
নিশিযাত্রা

রেজুয়ান আহম্মেদ
ঢাকার রাত গভীর হয়ে উঠছে। শহরটি দিনশেষে ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়েছে, আর সেই নিস্তব্ধতার মাঝে শহরের আলো যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আনিসুর রহমান জানালার পাশে বসে আছেন। তার ফ্ল্যাটটি ছোট, তবে এই ছোট ঘরেই তার জীবনের অনেক বড় গল্প জমা। জানালার ওপারে ঝলমলে আলোকিত আকাশ। কিন্তু তার চোখ যেন সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেও কোথাও অন্য এক অজানা পথে হারিয়ে গেছে। এই হারিয়ে যাওয়া কোনো কল্পনা নয়, এটি তার অতীতে ফিরে যাওয়া, যেখানে জীবনের প্রতিটি মোড়েই সুখ-দুঃখ আর স্মৃতির ছায়া মিশে আছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে আনিসুরের। সেই প্রথম ক্লাসের দিন, যখন নতুন নতুন মুখের ভিড়ে একজন কিশোর নিজের জায়গা খুঁজছিল। সোহেল ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তারা একসাথে কত স্বপ্ন দেখেছিল! বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো ছিল জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। বটতলায় বসে চা খাওয়া, রাতভর আড্ডা আর পড়াশোনার চাপে ক্লান্ত হওয়া, তবুও জীবনের অনাবিল আনন্দ ছিল। পরীক্ষার আগে ঘুমহীন রাতগুলোতেও একধরনের রোমাঞ্চ লুকিয়ে ছিল।
কিন্তু সেই দিনগুলো এক সময় হারিয়ে গেল। সোহেল একদিন দূর বিদেশে চলে গেল, নিজের জীবনের স্বপ্নপূরণের জন্য। যোগাযোগটা আস্তে আস্তে কমে এলো। বন্ধুত্বের সেই গভীরতাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আনিসুর তখন নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি পাওয়ার লড়াই শুরু হয়।
তারপর আসে জীবনের সবচেয়ে রঙিন অধ্যায়। শিরিন। তার হাসি, তার চোখের গভীরতা, তার কথা—সবকিছুই যেন এক নতুন জগতের সন্ধান এনে দিয়েছিল। আনিসুর অনুভব করতেন, শিরিনের উপস্থিতিতে তার জীবনের সব খালি জায়গা পূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। শিরিনের পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নিল না। সামাজিক বাধা আর পারিবারিক চাপে সেই সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। শিরিন চলে গেল তার জীবনের পথ ধরে, আর আনিসুর রয়ে গেল তার স্মৃতির ভার নিয়ে। শিরিনের চলে যাওয়া তার জীবনে গভীর এক ক্ষতের সৃষ্টি করল, যা সময়ের সাথে মলিন হলেও মুছে যায়নি।
পড়াশোনা শেষ করার পর কর্মজীবনের শুরুটা সহজ ছিল না। একটি ছোট চাকরি দিয়ে শুরু, তারপর দিনরাত পরিশ্রম। প্রথম বেতন পেয়ে যে আনন্দ হয়েছিল, সেই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একসময় দায়িত্ব আর কাজের চাপে আনন্দের জায়গা নিল একধরনের চাপা কষ্ট। স্ত্রী রওশন আরার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয় সেখান থেকেই। আনিসুর দিনভর কাজ করতেন, কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে অনুভব করতেন, সংসারের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথাও ভেঙে পড়ছে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য তিনি নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ত্যাগের মূল্য তার পরিবার কখনো বোঝেনি।
আজ আনিসুর একা। সন্তানরা এখন বিদেশে, নিজ নিজ জীবনে ব্যস্ত। স্ত্রী বহু বছর আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এই ছোট্ট ফ্ল্যাট আর নিস্তব্ধ রাত তার একমাত্র সঙ্গী। একাকিত্ব তাকে মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়, কিন্তু তিনি তা মেনে নিয়েছেন। এই একাকিত্বের মধ্যেও তিনি নিজেকে খুঁজে পান।
রাত গভীর হয়। আনিসুর রহমান জানালার পাশে বসে থাকেন। তার মনে হয়, তিনি যেন একটি নদীর ধারে বসে আছেন। নদীর স্রোত বয়ে চলেছে, আর তার জীবনের সব চিন্তা সেই স্রোতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তিনি মায়ের মুখটা দেখতে পান। তার মায়ের সেই কোমল মুখ, যা তার জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ে তাকে সাহস দিয়েছে। তিনি মনে করেন, জীবনের এই শেষ যাত্রাও তার মায়ের স্নেহের মতো মধুর হবে।
পরের দিন সকালে গৃহপরিচারিকা এসে দেখে, আনিসুর রহমান চিরনিদ্রায় শায়িত। তার মুখে প্রশান্তির একটি হাসি। যেন তিনি সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে চিরন্তন শান্তির জগতে পাড়ি দিয়েছেন।
নিশিযাত্রা কেবল আনিসুর রহমানের গল্প নয়। এটি আমাদের সবার জীবনের প্রতিচ্ছবি। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আনন্দ, কষ্ট, সংগ্রাম আর প্রশান্তি মিশে থাকে। জীবন হয়তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু স্মৃতিগুলো চিরস্থায়ী। জীবনের এই যাত্রা শেষ হয়, কিন্তু রেখে যায় আমাদের গল্প, যা সময়ের স্রোতে কখনো মুছে যায় না।