে যাবে না।

এই মৃত্যুর শোকগাথা যেন আমাদের সমাজের বিবেককে জাগিয়ে তোলে। আমাদের এখনই বদলাতে হবে নিজেদের। লাশের বদলে ফুল ফুটানোর অঙ্গীকার করতে হবে।





রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম
img

ঈদ যখন কাঁদে অভাবের কাছে: উৎসবের আলো আর অন্ধকারের গল্প

প্রকাশিত :  ০৫:৩০, ০৮ জুন ২০২৫

ঈদের নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট শিশুর হাসিমাখা মুখ, নতুন জামার রঙ, বাজারের কোলাহল, সুগন্ধে ভরা রান্নাঘর আর পরিবারজুড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা। মনে হয়, এ যেন এক মিলনের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব—মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক মহা-উপলক্ষ।

কিন্তু একটু ভাবুন—এই উৎসব কি সবার জন্য একই রকম আনন্দ বয়ে আনে?

ঈদের পেছনের সেই নিঃশব্দ কান্না

আমরা অনেকেই ঈদের আগে বাজারে যাই, জামাকাপড় কিনি, খাবারদাবারে ঘর সাজাই, ছবি তুলে পোস্ট দিই—সবই স্বাভাবিক আনন্দের অংশ। কিন্তু আমাদের আশপাশেই এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ঈদের আগের রাতে জানে না, পরদিন সকালে তাদের শিশুটি আদৌ কিছু খেতে পাবে কি না।

তারা ফেসবুকে অন্যদের ছবিতে ঈদের রঙ দেখে, ছেলেমেয়েদের হাসিমুখ দেখে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আমেজটা গায়ে মাখার চেষ্টা করে—কিন্তু মনে মনে ভেঙে পড়ে।

একজন মা যখন সন্তানের নতুন জামার আবদার শুনে চুপ করে থাকেন, চোখের জল আড়াল করতে রান্নাঘরে চলে যান—তখন ঈদের আনন্দ তার কাছে হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য বোঝা।

তিনি বলেন, “কাল পাবে বাবা, কাল পাবে”—এই ‘কাল’ যে কবে আসবে, তিনি নিজেও জানেন না। তবু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করাটাই যেন তার ঈদের একমাত্র প্রস্তুতি।

রিকশাচালক বাবার সন্ধ্যা

রিকশা চালানো মানুষটি ঈদের দিনেও রাস্তায় থাকেন—কারণ এই দিনটিতে একটু বেশি উপার্জনের সম্ভাবনা থাকে। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত শরীরে, পকেট ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা।

বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার জামা কই?”

তিনি মাথা নিচু করে বলেন, “এইবার না, পরেরবার।”

এই কথাটি বলার সময় তার বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যায়—তা কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না।

শিশুর চোখে ঈদের রংহীনতা

ঈদ তো শিশুদের আনন্দের দিন—এমনটাই শুনে বড় হয় তারা। কিন্তু যেসব শিশু নতুন জামা পায় না, খেলনা পায় না, পেট ভরে খেতে পায় না—তারা কেমন করে ঈদ উদযাপন করে?

তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদ দেখে। এক ধরনের ঈর্ষা, অপমান আর অক্ষমতা মিশে তৈরি হয় তাদের জীবনের প্রথম ঈদের শিক্ষা—“ঈদ সবার জন্য নয়।”

এই শিক্ষা একটি শিশুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অভিমান, সমাজব্যবস্থার প্রতি রাগ, ঈদের প্রতি ঘৃণা।

ঈদের আসল পাঠ—কোথায় হারিয়ে গেল?

ঈদের মূল শিক্ষা ছিল সহমর্মিতা, সমতা ও ভালোবাসা। কিন্তু আজকাল এই শিক্ষা অনেক সময় ফেসবুক পোস্ট আর ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যাকাত-সদকা অনেকটাই লোক দেখানো কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

আসলে, একটি দরিদ্র শিশুকে জামা কিনে দেওয়া কোনো দয়া নয়—এটা তার ন্যায্য প্রাপ্য। একজন রিকশাচালককে ঈদের দিনে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া সহানুভূতি নয়, বরং ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব পালন।

হাজার টাকায় ফিরতে পারে একটি ঈদ

আপনার ঈদের খরচ যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়, তার মধ্যে মাত্র এক হাজার টাকা ব্যয় করলেই একটি পরিবারের মুখে ঈদের হাসি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একটা জামা, একজোড়া জুতো, এক প্লেট বিরিয়ানি—এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়। সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই এই ছোট ছোট উপহারগুলো বহু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

ঈদ সবার হোক—তবেই পূর্ণতা

আমরা চাই না সবাই সমাজবিপ্লবী হোক। শুধু চাই—আপনার পাশের দরিদ্র শিশুটির জন্য একটি জামা কিনে দিন। রাস্তার সেই বৃদ্ধ মায়ের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি তুলে দিন।

এই ছোট ছোট ভালোবাসার কাজগুলোই ঈদকে সত্যিকার অর্থে সবার করে তোলে।

রাষ্ট্র কি পারত না পাশে দাঁড়াতে?

একটি রাষ্ট্র চাইলে ঈদের দিনে কোনো পরিবার না খেয়ে থাকবে না—এটা নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়। ঈদের সময় একটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চালু করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া যেত—এটা হতে পারত এক নতুন দৃষ্টান্ত।

সরকারি খাদ্য সহায়তা, জামা বিতরণ, শিশুবান্ধব উপহার কার্যক্রম—এসব শুরু হলে ঈদ আর কারো জন্য অন্ধকার হয়ে থাকত না।

ঈদ হোক ভালোবাসার নাম

আমরা যতই বলি ঈদ মানে আনন্দ, ততদিন তা খালি বুলি হিসেবেই থাকবে—যতদিন না আমরা সেই আনন্দ সবার মাঝে ভাগ করে নিতে শিখি।

এই ঈদে আসুন আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিই—একটি মুখে হাসি ফোটাব, একটি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে বলব: “তোমরা একা নও।”

এই ছোট ছোট ভালোবাসার স্পর্শগুলোই ঈদকে ঈদ বানায়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার আগে যদি একটু ভাবি—আমার চারপাশে কেউ কি আজও না খেয়ে আছে? কারো সন্তানের মুখ কি আজও শুকনো?

কারণ ঈদ শুধু নামাজের উৎসব নয়। ঈদ হলো হৃদয়ের উৎসব—যেখানে সকল শ্রেণি, সকল মানুষ একসাথে বলে, “আমরা একসাথে।”

ঈদ হোক সেই ভালোবাসার গল্প—যা শুরু হয় একজন মানুষের হাসি দিয়ে, আর ছড়িয়ে পড়ে হাজারো হৃদয়ে।