img

আয়না ঘরের বন্দি: এক ভয়াল নির্যাতনের ইতিহাস!

প্রকাশিত :  ১১:২০, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৫০, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

আয়না ঘরের বন্দি: এক ভয়াল নির্যাতনের ইতিহাস!

রেজুয়ান আহম্মেদ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিপীড়ন ও দমন-পীড়নের গল্প নতুন নয়। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে এমন এক নির্যাতনের পদ্ধতি চালু হয়েছিল, যা মানুষের মনে গভীর আতঙ্কের ছাপ ফেলে গিয়েছে— "আয়না ঘর"। এটি ছিল এক ভয়ংকর জায়গা, যেখানে বন্দিদের শুধু শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকভাবেও ভেঙে ফেলার জন্য এক বিভীষিকাময় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল।

এই আয়না ঘর ছিল এক ধরনের মানসিক নির্যাতন কেন্দ্র, যেখানে বন্দিদের চারপাশের দেয়ালে শুধু আয়না ছিল। দিনের পর দিন সেখানে বন্দিরা নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে বাধ্য হতো, নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করতে বাধ্য হতো। সেখানে কাউকে সরাসরি হত্যা করা হতো না, তবে এমন এক মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হতো, যা একজন মানুষকে আস্তে আস্তে ভেতর থেকে মেরে ফেলতে পারত।

এই লেখায় আমরা আয়না ঘরের ভয়াবহ বাস্তবতা, সেখানে নির্যাতিত মানুষদের অভিজ্ঞতা এবং এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।

আয়না ঘরের উৎপত্তি ও নির্যাতনের ধরন

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন কোনো সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভয়ভীতি ও নিপীড়নকে হাতিয়ার বানায়, তখন মানবাধিকারের লঙ্ঘন চরম আকার ধারণ করে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী দলের কর্মী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা কিংবা সাধারণ মানুষ— যেকোনো ব্যক্তিকে রাতের আঁধারে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। যাদের নাম সরকারের ‘কালো তালিকায়’ চলে যেত, তাদের পরিণতি হতো ভয়াবহ। অনেকে গুম হয়ে যেত, আর যারা ফিরে আসত, তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত না। কারণ, তারা ছিল আয়না ঘরের বন্দি।

আয়না ঘরের অভ্যন্তরীণ নির্মাণ ও নির্যাতন পদ্ধতি

এই নির্যাতনকেন্দ্রটি ছিল একেবারে ভিন্ন। বন্দিদের এমন এক ঘরে রাখা হতো, যার চারপাশের দেয়ালে ছিল শুধু আয়না। কোনো জানালা থাকত না, বাইরের দুনিয়ার কোনো দৃশ্য দেখা যেত না। ঘরটিকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো ভয়ংকর আলোর মাধ্যমে— কখনো অত্যন্ত উজ্জ্বল আলো জ্বালিয়ে চোখ ঝলসে দেওয়া হতো, আবার কখনো সম্পূর্ণ অন্ধকার করে ফেলা হতো।

বন্দিদের চোখ বাঁধা অবস্থায় সেখানে আনা হতো। তারপর হঠাৎ চোখ খুলে দেওয়া হতো, যাতে তারা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

এই কক্ষে বন্দিদের ওপর চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন—

১. প্রচণ্ড ঠান্ডা বা অসহনীয় গরমের মধ্যে রাখা হতো,

২. টানা কয়েক দিন না ঘুমোতে দেওয়া হতো,

৩. নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত খাবার দেওয়া হতো,

৪. আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আত্মসম্মানবোধ ধ্বংস করা হতো,

৫.কানের কাছে উচ্চশব্দ বাজিয়ে রাখা হতো, যাতে মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়,

৬. পরিবারকে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হতো,

৭. আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বন্দিকে নিজেকেই মারতে বাধ্য করা হতো।

এই নির্যাতন এতটাই ভয়ংকর ছিল যে অনেকে কয়েক দিনের মধ্যেই দিশেহারা হয়ে যেত। তারা ভুলে যেত তারা কোথায় আছে, কতদিন ধরে বন্দি, এমনকি নিজের নামও মনে করতে পারত না।

মানসিক ধ্বংসের কৌশল

এই নির্যাতন ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। কাউকে হত্যা না করেও তাকে জীবন্মৃত করে রাখা ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

বন্দিদের মানসিকভাবে ধ্বংস করার জন্য যেসব কৌশল ব্যবহার করা হতো—

 ১. মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করা: বন্দিদের বলা হতো, তাদের পরিবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাদের বন্ধুরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

