img

নিশিযাত্রা

প্রকাশিত :  ১৬:৫৮, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৮:৩৬, ২৮ জানুয়ারী ২০২৫

নিশিযাত্রা

রেজুয়ান আহম্মেদ

ঢাকার রাত গভীর হয়ে উঠছে। শহরটি দিনশেষে ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়েছে, আর সেই নিস্তব্ধতার মাঝে শহরের আলো যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আনিসুর রহমান জানালার পাশে বসে আছেন। তার ফ্ল্যাটটি ছোট, তবে এই ছোট ঘরেই তার জীবনের অনেক বড় গল্প জমা। জানালার ওপারে ঝলমলে আলোকিত আকাশ। কিন্তু তার চোখ যেন সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেও কোথাও অন্য এক অজানা পথে হারিয়ে গেছে। এই হারিয়ে যাওয়া কোনো কল্পনা নয়, এটি তার অতীতে ফিরে যাওয়া, যেখানে জীবনের প্রতিটি মোড়েই সুখ-দুঃখ আর স্মৃতির ছায়া মিশে আছে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা মনে পড়ে আনিসুরের। সেই প্রথম ক্লাসের দিন, যখন নতুন নতুন মুখের ভিড়ে একজন কিশোর নিজের জায়গা খুঁজছিল। সোহেল ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। তারা একসাথে কত স্বপ্ন দেখেছিল! বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো ছিল জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। বটতলায় বসে চা খাওয়া, রাতভর আড্ডা আর পড়াশোনার চাপে ক্লান্ত হওয়া, তবুও জীবনের অনাবিল আনন্দ ছিল। পরীক্ষার আগে ঘুমহীন রাতগুলোতেও একধরনের রোমাঞ্চ লুকিয়ে ছিল।

কিন্তু সেই দিনগুলো এক সময় হারিয়ে গেল। সোহেল একদিন দূর বিদেশে চলে গেল, নিজের জীবনের স্বপ্নপূরণের জন্য। যোগাযোগটা আস্তে আস্তে কমে এলো। বন্ধুত্বের সেই গভীরতাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। আনিসুর তখন নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। পড়াশোনা শেষ করে একটা চাকরি পাওয়ার লড়াই শুরু হয়।

তারপর আসে জীবনের সবচেয়ে রঙিন অধ্যায়। শিরিন। তার হাসি, তার চোখের গভীরতা, তার কথা—সবকিছুই যেন এক নতুন জগতের সন্ধান এনে দিয়েছিল। আনিসুর অনুভব করতেন, শিরিনের উপস্থিতিতে তার জীবনের সব খালি জায়গা পূর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না। শিরিনের পরিবার তাদের সম্পর্ক মেনে নিল না। সামাজিক বাধা আর পারিবারিক চাপে সেই সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল। শিরিন চলে গেল তার জীবনের পথ ধরে, আর আনিসুর রয়ে গেল তার স্মৃতির ভার নিয়ে। শিরিনের চলে যাওয়া তার জীবনে গভীর এক ক্ষতের সৃষ্টি করল, যা সময়ের সাথে মলিন হলেও মুছে যায়নি।

পড়াশোনা শেষ করার পর কর্মজীবনের শুরুটা সহজ ছিল না। একটি ছোট চাকরি দিয়ে শুরু, তারপর দিনরাত পরিশ্রম। প্রথম বেতন পেয়ে যে আনন্দ হয়েছিল, সেই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একসময় দায়িত্ব আর কাজের চাপে আনন্দের জায়গা নিল একধরনের চাপা কষ্ট। স্ত্রী রওশন আরার সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয় সেখান থেকেই। আনিসুর দিনভর কাজ করতেন, কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে অনুভব করতেন, সংসারের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথাও ভেঙে পড়ছে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য তিনি নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ত্যাগের মূল্য তার পরিবার কখনো বোঝেনি।

আজ আনিসুর একা। সন্তানরা এখন বিদেশে, নিজ নিজ জীবনে ব্যস্ত। স্ত্রী বহু বছর আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। এই ছোট্ট ফ্ল্যাট আর নিস্তব্ধ রাত তার একমাত্র সঙ্গী। একাকিত্ব তাকে মাঝে মাঝে কষ্ট দেয়, কিন্তু তিনি তা মেনে নিয়েছেন। এই একাকিত্বের মধ্যেও তিনি নিজেকে খুঁজে পান।

