
ভাষা আন্দোলনে শ্রীমঙ্গল

সংগ্রাম দত্ত: পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল - ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি। তাতে গণপরিষদে কার্যক্রমে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও যেন ব্যবহৃত হতে পারে - এমন এক প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
মি. দত্তের যুক্তি ছিল - পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটিরও বেশি লোকের ভাষা বাংলা - অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষাই বাংলা। তাই বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে দেখা উচিত নয়, বাংলারও হওয়া উচিত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা।
কিন্তু মি. দত্তের এ সংশোধনীর প্রস্তাব গণপরিষদে টেকেনি। এমনকি গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরাও সংসদীয় দলের আপত্তির কারণে তাকে সমর্থন করতে পারেননি।
এর প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্ররা ক্লাস বর্জন ও ধর্মঘট করে। ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় পালিত হয় \'ভাষা দিবস\'।
\'৪৮ সালের এপ্রিল ৮ সালের এপ্রিল মাসে পূর্ব বাংলার ব্যবস্থাপক সভায় প্রাদেশিক সরকারের কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তী ৩ বছর পর, মার্চ মাসে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দিবস পালিত হয়। আর এই দিবস পালনে শ্রীমঙ্গল থানার ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলের ছাত্ররা শ্রীমঙ্গলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোকেরাও ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আয়েজিত মিছিল ও মিটিং-এ সাহায্য- সহযোগিতা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রদান করেন। ছাত্রদের মিছিল-মিটিং-এব নেতৃত্ব দেন যোগেন্দ্র দত্ত, রাসেন্দ্র দত্ত, বিরাজ কুসুম চৌধুরী, অখিল বন্ধু ধর, শ্যামল সেনগুপ্ত, অচ্যুত কুমার দেব, ডাঃ ফজলুল হক, মোঃ মছন্দর আলী, সৈয়দ মতিউর রহমান প্রমুখ ছাত্র নেতা। তাদের সমর্থন জানান মুসলিম লীগের মোঃ ইছরাইল মিয়া, কমিউনিষ্ট পার্টি নেতা শ্রী সূর্য মনি দেব, অজিত চৌধুরী, কে বি দেব চৌধুরী (ক্ষীরদ বিহারী দেব চৌধুরী), বিমল জ্যোতি চৌধুরী প্রমুখ।
\'৪৮-এর সেপ্টেম্বর-এ জিন্নাহর মৃত্যু হলে খাজা নাজিমউদ্দিন গভর্নর জেনারেল পদে অভিষিক্ত হলেও বাংলা ভাষা-ভাষী জনগণের স্বার্থে কোন কাজ করার প্রয়াসী ছিলেন না।
\'৪৯ সালের ২৭ নবেম্বর তৎকালীন ডাকসু নেতৃবৃন্দ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্মারকলিপি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের নিকট প্রদান করেন। কিন্তু এ দাবি বাস্তবায়িত না হলে বাংলার জনগণ বিশেষত ছাত্র সমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যা পরবর্তীতে রক্তক্ষয়ী বৈপ্লবিক আকার নিয়ে \'৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ নাম জানা-অজানা অনেকে প্রাণ হারান। ছাত্র সমাজের রক্তে রাঙা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও রাজপথ। এই ছাত্রদের উপর পাকিস্তানের শাসকচক্রের নির্দেশে পুলিশের গুলিতে নিহত- আহতদের স্মরণে সারাদেশের ছাত্র সমাজ জীবনপন মারমুখী সংগ্রামে নেমে পড়েন।
শ্রীমঙ্গলের ভাষা সৈনিকদের মাঝে একমাত্র জীবিত ভাষা সৈনিক রাসেন্দ্র দত্ত