 ২. আয়নার মাধ্যমে বিভ্রম সৃষ্টি করা: বিশেষ আলোর সাহায্যে আয়নায় এমন প্রতিচ্ছবি দেখানো হতো, যাতে মনে হতো বন্দির শরীর বিকৃত হয়ে গেছে।

 ৩. সময় ও বাস্তবতার অনুভূতি ধ্বংস করা: বন্দিরা কতদিন ধরে বন্দি, সেটি বোঝার কোনো উপায় রাখত না। কখনো দিনের বেলা রাতের পরিবেশ তৈরি করা হতো, আবার কখনো রাতেও কৃত্রিম আলো জ্বালিয়ে রাখা হতো।

আয়না ঘর থেকে মুক্তি পেলেও মুক্তি নেই

যারা কোনোভাবে মুক্তি পেত, তারা আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারত না। কেউ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত, কেউ আত্মহত্যা করত, কেউ সারাজীবন আতঙ্কে কাটাত।

একজন ভুক্তভোগীর বর্ণনায়—

"আমি আয়না ঘর থেকে বের হওয়ার পরও আমার চারপাশের আয়নাগুলো কথা বলে। যখন ঘরে ঢুকি, মনে হয় আবার বন্দি হয়ে গেছি। আয়নায় নিজেকে দেখলে মনে হয়, আমি আর মানুষ নেই, আমি কেবল এক মৃতপ্রায় ছায়া।"

বন্দিদের সমাজও গ্রহণ করতে চাইত না। তারা ছিল ভয়, আতঙ্ক, ও মানসিক অবসাদের জীবন্ত প্রতীক।

রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা

এই নির্যাতন শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি পুরো জাতির মনোবল ধ্বংসের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।

 ১. প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করা:

মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে ভয় পেতে শুরু করল, কারণ তারা জানত এর মূল্য কী হতে পারে।

 ২. সাংবাদিকতা ধ্বংস করা:

সত্য প্রকাশ করলেই গুম হওয়ার ভয় ছিল। ফলে মিডিয়া একসময় সরকারের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হলো।

 ৩. একটি ভীতসন্ত্রস্ত প্রজন্ম তৈরি করা:

তরুণদের শেখানো হলো— সত্য বললে, প্রতিবাদ করলে, তাদের পরিণতি হবে আয়না ঘরের বন্দিদের মতো।

আয়না ঘরের স্মৃতি মুছবে না

"আয়না ঘর" ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের এক ভয়ঙ্কর নিপীড়নযন্ত্র। এটি শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, ছিল নির্মম মানসিক নিপীড়নের কেন্দ্র।

হয়তো সেই ঘরগুলো আজ আর নেই, হয়তো সময় বদলাবে, কিন্তু সেই আয়নার প্রতিচ্ছবি বন্দিদের মনে চিরদিন থেকে যাবে।

কিন্তু ইতিহাস ভুলে গেলে, সেই আতঙ্ক আবার ফিরে আসতে পারে। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো এই নির্মম সত্যের কথা সবাইকে জানানো, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ আয়না ঘরের বন্দি না হয়।

"যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেই আয়না আমি ভেঙে দিতে চাই।"




রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম
img

বংশের পরিচয়!

প্রকাশিত :  ১২:০০, ১২ মে ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

আষাঢ়ের এক ভিজে বিকেল। আকাশের গর্জন থেমে গেছে বটে, কিন্তু বাতাসে এখনো ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। উঠোনে জমে আছে নিঃশব্দতা। দূরের বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গান—যেন সময় থেমে গেছে, কিংবা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।  

রতন মাস্টার বসে আছেন পুরোনো আমগাছটার ছায়ায়। হাতে নাইলনের সুতো, বাঁধছেন মাছ ধরার জাল। দেখে মনে হয়, এই জালের ফাঁকেই তিনি বুনে চলেছেন জীবনের গল্প—ভাঙা স্বপ্ন, না বলা কথা, হারিয়ে যাওয়া সময় আর কিছু গোপন কষ্ট।  

ঠিক এমন সময়, গ্রামের পেছনের কাদা-ঢালা পথ বেয়ে এসে দাঁড়াল সজল। আধময়লা ছেঁড়া জিন্স, হাঁটুর কাছ থেকে ঝুলে থাকা ইয়ারফোনের তার, আর চোখজোড়া যেন কিছু হারানোর গ্লানিতে ঘোলাটে।  

সে আমগাছের গুঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে, একটু নিচু গলায় বলল,  

— “মাস্টার চাচা... শহরের বন্ধুরা মজা করে বলে ‘রংপুরের মফিজ’। তাদের পূর্বপুরুষরা কেউ জমিদার, কেউ ব্যারিস্টার। আর আমার শিকড় তো চাষার ঘরে...”

