img

বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো সেরনিয়াবাত ভবন

প্রকাশিত :  ০৫:২১, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো সেরনিয়াবাত ভবন

ছাত্র-জনতার উত্তাল বিক্ষোভের মুখে অবশেষে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো শেখ হাসিনার ভাগ্নে ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বাড়ি।

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে বারোটার পর নগরীর কালীবাড়ি রোডের সেরনিয়াবাত ভবন ঘিরে হাজারো বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা জড়ো হয়। ফেসবুকে আগেই এই হামলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। 

রাত ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে বিক্ষুব্ধরা বাড়ির দেয়াল ভেঙে বুলডোজার প্রবেশ করানোর চেষ্টা করলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাধা দেয়। প্রথমে সেনাবাহিনী বুলডোজারের চাবি নিয়ে নেয় এবং বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু উত্তেজিত ছাত্র-জনতা সেনা সদস্যদের \"ছাত্রলীগের দালাল\" বলে স্লোগান দিতে থাকে। 

একপর্যায়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিক্ষুব্ধদের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।

সেনাসদস্যদের প্রতিরোধ ব্যর্থ হলে রাত ১টা ২০ মিনিটের দিকে সেনাবাহিনী বুলডোজারের চাবি বিক্ষোভকারীদের হাতে তুলে দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সরে যায়। এরপরই ছাত্র-জনতা বুলডোজার চালিয়ে সেরনিয়াবাত ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া শুরু করে।

এই ভবন নিয়ে বহুদিন ধরে আলোচনা চলছিল। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, সাদিক আবদুল্লাহ এই ভবনকে \"টর্চার সেল\" হিসেবে ব্যবহার করতেন। আওয়ামী লীগবিরোধী অনেককে এখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে।

মাহফুজুর রহমান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই বাড়ি ছিল ফ্যাসিবাদের প্রতীক। এখানে মানুষ নির্যাতিত হয়েছে, শোষিত হয়েছে। আমরা এই অভিশপ্ত বাড়ি আর বরিশালে থাকতে দেব না।’

বিক্ষোভকারী ইয়াকুব মিয়া বলেন, ‘সাদিক আবদুল্লাহর এই বাড়ি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির স্মারক। তাই আমরা এটিকে ধ্বংস করছি।’

এর আগেও এই ভবনে হামলা হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট উত্তেজিত জনতা এই ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর থেকেই বাড়িটি জনরোষের কেন্দ্রে পরিণত হয়। 

গত রাতে ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ হাসিনার একটি ভাষণের পর ফের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং ছাত্র-জনতা রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ভাঙচুরের পর বরিশালে সেরনিয়াবাত ভবন গুড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বরিশালসহ সারাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। আওয়ামী লীগ এই হামলাকে ষড়যন্ত্র ও নৈরাজ্য বলে অভিহিত করেছে, অন্যদিকে ছাত্র-জনতা ও বিরোধী দলগুলোর দাবি, এটি ছিল গণঅভ্যুত্থান। 

এই ঘটনার পর বরিশালে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেকোনো মুহূর্তে নতুন সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বরিশালের সেরনিয়াবাত ভবন এখন ধ্বংসস্তূপ। এটি শুধু একটি বাড়ি ছিল না, এটি ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক। এক সময়ের ক্ষমতাধর পরিবারের এই পতন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের নতুন দিকনির্দেশ করছে।

গভীর জঙ্গলে চলছে প্রশিক্ষণ

img

মাতৃভূমিতে ফিরতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত :  ১৭:৫১, ২৭ মার্চ ২০২৫

রোহিঙ্গারা নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরতে সশস্ত্র প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে মিয়ানমারের জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন রোহিঙ্গা যুবকরা। গোপনে চলা এ প্রশিক্ষণের সময় কয়েকদিন পর পর সরিয়ে নিতে হচ্ছে তাঁবুও। দিনের পর দিন প্রশিক্ষণ শিবিরের আকার বাড়ছে। 

 ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্ট বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই জানিয়েছে। 

সংবাদমাধ্যমটি বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা এবং একজন শরণার্থী শিবিরের কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা যোদ্ধারা গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমারে যান এবং অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসেন। তারা প্রস্তুত হচ্ছেন আবারও মিয়ানমারে গিয়ে সামরিক জান্তা ও প্রতিপক্ষ বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়তে। 

নিজেদের সামরিক কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন ২৫ বছর বয়সি রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ আয়াস।  ২০১৭ সালে তিনি প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে শিশুদের বার্মিজ ভাষা শেখান। সম্প্রতি মিয়ানমারের জঙ্গলে ছয় মাসে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।  জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিচ্ছেন যুদ্ধের। 

আয়াস বলেন, ‘আমরা প্রস্তুত। আমার নিজের জীবনের পরোয়া নেই। আমাদের অধিকার, স্বাধীনতা আর মাতৃভূমি ফিরিয়ে আনতে যা লাগে আমি তা করতে প্রস্তুত। ’

ইন্ডিপেন্ডেন্ট জানিয়েছে, আয়াসের মতো শত শত রোহিঙ্গা শরণার্থী স্বেচ্ছায় সশস্ত্র গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছেন; যারা কুতুপালং শিবিরে বছরের পর বছর কাটিয়েছেন। 

চার বছরের কন্যা সন্তানের জনক আয়াস জানান, তিনি ছয় মাস জঙ্গলে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রতিদিন তারা তাঁবু স্থানান্তর করে অবস্থান বদলাতেন যেন ধরা না পড়েন। সকালে বাঁশির আওয়াজে ঘুম ভাঙত, তারপর শুরু হতো শারীরিক প্রশিক্ষণ। এরপর ভাগ হয়ে কেউ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মার্শাল আর্ট শিখতো, কেউ শিখতো প্রযুক্তিগত দক্ষতা—যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার, শত্রু নজরদারি ও কৌশলগত তথ্য সংগ্রহ।

