img

অলীক পঙক্তি

প্রকাশিত :  ১৬:২০, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

অলীক পঙক্তি

রেজুয়ান আহম্মেদ

সার্কাসের মঞ্চে প্রতিদিন আলো জ্বলে ওঠে। রঙিন পোশাক পরা শিল্পীরা একে একে দর্শকদের সামনে হাজির হয়। কেউ আগুন নিয়ে খেলে, কেউ দড়ির ওপর অনায়াসে হেঁটে যায়, কেউবা বাঘের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে ভয়কে জয় করে। দর্শকদের করতালিতে মুখর হয়ে ওঠে পুরো প্রাঙ্গণ। মনে হয়, এ যেন এক রঙিন জগৎ—যেখানে দুঃখের কোনো অস্তিত্ব নেই, কষ্টের কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু এই আনন্দময় মঞ্চের আড়ালে লুকিয়ে থাকে কিছু অদৃশ্য গল্প, কিছু না বলা কান্না, কিছু চাপা দীর্ঘশ্বাস—যা সার্কাসের ঝলমলে আলোয় ঢাকা পড়ে যায়।

রাসেল সার্কাসের এক জনপ্রিয় নাম ছিল। একসময় সে ছিল দর্শকদের উচ্ছ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু। তার প্রতিটি পারফরম্যান্স ছিল বিস্ময়কর—দড়ির ওপর তার ক্ষিপ্র চলন, বাঘের সামনে তার নির্ভীক উপস্থিতি কিংবা আগুনের বল নিয়ে তার খেলা—সবকিছুই মানুষকে মুগ্ধ করত। কিন্তু সময় বদলায়। বয়সের ভারে তার ক্ষিপ্রতা কমে আসে, শরীর ধীরে ধীরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এখন যখন সে মঞ্চে ওঠে, তার মুখের হাসিটা যেন শুধুই একটি মুখোশ। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি পদক্ষেপ তাকে মনে করিয়ে দেয়—সার্কাসের দুনিয়ায় নতুনদের জন্য জায়গা হয়, কিন্তু পুরনোদের জন্য নয়।

তার ভেতরে প্রশ্ন জাগে—এই সার্কাস কি সত্যিই তার জন্য ছিল? নাকি সে ছিল শুধুই এক খেলার পুতুল, যার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে একদিন সরিয়ে দেওয়া হবে?

রাসেলের ছোট বোন সারা ছোটবেলায় সার্কাস নিয়ে মুগ্ধ ছিল। রঙিন আলো, জাদুর মতো খেলা—সবকিছুই তাকে মোহিত করত। সার্কাস ছিল তার কাছে স্বপ্নের জগৎ, যেখানে জীবন শুধু আনন্দময়। কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখের সামনে এক অন্য সত্য উন্মোচিত হয়।

সে দেখতে শুরু করে, সার্কাসের মানুষগুলো হাসলেও তাদের ভেতরে চাপা কষ্ট লুকিয়ে থাকে। তারা আহত হলেও ব্যথা দেখানোর সুযোগ পায় না, ক্লান্ত হলেও বিশ্রামের সময় মেলে না। অনেকের মুখে সাজানো হাসি থাকে, কিন্তু মনটা পড়ে থাকে বিষণ্নতার অতল গহ্বরে।

একদিন সারা উপলব্ধি করে—সার্কাসের হাসি সবসময় সত্যিকারের হাসি নয়। অনেকের চোখের জল সেখানে ঝলমলে আলোয় ঝাপসা হয়ে ওঠে, কিন্তু তা মাটিতে পড়ে না। এই মঞ্চ যেন বাস্তব জীবনের উল্টো প্রতিচ্ছবি—যেখানে সত্যকে ঢেকে রাখা হয়, আর মিথ্যাকে উপস্থাপন করা হয় আনন্দ হিসেবে।

সার্কাসের ট্রাপিজ শিল্পী অলিম্পিয়া প্রতিদিন বাতাসে উড়ে বেড়ায়, এক দড়ি থেকে আরেক দড়িতে লাফ দেয়, দর্শকদের শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্ত উপহার দেয়। কিন্তু তার নিজের জীবনটাই যেন এক ঝুঁকিপূর্ণ খেলা। সে জানে না, পরের দিন সে থাকবে কি না। একটি ভুল মানেই মৃত্যু অবধারিত।

এক রাতে অলিম্পিয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে। মুখে তার সেই চিরচেনা হাসি, কিন্তু চোখে গভীর শূন্যতা। সার্কাসের এই আলো কি সত্যিই তার জন্য? নাকি এই আলো ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করছে?

