img

ঢাকার রাত: অন্ধকারের আলো!

প্রকাশিত :  ১৮:৫৪, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫

ঢাকার রাত: অন্ধকারের আলো!

রেজুয়ান আহম্মেদ

ঢাকার রাত। দিনভর কর্মব্যস্ততা শেষে যখন শহরের কোলাহল স্তিমিত হয়, তখন যেন এক নতুন ঢাকা জন্ম নেয়। এ শহরের রাতদিনের পার্থক্য কেবল সূর্যের অস্ত যাওয়া বা আকাশে নক্ষত্রের ঝিলিক নয়। বরং রাতের ঢাকা এক অন্য বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি—যেখানে অন্ধকারের মধ্যে আলোর মতো জ্বলজ্বল করে নিষিদ্ধ জীবনের গল্প। এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন এক শ্রেণির নারী, যাঁরা আমাদের সমাজের চোখে অবাঞ্ছিত, কিন্তু বাস্তবে আমাদের সভ্যতারই এক প্রতিচ্ছবি।

রাতের ঢাকায় ফুটপাথ, ট্রাফিক লাইট, কিংবা অলিগলির কোণায় কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের আমরা দেখি, কিন্তু না দেখার ভান করি। তাদের চোখে থাকে শূন্যতার ছাপ, ঠোঁটে জমে থাকা এক প্রহেলিকাময় হাসি। তারা যেন জীবনের এক অদৃশ্য মঞ্চে নীরব অভিনেত্রী, যাঁরা নিজেদের অস্তিত্বের যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সমাজ তাদের ‘অচ্ছুত’ হিসেবে আখ্যা দিলেও, এই নারীদের ছাড়া ঢাকার রাতের গল্প যেন অসম্পূর্ণ।

তবে কেন এই নারীরা রাস্তায় দাঁড়ায়? প্রতিটি ভ্রাম্যমাণ পতিতার পেছনে রয়েছে একটি গভীর বেদনাময় গল্প। কেউ গ্রাম থেকে এসেছে দারিদ্র্যের তাড়নায়, কেউ প্রতারণার শিকার হয়েছে। কারও পরিবার নেই, কেউ আবার জীবনের নিষ্ঠুর আঘাতে একা পড়ে গেছেন। সমাজ তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি, বরং ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারে। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা নিজের শরীরকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এই পণ্যের লেনদেনের পেছনে লুকিয়ে আছে এক গভীর শূন্যতা, যা বোঝার চেষ্টা কেউ করে না।

ঢাকার রাতের এই নারীরা একধরনের প্রতীক। তারা আমাদের সামাজিক কাঠামোর সেই অংশ, যা আমরা স্বীকার করতে চাই না। তাদের জীবনে নেই কোনো রঙ, নেই কোনো স্বপ্ন। প্রতিটি রাত তাদের জন্য এক অনিশ্চিত যাত্রা। নতুন ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করতে করতে তারা জানে না, পরবর্তী মুহূর্তে কী ঘটতে চলেছে। তবুও তারা দাঁড়িয়ে থাকে, কারণ তাদের কাছে অন্য কোনো পথ খোলা নেই।

এই নারীদের সাজগোজ, হাসি আর ইশারার আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক অসীম বিষণ্নতা। রাত যতই বর্ণিল মনে হোক না কেন, ভোরের আলো ফুটতেই তাদের জীবনের তিক্ত বাস্তবতা আবারও প্রকাশ পায়। তাদের প্রতিটি দিন শুরু হয় নতুন সংগ্রামের আশঙ্কা নিয়ে। এই সংগ্রামে ক্লান্তি, হতাশা আর জীবনের প্রতি অভিমান সবসময় সঙ্গী।

আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি, এই নারীদের জীবন কেমন? আমরা কি কখনো জানতে চেয়েছি, তারা কীভাবে বেঁচে আছেন? তাদের এই জীবনধারা কি একান্তই তাদের পছন্দ, নাকি পরিস্থিতির নিষ্ঠুর পরিণতি? আমাদের সমাজের কাঠামো কি এমন যে, এই নারীদের জন্য বিকল্প কোনো পথ রেখে দেয় না?