দুপুরে গোসল, খাওয়া ও বিশ্রামের পর আবার শুরু হতো প্রশিক্ষণ।

আয়াস বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য শান্তি। আমরা অধিকার ও সুযোগ নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বাঁচতে চাই। কিন্তু আমাদের ভূমি আজ সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহীদের দখলে। আমরা আমাদের মাতৃভূমি ফেরত চাই—এবং সেটার জন্য লড়াই করব।

তিনি তার গোষ্ঠীর নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি, তবে দাবি করেন, এক হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা যুবক ইতোমধ্যে প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। সব শিবিরেই নিয়োগ চলছে।

রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো অভিযোগ করছে, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের মধ্যে সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহীরা উভয়পক্ষই তাদের (রোহিঙ্গাদের) গণহত্যা ও জোরপূর্বক নিয়োগের শিকার করছে। এক রোহিঙ্গা যোদ্ধা জানান, যদি সু চি ক্ষমতায় ফেরেন, তবে হয়তো পরিস্থিতি বদলাতে পারে—কিন্তু তারা আর অপেক্ষা করতে চান না।

৪২ বছর বয়সি আরেক যোদ্ধা আবু নিয়ামত উল্লাহ বলেন, আমাদের প্রধান শত্রু  মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, যারা গণহত্যা চালাচ্ছে, এরপর আরাকান আর্মি।

তিনি বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে, কেউ প্রশিক্ষণে মিয়ানমারে গিয়ে আবার ফিরে এসে শিবিরে স্বাভাবিক জীবন যাপন করে।

‘কাউকে জোর করি না। শুধু বলি, তুমি কি ফিরতে চাও? কেউ রাজি হলে আমরা তাদের পথ দেখাই। এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, চলছে।’

তিন সন্তানের বাবা নিয়ামত উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের জনগণের ওপর সবসময়ই অন্যায় হয়েছে।  অথচ বিশ্ব মিডিয়া শুধু গাজা ও ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত। রোহিঙ্গাদের নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আর অপেক্ষা করব না। সময় এসেছে নিজেদের রক্ষা করার, নিজের অধিকার আদায় করে নেওয়ার।’

৩০ বছর বয়সি রোহিঙ্গা কমান্ডার রাইনাইং সো (ছদ্মনাম) জানান, এখন আর শান্তির অপেক্ষা নয়—যদি শান্তি না আসে, তবে তারা লড়াই করতেই প্রস্তুত।

রাইনাইং বলেন, পুরো রোহিঙ্গা সম্প্রদায় এখন ঐক্যবদ্ধ। আমরা সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে লড়তে চাই, আমাদের ভূমি ফেরত চাই, আমাদের অধিকার ফেরত চাই। 

তিনি জানান, ২০২১ সালের পর আরাকান আর্মির সঙ্গে সমন্বয়ের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। 

এই কমান্ডার বলেন, ‘তারা মুসলিমদের সঙ্গে কাজ করতে চায় না। শুধু বৌদ্ধদের নিয়ে কাজ করতে চায়। তাই এখন যারাই আমাদের সামনে আসবে—সেনাবাহিনী হোক বা আরাকান আর্মি—আমরা লড়াই করব।’

তবে শিবিরের রোহিঙ্গারা জোরপূর্বক নিয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করলেও, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা শিবিরে প্রায় এক ডজন সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয়; যাদের বিরুদ্ধে মাদক পাচার, চাঁদাবাজি, খুন ও মানবপাচারের অভিযোগ রয়েছে।

এদের মধ্যে রয়েছে- রোহিঙ্গা সংহতি সংস্থা (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ) এবং ইসলামি মাহাজ।

এরমধ্যে আরএসও’র বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে কাজ করছে এবং আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে শরণার্থী শিবির থেকে জোরপূর্বক লোক নিয়োগ করছে। ইতোমধ্যে তাদের নাম খারাপ হওয়ায় তারা মাঝে মাঝে ‘মংডু মিলিশিয়া’ নামে পরিচয় দেয়।

ফর্টিফাই রাইটস-এর পরিচালক জন কুইনলি জানান, তাদের সংস্থা রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত করছে।

তাদের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ১৭ বছরের কিশোরদেরও অপহরণ করে প্রশিক্ষণের জন্য মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘শিবিরে মানবিক সহায়তা ক্রমাগত কমছে। রোহিঙ্গাদের চলাচলে কড়াকড়ি, শিক্ষার সুযোগ নেই, কোনো স্বাধীনতা নেই।’

২০২৩ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে প্রায় দুহাজার জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে ফর্টিফাই রাইটস-এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নিয়োগে ব্যবহার করা হয়েছে ‘আদর্শিক, জাতীয়তাবাদী ও আর্থিক প্রলোভন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, হুমকি ও বাধ্যতামূলক কৌশল’।

এছাড়াও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউএসএইড বন্ধের নির্বাহী আদেশও বড় হুমকি। কারণ, শিবিরের মানবিক সহায়তার ৫৫ শতাংশই ইউএসএইড থেকে আসত।

কুইনলি বলেন, ‘এই অবস্থায়, আরও মানুষ অস্ত্র হাতে নেওয়ার পথ বেছে নিতে পারে—যদি না বাংলাদেশ সরকার তাদের কাজের সুযোগ, স্বাধীন চলাফেরা বা সম্মানজনক জীবন যাপনের অনুমতি দেয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘যাদের সঙ্গে আমি শিবিরে কথা বলেছি, তারা প্রবল হতাশ ছিলেন। অনেকের জন্য অস্ত্র তুলে নেওয়াই এখন নিজের ভাগ্য গড়ার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’