অলিম্পিয়া ভাবে—এই জীবন থেকে কি বেরিয়ে আসা সম্ভব?

একদিন রাসেল, সারা ও অলিম্পিয়া সিদ্ধান্ত নেয়—তারা এই সার্কাসের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসবে। তারা আর কৃত্রিম আলোয় নিজেদের হারিয়ে ফেলতে চায় না। তারা চায় এমন এক জীবন, যেখানে সবকিছু বাস্তব, যেখানে তাদের সত্যিকারের পরিচয় থাকবে।

কিন্তু বেরিয়ে আসা কি এত সহজ?

যখন তারা সার্কাস ছেড়ে বাস্তব জীবনে পা রাখে, তখন বুঝতে পারে—বাইরের দুনিয়া তাদের জন্য প্রস্তুত নয়।

রাসেল ছোট্ট একটা শহরে গিয়ে কাজ খোঁজে, কিন্তু সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে—\"তুমি কি সেই সার্কাসের ছেলে?\" তারা বিশ্বাসই করতে চায় না যে, সার্কাসের কেউ অন্য কিছু করতে পারে।

সারা লেখালেখি শুরু করে। সে সার্কাসের অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে গল্প লিখতে থাকে। কিন্তু প্রথমদিকে কেউই তার লেখা গুরুত্ব দেয় না। সবাই ভাবে—সার্কাসের মেয়ে লেখক হবে কীভাবে?

অলিম্পিয়া প্রথমদিকে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সার্কাস ছাড়া তার আর কোনো পরিচয় নেই, তার দক্ষতা শুধুই ট্রাপিজ খেলা। নতুন জীবনে সে কী করবে?

তবে তারা কেউই হাল ছাড়ে না।

রাসেল ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলে। সে কঠোর পরিশ্রম করে, নতুন কিছু শিখতে থাকে। একটা সময় সে নিজের ব্যবসা শুরু করে, যেখানে সার্কাসের পুরনো শিল্পীদের জন্য নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়।

সারার লেখাগুলো একসময় পাঠকদের মনে দাগ কাটতে শুরু করে। তার লেখা ছাপা হতে থাকে পত্রিকায়, বই প্রকাশিত হয়, মানুষ তার কাহিনিগুলো পড়ে কাঁদে, ভাবতে শেখে।

অলিম্পিয়া নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে শেখে, নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করে। একসময় সে সার্কাসে কাজ করা নারীদের জন্য একটি সংগঠন তৈরি করে, যেখানে তাদের জীবনের উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

তারা বুঝতে পারে—তাদের সত্যিকারের আলো কখনোই সার্কাসের মঞ্চে ছিল না। সেটি ছিল তাদের হৃদয়ের গভীরে, যা এতদিন তারা দেখেনি। সার্কাস তাদের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট পরিধির মধ্যে আবদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেই গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসার পর তারা বুঝতে পারে—জীবন অনেক বড়, অনেক গভীর।

তারা শিখেছে—হাসি শুধুই মুখের নয়, এটি হৃদয়েরও হতে হয়। সত্যিকারের আনন্দ আসে তখনই, যখন মানুষ নিজের মতো করে বাঁচতে পারে, নিজের স্বপ্নের পথে হাঁটতে পারে।

সার্কাসের মঞ্চ তাদের জীবনকে সীমাবদ্ধ করেছিল—কৃত্রিম আলো, মেকি হাসি, অভিনয়—সবকিছুর আড়ালে ছিল এক কঠিন বাস্তবতা। কিন্তু তারা সাহস করে সেই অলীক জগৎ থেকে বেরিয়ে এসেছে, সত্যিকারের জীবনের পথে পা রেখেছে।