রাত গভীর হয়। আনিসুর রহমান জানালার পাশে বসে থাকেন। তার মনে হয়, তিনি যেন একটি নদীর ধারে বসে আছেন। নদীর স্রোত বয়ে চলেছে, আর তার জীবনের সব চিন্তা সেই স্রোতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই তিনি মায়ের মুখটা দেখতে পান। তার মায়ের সেই কোমল মুখ, যা তার জীবনের প্রতিটি কঠিন সময়ে তাকে সাহস দিয়েছে। তিনি মনে করেন, জীবনের এই শেষ যাত্রাও তার মায়ের স্নেহের মতো মধুর হবে।

পরের দিন সকালে গৃহপরিচারিকা এসে দেখে, আনিসুর রহমান চিরনিদ্রায় শায়িত। তার মুখে প্রশান্তির একটি হাসি। যেন তিনি সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে চিরন্তন শান্তির জগতে পাড়ি দিয়েছেন।

নিশিযাত্রা কেবল আনিসুর রহমানের গল্প নয়। এটি আমাদের সবার জীবনের প্রতিচ্ছবি। জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আনন্দ, কষ্ট, সংগ্রাম আর প্রশান্তি মিশে থাকে। জীবন হয়তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু স্মৃতিগুলো চিরস্থায়ী। জীবনের এই যাত্রা শেষ হয়, কিন্তু রেখে যায় আমাদের গল্প, যা সময়ের স্রোতে কখনো মুছে যায় না।

img

ঈদ যখন কাঁদে অভাবের কাছে: উৎসবের আলো আর অন্ধকারের গল্প

প্রকাশিত :  ০৫:৩০, ০৮ জুন ২০২৫

ঈদের নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট ছোট শিশুর হাসিমাখা মুখ, নতুন জামার রঙ, বাজারের কোলাহল, সুগন্ধে ভরা রান্নাঘর আর পরিবারজুড়ে ভালোবাসার উষ্ণতা। মনে হয়, এ যেন এক মিলনের উৎসব, ভালোবাসার উৎসব—মানুষের পাশে মানুষের দাঁড়ানোর এক মহা-উপলক্ষ।

কিন্তু একটু ভাবুন—এই উৎসব কি সবার জন্য একই রকম আনন্দ বয়ে আনে?

ঈদের পেছনের সেই নিঃশব্দ কান্না

আমরা অনেকেই ঈদের আগে বাজারে যাই, জামাকাপড় কিনি, খাবারদাবারে ঘর সাজাই, ছবি তুলে পোস্ট দিই—সবই স্বাভাবিক আনন্দের অংশ। কিন্তু আমাদের আশপাশেই এমন অনেক পরিবার আছে, যারা ঈদের আগের রাতে জানে না, পরদিন সকালে তাদের শিশুটি আদৌ কিছু খেতে পাবে কি না।

তারা ফেসবুকে অন্যদের ছবিতে ঈদের রঙ দেখে, ছেলেমেয়েদের হাসিমুখ দেখে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদের আমেজটা গায়ে মাখার চেষ্টা করে—কিন্তু মনে মনে ভেঙে পড়ে।

একজন মা যখন সন্তানের নতুন জামার আবদার শুনে চুপ করে থাকেন, চোখের জল আড়াল করতে রান্নাঘরে চলে যান—তখন ঈদের আনন্দ তার কাছে হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য বোঝা।

তিনি বলেন, “কাল পাবে বাবা, কাল পাবে”—এই ‘কাল’ যে কবে আসবে, তিনি নিজেও জানেন না। তবু সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করাটাই যেন তার ঈদের একমাত্র প্রস্তুতি।

রিকশাচালক বাবার সন্ধ্যা

রিকশা চালানো মানুষটি ঈদের দিনেও রাস্তায় থাকেন—কারণ এই দিনটিতে একটু বেশি উপার্জনের সম্ভাবনা থাকে। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফেরেন ক্লান্ত শরীরে, পকেট ফাঁকা, মুখে নিঃশব্দ বিষণ্ণতা।

বাচ্চা জিজ্ঞাসা করে, “বাবা, আমার জামা কই?”

