
নৌকায় ভাসা জীবনের কাব্য!

রেজুয়ান আহম্মেদ
পদ্মার তীরে বসবাসরত একটি ছোট্ট বেদে পল্লীর জীবন, যা নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলে, সেই জীবন যেন প্রকৃতির অমোঘ ছন্দের প্রতিচ্ছবি। এই পল্লীর মানুষরা নদীকে কেন্দ্র করেই তাদের অস্তিত্বকে গড়ে তুলেছে। সেখানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে শুরু হয় এক নতুন দিনের কাব্য। নদীর কূলে কাঁচা নৌকা আর ঢেউয়ের খেলা যেন সেই কাব্যের ছন্দকে আরও বর্ণময় করে তোলে।
পল্লীর প্রতিটি মানুষ যেন একটি গল্প, একটি জীবন। নারীরা পুটুলি কাঁধে সাপের খেলা দেখাতে বের হয়, পুরুষেরা মাছ ধরে বা ওষুধ বিক্রি করে জীবিকার সন্ধান করে। আর শিশুরা নদীর ধারে দৌড়াদৌড়ি করে শৈশবের মুক্ত বাতাসে। তাদের জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত যেন এক অদ্ভুত সুন্দর রূপকথা। কিন্তু এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তেরো বছরের পিয়াল এবং তার মায়ের জীবন।
পিয়ালের স্বপ্ন ছিল ভিন্ন। তার কিশোর চোখে শহরের উজ্জ্বল আলোর আকর্ষণ, বড় বড় ইমারত আর ব্যস্ত মানুষের কোলাহল তাকে অজানা এক দুনিয়ার টানে ডেকে নিত। কিন্তু তার মা রূপার বিশ্বাস ছিল বিপরীত। নদীর মানুষ হিসেবে রূপা জানত, শহরের ঝলমলে আলো তাদের জন্য নয়। “আমাদের বাড়ি এই নদী আর নৌকায়,” মায়ের কথাগুলো বাস্তবতার প্রতি গভীর বিশ্বাসের প্রতীক।
তবুও কিশোর মনের স্বপ্ন বাস্তবতার গণ্ডি মানতে চায় না। শহরের টান পিয়ালকে পল্লীর সীমানা পেরিয়ে এক নতুন দুনিয়া দেখার ইচ্ছায় উদ্বুদ্ধ করল। সে জানত না, এই পথ তার জন্য কতটা কঠিন।
একদিন পিয়াল ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকা নিয়ে নদীর ওপারের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। তার মনে ছিল উত্তেজনা, স্বপ্নপূরণের আশায় জেগে থাকা সাহস। কিন্তু প্রকৃতি তার নিজস্ব পরীক্ষায় নামালো পিয়ালকে। নদীর মাঝখানে এসে ঢেউগুলো যেন তাকে শহরের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল।
ঝড় উঠল, ঢেউ হয়ে উঠল দানবের মতো। পিয়াল প্রাণপণে চেষ্টা করল নৌকা সামলাতে। কিন্তু ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা উল্টে গেল। সেই মুহূর্তে পিয়ালের মনে এলো, তার সবকিছু শেষ। কিন্তু হাল ছাড়ল না সে। মায়ের সেই কথা—“আমরা নদীর মানুষ। নদীর জলে ভাসতে শিখেছি”—তাকে আশার আলো দেখাল।
ঝড় শেষে পিয়াল যখন জ্ঞান ফিরে পেল, তখন সে দেখল, তার মা তাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মায়ের চোখে অশ্রু আর মুখে ছিল কষ্ট মেশানো মমতা। রূপা পিয়ালকে বলল, “শহর আমাদের জায়গা নয়। আমাদের শিকড় এই নদীর মাঝেই।” পিয়াল সেদিন বুঝতে পেরেছিল, মায়ের কথা শুধু অভিজ্ঞতার নয়, ভালোবাসা ও বাস্তবতার প্রতীক।
সেই মুহূর্ত থেকে পিয়াল আর শহরের দিকে যেতে চায়নি। সে তার জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেল। নদীর ঢেউ, সাপের খেলা, আর ওষুধ বিক্রির কাজ তাকে নতুন করে গর্বিত করল। সে বুঝল, তার শিকড় এই নদীর সঙ্গে বাঁধা।
পিয়ালের জীবন শুধু একটি গল্প নয়, এটি আসলে নদীর মানুষের সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। এই সংগ্রামের মাঝেই লুকিয়ে আছে জীবনের প্রকৃত কাব্য। পদ্মার ঢেউ, ঝড়ের ধাক্কা, আর শৈশবের কৌতূহল একত্রে মিলে তৈরি করেছে সেই কাব্য, যা জীবনের গভীরতা শেখায়।
“নৌকায় ভাসা জীবনের কাব্য” শুধু পিয়ালের নয়, এটি এমন এক জীবনের কথা বলে, যেখানে স্বপ্ন আর বাস্তবতার সংঘর্ষে মানুষ তার শিকড়ের প্রতি টান খুঁজে পায়। নদীর সুর, ঢেউয়ের ছন্দ, আর জীবনের সংগ্রাম একসঙ্গে মিলে একটি অনন্য কাব্য রচনা করে, যা মানুষের অন্তরে স্বপ্ন দেখার নতুন অনুপ্রেরণা জাগায়।