তারা উপলব্ধি করেছে—পৃথিবী শুধু একটা সার্কাস নয়, বরং এটি এক সত্যিকারের যাত্রা, যেখানে মানুষকে খুঁজে পেতে হয় নিজের সত্তাকে, খুঁজে নিতে হয় জীবনের আসল আলো।

তাদের সেই আলো কখনোই মঞ্চের কৃত্রিম আলোর ভেতরে ছিল না। সেটি ছিল তাদের হৃদয়ের গভীরে—আর সার্কাসের বাইরে বেরিয়ে আসার পরই তারা সেটি খুঁজে পেয়েছে।

এভাবেই রাসেল, সারা, আর অলিম্পিয়া জীবনের নতুন পথে এগিয়ে চলে—যেখানে কোনো মুখোশ নেই, নেই কোনো অলীকতার মোহ। সেখানে শুধু আছে সত্যিকারের তারা—একটি আসল জীবন, যা সার্কাসের আলোয় কখনোই ধরা পড়েনি।

img

খাগড়াছড়িতে নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে চাকমাদের বিজু উৎসব শুরু

প্রকাশিত :  ১২:২৬, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২৮, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

সংগ্রাম দত্ত:পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়ের বৃহত্তম সামাজিক অনুষ্ঠান বিজু উৎসব আজ থেকে শুরু হয়েছে। গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল অর্চনার মাধ্যমে উৎসব শুরু করেছেন খাগড়াছড়ির চাকমা জনগোষ্ঠীরা। 

ফুল বিঝু উপলক্ষ্যে শনিবার (১২ এপ্রিল) ভোর থেকে জেলা সদরের খবংপুড়িয়া এলাকায় চেঙ্গি নদীর দুই পাশে হাজারও নারী-পুরুষ ফুল নিয়ে সমবেত হন। গঙ্গা দেবির উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে পূজা অর্চনা করেন। বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের মিলনমেলায় বর্ণিল উৎসবে রূপ নিয়েছে চেঙ্গি নদীর পার। 

এছাড়া মাঈনি, ফেনী নদীসহ বিভিন্ন জলাধারে ফুল দিয়ে গঙ্গা দেবির অর্চনা করেছেন জেলার অন্যান্য উপজেলায় বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীরা। ফুল দিয়ে উৎসব শুরু, আগামীকাল মূল বিজু এবং শেষ দিন নতুন বছর বা গজ্জ্যাপজ্জ্যা পালন করা হবে। 

চাকমা সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সীরা ফুল সংগ্রহ করে নদী, ছড়া খালে ফুল দিয়ে গঙ্গা দেবির উদ্দেশ্যে পূজা করেন। কেউ একা, আবার অনেকে দলবদ্ধ হয়ে নানা রঙের ফুল গঙ্গা দেবির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে জলাধার। পুরোনো বছরের সব দুঃখ, গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে বরণ করতেই এই ফুল পূজার আয়োজন করেন চাকমারা।

খাগড়াছড়ি সদরের চেঙ্গি নদীতে পূজা অর্চনা করতে আসা কৃষ্ণা চাকমা বলেন, ফুল বিঝুর দিন এখানে এসে অনেক আনন্দিত আমি। আগামীকাল হবে মূল বিজু। বাড়িতে পাজনসহ নানা পদের আয়োজন হবে। অতিথিদের আপ্যায়ন করব। পরদিন নতুন বছর উপলক্ষ্যে উৎসব করব, কেয়াং ঘরে যাব, বাতি জ্বালাব, প্রার্থনা করব।

নিতা চাকমা বলেন, এ অনুষ্ঠান আমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য। আমরা ঐতিহ্য ধারণ করি। আমাদের চাকমাদের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সবাইকে নিয়ে আমরা উৎসব পালন করি।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ সদস্য বঙ্গ মিত্র চাকমা বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর উৎসবমুখর পরিবেশে বিজু উৎসব পালন করছি। আসা করছি অনাগত দিনগুলো ভালো কাটবে। এ সম্মিলিত সংস্কৃতির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্ব বোধ গড়ে উঠবে।

আগামীকাল ১৩ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তির দেনে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘বৈসু’ এবং বাংলা নববর্ষের দিন থেকে মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব শুরু হবে। উৎসব চলবে টানা ৩ দিন।