তিনি মাথা নিচু করে বলেন, “এইবার না, পরেরবার।”

এই কথাটি বলার সময় তার বুকের ভেতর যে ঝড় বয়ে যায়—তা কেউ দেখে না, কেউ বোঝেও না।

শিশুর চোখে ঈদের রংহীনতা

ঈদ তো শিশুদের আনন্দের দিন—এমনটাই শুনে বড় হয় তারা। কিন্তু যেসব শিশু নতুন জামা পায় না, খেলনা পায় না, পেট ভরে খেতে পায় না—তারা কেমন করে ঈদ উদযাপন করে?

তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঈদ দেখে। এক ধরনের ঈর্ষা, অপমান আর অক্ষমতা মিশে তৈরি হয় তাদের জীবনের প্রথম ঈদের শিক্ষা—“ঈদ সবার জন্য নয়।”

এই শিক্ষা একটি শিশুকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাদের হৃদয়ে জন্ম নেয় অভিমান, সমাজব্যবস্থার প্রতি রাগ, ঈদের প্রতি ঘৃণা।

ঈদের আসল পাঠ—কোথায় হারিয়ে গেল?

ঈদের মূল শিক্ষা ছিল সহমর্মিতা, সমতা ও ভালোবাসা। কিন্তু আজকাল এই শিক্ষা অনেক সময় ফেসবুক পোস্ট আর ছবি তোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যাকাত-সদকা অনেকটাই লোক দেখানো কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।

আসলে, একটি দরিদ্র শিশুকে জামা কিনে দেওয়া কোনো দয়া নয়—এটা তার ন্যায্য প্রাপ্য। একজন রিকশাচালককে ঈদের দিনে এক প্যাকেট বিরিয়ানি দেওয়া সহানুভূতি নয়, বরং ন্যূনতম মানবিক দায়িত্ব পালন।

হাজার টাকায় ফিরতে পারে একটি ঈদ

আপনার ঈদের খরচ যদি পঞ্চাশ হাজার টাকা হয়, তার মধ্যে মাত্র এক হাজার টাকা ব্যয় করলেই একটি পরিবারের মুখে ঈদের হাসি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

একটা জামা, একজোড়া জুতো, এক প্লেট বিরিয়ানি—এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়। সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই এই ছোট ছোট উপহারগুলো বহু মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে।

ঈদ সবার হোক—তবেই পূর্ণতা

আমরা চাই না সবাই সমাজবিপ্লবী হোক। শুধু চাই—আপনার পাশের দরিদ্র শিশুটির জন্য একটি জামা কিনে দিন। রাস্তার সেই বৃদ্ধ মায়ের হাতে এক প্যাকেট মিষ্টি তুলে দিন।

এই ছোট ছোট ভালোবাসার কাজগুলোই ঈদকে সত্যিকার অর্থে সবার করে তোলে।

রাষ্ট্র কি পারত না পাশে দাঁড়াতে?

একটি রাষ্ট্র চাইলে ঈদের দিনে কোনো পরিবার না খেয়ে থাকবে না—এটা নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয়। ঈদের সময় একটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচি চালু করে দরিদ্র পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়া যেত—এটা হতে পারত এক নতুন দৃষ্টান্ত।

সরকারি খাদ্য সহায়তা, জামা বিতরণ, শিশুবান্ধব উপহার কার্যক্রম—এসব শুরু হলে ঈদ আর কারো জন্য অন্ধকার হয়ে থাকত না।

ঈদ হোক ভালোবাসার নাম

আমরা যতই বলি ঈদ মানে আনন্দ, ততদিন তা খালি বুলি হিসেবেই থাকবে—যতদিন না আমরা সেই আনন্দ সবার মাঝে ভাগ করে নিতে শিখি।

এই ঈদে আসুন আমরা কিছু সিদ্ধান্ত নিই—একটি মুখে হাসি ফোটাব, একটি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে বলব: “তোমরা একা নও।”

এই ছোট ছোট ভালোবাসার স্পর্শগুলোই ঈদকে ঈদ বানায়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করার আগে যদি একটু ভাবি—আমার চারপাশে কেউ কি আজও না খেয়ে আছে? কারো সন্তানের মুখ কি আজও শুকনো?

কারণ ঈদ শুধু নামাজের উৎসব নয়। ঈদ হলো হৃদয়ের উৎসব—যেখানে সকল শ্রেণি, সকল মানুষ একসাথে বলে, “আমরা একসাথে।”

ঈদ হোক সেই ভালোবাসার গল্প—যা শুরু হয় একজন মানুষের হাসি দিয়ে, আর ছড়িয়ে পড়ে হাজারো হৃদয়ে।