এ সংগ্রামে শ্রীমঙ্গলের ছাত্রসমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ধানার ছাত্রছাত্রীদের সমবেত করে বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপিত নেতাকর্মীরা এর প্রতিবাদে সারা শ্রীমঙ্গল শহরে পোস্টারিং করে, মিছিলে মিছিলে শহর মুখরিত হয়ে ওঠে, মিছিলের ভাষা ছিল রফিক, জব্বার, বরকত, সালামের রক্ত মুছে ফেলা শক্ত, রক্তের বদলে রক্ত চাই, খুনের বদলে খুন চাই, বাংলার কুসন্তান নূরুল আমিনের ফাঁসি চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মানতে হবে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই নইলে এবার রক্ষা নাই, ছাত্রদের রক্তে রাজপথ রাঙা কেন জুলুম শাহী জবাব চাই ইত্যাদি। মিছিলকে সর্বতোভাবে সমর্থন করে এলাকার হিন্দু-মুসলিম-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ঘর থেকে রাস্তায় নেমে পড়ে। শ্রীমঙ্গল পৌরসভা মাঠে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার - উপস্থিতিতে একটি বিশাল জনসভা সৈয়দ মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র হত্যার বিরুদ্ধে ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বক্তব্য রাখেন রাসেন্দ্র দত্ত, মোঃ শাহজাহান, অখিল চন্দ্র ধর, সাজ্জাদুর রহমান, বলাই ভট্টাচার্য প্রমুখ নেতা। সভায় বক্তারা নূরুল আমিনের ফাঁসি ও হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মাতৃভাষা বাংলাকে অবিলম্বে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা দেবার জোর দাবি জানান।
১৯৫৪ সালে ভাষা সমস্যাকে অন্যতম ইস্যু কবে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে এবং ছাত্র হত্যা ও ভাষা আন্দোলন দাবিয়ে রাখার কারণে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভবাডুবি ঘটে। পরবর্তীতে পূর্ব বাংলার জনগণের আন্দোলনের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে পাক সরকার \'৫৬ সালে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দান করে।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম ও \'৬৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গলের বালিশিরা কৃষক আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত গণু ও সালিকের স্মৃতিকে, স্মরণীয়-বরণীয় করে তুলতে \'৬৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির ক\'দিন পূর্বে শহীদ সালিকের ফুফাত ভাই ন্যাপনেতা মোঃ শাহজাহান, সাইয়িদ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ মুয়ীজুর রহমান, ছাত্র ইউনিয়নের এককালীন প্রতিষ্ঠাতা জিএস পরে আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ ইলিয়াস, মোঃ আলতাফুর রহমান চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা এম এ রহিম, মোঃ শামসুদ্দিন, বিশিষ্ট প্লেনটার মোখলেছুর রহমানের প্রচেষ্টায় শ্রীমঙ্গলে পৌর টাউন কমিটির মাঠে মুসলিম লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয়। এই শহীদ মিনারই শ্রীমঙ্গলের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসাবে পরিচিত এবং প্রতিবছরই ১৯ ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস, জাতীয় দিবস, বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি পালন উপলক্ষে শ্রীমঙ্গল থানার সব ক\'টি সংগঠন এখানে শহীদী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পুষ্পস্তবকে সাজিয়ে রাখে শহীদ মিনার বেদীটি।
ছবি:
১) প্রায় পাঁচ দশক পূর্বের দুর্লভ এই ছবিটি তৎকালীন ছাত্রলীগনেতা ও পরবর্তীতে শ্রীমঙ্গল পৌরসভা সাবেক চেয়ারম্যান এম এ রহিমের কন্যা রুমানা আক্তার ঝুমুর পোস্ট থেকে নেয়া। শ্রীমঙ্গল পৌরসভা প্রাঙ্গণে যখন শহীদ মিনারটি তৈরি করা হয়েছিল তৎকালীন সময়ের ছবি। তাতে এম এ রহিমসহ তৎকালীন সময়ে যে ক\'জন উদ্যোক্তা হিসেবে ছিলেন তাদের দেখা যাচ্ছে।
২)