এই নারীরা আমাদের সমাজেরই অংশ, আমাদের অবহেলার ফসল। অথচ আমরা তাদের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকানোর সাহস রাখি না। আমরা তাদের বিচার করি, কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়াই না। সমাজের এই অন্ধকার দিকটি আমরা এড়িয়ে চলতে চাই, কারণ এটি আমাদের বিবেককে বিব্রত করে।

তবে পরিবর্তন কি সম্ভব নয়? যদি এই নারীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারি, তাহলে হয়তো তাদের জীবনে আলো আনতে পারি। যদি আমরা তাদের জীবনের গল্প শুনি, যদি তাদের দুঃখ-কষ্টের প্রতি সহানুভূতি দেখাই, তাহলে হয়তো আমরা সমাজে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হব।

ঢাকার রাত আমাদের শেখায় সহানুভূতির মূল্য। এই নারীরা শুধু রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার জন্য জন্মায়নি। তাদের জীবনেও আলো আসতে পারে। আশার একটি নতুন সূর্য একদিন তাদের জীবনে উদিত হবে—এই স্বপ্ন দেখা আমাদের দায়িত্ব। সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি একধাপ এগিয়ে আসে, তবে হয়তো তাদের জীবনেও রঙিন দিন আসবে।

ঢাকার রাতের ভ্রাম্যমাণ নারীরা আমাদের সমাজের এক অন্ধকার গল্প। তবে এই গল্প পরিবর্তন করতে হলে আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। কারণ, প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। তাদের জীবনের গল্প শুনে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, আমরা তাদের জীবনে আলো ফিরিয়ে আনতে পারি। একদিন নিশ্চয়ই ঢাকার রাত শুধু অন্ধকারের প্রতীক হবে না, বরং সহানুভূতির আলোয় আলোকিত হবে।

img

ঈদ যখন কাঁদে অভাবের কাছে: উৎসবের আলো আর অন্ধকারের গল্প

প্রকাশিত :  ০৫:৩০, ০৮ জুন ২০২৫

ঈদের নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট শিশুর হাসিমাখা মুখ, নতুন জামার রঙ, বাজারের কোলাহল, সুগন্ধে ভরা রান্নাঘর আর পরিবারজুড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা। মনে হয়, এ যেন এক মিলনের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব—মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক মহা-উপলক্ষ।

কিন্তু একটু ভাবুন—এই উৎসব কি সবার জন্য একই রকম আনন্দ বয়ে আনে?

ঈদের পেছনের সেই নিঃশব্দ কান্না

আমরা অনেকেই ঈদের আগে বাজারে যাই, জামাকাপড় কিনি, খাবারদাবারে ঘর সাজাই, ছবি তুলে পোস্ট দিই—সবই স্বাভাবিক আনন্দের অংশ। কিন্তু আমাদের আশপাশেই এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ঈদের আগের রাতে জানে না, পরদিন সকালে তাদের শিশুটি আদৌ কিছু খেতে পাবে কি না।

তারা ফেসবুকে অন্যদের ছবিতে ঈদের রঙ দেখে, ছেলেমেয়েদের হাসিমুখ দেখে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আমেজটা গায়ে মাখার চেষ্টা করে—কিন্তু মনে মনে ভেঙে পড়ে।

একজন মা যখন সন্তানের নতুন জামার আবদার শুনে চুপ করে থাকেন, চোখের জল আড়াল করতে রান্নাঘরে চলে যান—তখন ঈদের আনন্দ তার কাছে হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য বোঝা।

তিনি বলেন, “কাল পাবে বাবা, কাল পাবে”—এই ‘কাল’ যে কবে আসবে, তিনি নিজেও জানেন না। তবু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করাটাই যেন তার ঈদের একমাত্র প্রস্তুতি।

রিকশাচালক বাবার সন্ধ্যা

রিকশা চালানো মানুষটি ঈদের দিনেও রাস্তায় থাকেন—কারণ এই দিনটিতে একটু বেশি উপার্জনের সম্ভাবনা থাকে। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত শরীরে, পকেট ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা।

বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার জামা কই?”

তিনি মাথা নিচু করে বলেন, “এইবার না, পরেরবার।”

এই কথাটি বলার সময় তার বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যায়—তা কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না।

শিশুর চোখে ঈদের রংহীনতা

ঈদ তো শিশুদের আনন্দের দিন—এমনটাই শুনে বড় হয় তারা। কিন্তু যেসব শিশু নতুন জামা পায় না, খেলনা পায় না, পেট ভরে খেতে পায় না—তারা কেমন করে ঈদ উদযাপন করে?

তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদ দেখে। এক ধরনের ঈর্ষা, অপমান আর অক্ষমতা মিশে তৈরি হয় তাদের জীবনের প্রথম ঈদের শিক্ষা—“ঈদ সবার জন্য নয়।”

এই শিক্ষা একটি শিশুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অভিমান, সমাজব্যবস্থার প্রতি রাগ, ঈদের প্রতি ঘৃণা।

ঈদের আসল পাঠ—কোথায় হারিয়ে গেল?

ঈদের মূল শিক্ষা ছিল সহমর্মিতা, সমতা ও ভালোবাসা। কিন্তু আজকাল এই শিক্ষা অনেক সময় ফেসবুক পোস্ট আর ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যাকাত-সদকা অনেকটাই লোক দেখানো কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

আসলে, একটি দরিদ্র শিশুকে জামা কিনে দেওয়া কোনো দয়া নয়—এটা তার ন্যায্য প্রাপ্য। একজন রিকশাচালককে ঈদের দিনে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া সহানুভূতি নয়, বরং ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব পালন।

হাজার টাকায় ফিরতে পারে একটি ঈদ

আপনার ঈদের খরচ যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়, তার মধ্যে মাত্র এক হাজার টাকা ব্যয় করলেই একটি পরিবারের মুখে ঈদের হাসি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একটা জামা, একজোড়া জুতো, এক প্লেট বিরিয়ানি—এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়। সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই এই ছোট ছোট উপহারগুলো বহু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

ঈদ সবার হোক—তবেই পূর্ণতা

আমরা চাই না সবাই সমাজবিপ্লবী হোক। শুধু চাই—আপনার পাশের দরিদ্র শিশুটির জন্য একটি জামা কিনে দিন। রাস্তার সেই বৃদ্ধ মায়ের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি তুলে দিন।

এই ছোট ছোট ভালোবাসার কাজগুলোই ঈদকে সত্যিকার অর্থে সবার করে তোলে।

রাষ্ট্র কি পারত না পাশে দাঁড়াতে?

একটি রাষ্ট্র চাইলে ঈদের দিনে কোনো পরিবার না খেয়ে থাকবে না—এটা নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়। ঈদের সময় একটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চালু করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া যেত—এটা হতে পারত এক নতুন দৃষ্টান্ত।

সরকারি খাদ্য সহায়তা, জামা বিতরণ, শিশুবান্ধব উপহার কার্যক্রম—এসব শুরু হলে ঈদ আর কারো জন্য অন্ধকার হয়ে থাকত না।

ঈদ হোক ভালোবাসার নাম

আমরা যতই বলি ঈদ মানে আনন্দ, ততদিন তা খালি বুলি হিসেবেই থাকবে—যতদিন না আমরা সেই আনন্দ সবার মাঝে ভাগ করে নিতে শিখি।

এই ঈদে আসুন আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিই—একটি মুখে হাসি ফোটাব, একটি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে বলব: “তোমরা একা নও।”

এই ছোট ছোট ভালোবাসার স্পর্শগুলোই ঈদকে ঈদ বানায়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার আগে যদি একটু ভাবি—আমার চারপাশে কেউ কি আজও না খেয়ে আছে? কারো সন্তানের মুখ কি আজও শুকনো?

কারণ ঈদ শুধু নামাজের উৎসব নয়। ঈদ হলো হৃদয়ের উৎসব—যেখানে সকল শ্রেণি, সকল মানুষ একসাথে বলে, “আমরা একসাথে।”

ঈদ হোক সেই ভালোবাসার গল্প—যা শুরু হয় একজন মানুষের হাসি দিয়ে, আর ছড়িয়ে পড়ে হাজারো হৃদয়ে।