রতন মাস্টার চশমাটা একটু উঁচু করে তাকালেন। চোখের কোণায় বয়সের ভাঁজ হলেও, দৃষ্টিতে ছিল একরাশ কোমলতা। ঠোঁটে মৃদু হাসি টেনে বললেন,  

— “চা খাবি সজল? পাতলা লেবু চা, না কি গাঢ় দুধ চা?”

সজলের গলা কেঁপে উঠল, সে ফিসফিস করে বলল,  

— “যে চায়ের কাপে বংশের গরিমার সুবাস থাকে, সেই চা চাই…”

রতন মাস্টার জালটা থামিয়ে পাশে রাখলেন। একটু নীরব হয়ে বললেন,  

— “আয়, আজ তোকে একটা গল্প শোনাই। এক চাষার গল্প, যার হাতে ছিল না জমিদারি দলিল, কিন্তু মুঠোয় ছিল বিশুদ্ধ স্বপ্ন আর সৎ ইচ্ছে।” 

এ গল্প আসলে তাঁর নিজের—রতন মাস্টারের। মাটির ঘরে জন্ম তাঁর, টিনের চাল ভেদ করে বৃষ্টির পানি যে ঘরে প্রতিরাতে বালিশ ভিজিয়ে দিত। বাবা শিবু মণ্ডল, গরিব কৃষক; আধ বিঘা জমি, আর সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি। মা পদ্মা দেবী রোজ ভোরে বলে উঠতেন,  

— “মানুষের উপকার করিস রতন। মানুষের পাশে দাঁড়ানোই তো সবচেয়ে বড় ধর্ম।”

রতনের বয়স তখন বারো, সেদিনই তাঁর বাবা না-ফেরার দেশে চলে যান। সেই ছোট্ট কাঁধে সংসারের ভার। গরুর পিঠে চড়ে দুধ বিক্রি করতেন সকালে, আর রাতে স্কুলের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে পড়তেন। পাড়ার ছেলেরা হাসত, বলত—“দুধওয়ালা পণ্ডিত!” 

রতন হেসে বলত, “এক গরু দিচ্ছে শরীরের শক্তি, আরেকটা মনকে দিচ্ছে জ্ঞানের আলো—দুটোই দরকার মানুষ বাঁচাতে।”

একবার পরীক্ষার হলে সবাই নকল করছে। রতন সাদা খাতা জমা দেয়। শিক্ষক রেগে গিয়ে বললেন, “তুই ফেল করলি!”  

রতনের জবাব ছিল—“খাতায় ফেল, কিন্তু বিবেকের খাতায় তো একশো!” 

দিন গড়াতে গড়াতে তাঁর পাঠশালায় ভিড় বাড়ে। গরিব, অনাথ, পথশিশু—সবাই তাঁর ছাত্র। একদিন গ্রামের চেয়ারম্যান ঠাট্টা করে বললেন, “চাষার ঘরে জন্ম নিয়ে এত পড়া শিখে কী করবি?”

রতনের উত্তর ছিল, “জন্ম তো আমার হাতে ছিল না। কিন্তু আমি মানুষের মতো মানুষ হবো, এটা আমার সিদ্ধান্ত!”

মুসলিম-হিন্দু, জাত-পাত তাঁর কাছে কিছুই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ঈদের সকালে গোপাল কাকার বাড়ি গিয়ে হাতে মিষ্টি তুলে দিতেন, আবার দুর্গাপূজায় মুসলিম ছেলেদের সাথে মিলে মণ্ডপে আলপনা আঁকতেন।  

একবার মন্দিরে আগুন ধরলে, তিনি দৌড়ে ঢুকে যান আগুনে। হাত পুড়ে গেলেও মুখে শুধু বললেন, “মানুষের ধর্মে আগুন লাগলে, পানি ঢালাটাই তো আমার কাজ।”

একদিন এক রাজনীতিবিদ এলেন ভোট চাইতে। রতন জিজ্ঞেস করলেন, “গ্রামের সেই অন্ধ মা যার চোখে অস্ত্রোপচারের টাকা নেই, আপনি কি তাঁর জন্য কিছু করেছেন?”

তিন দিন পর রাজনীতিবিদ এসে প্রণাম করে বললেন, “আপনি শিখিয়ে দিলেন, রাজনীতি মানে পকেট ভরা না, হৃদয় ভরা!”

সজল নীরবে শুনছিল। সেদিন থেকে তার ভেতরটা বদলে গেল। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও আর শহরের চাকরির পেছনে ছুটল না। গড়ে তুলল ‘মাটির পাঠশালা’। সেখানে এখন রাস্তার শিশুরা শেখে অক্ষর চিনতে, আর স্বপ্ন দেখতে। রতনের কথা সে লিখে রেখেছে ডায়েরির প্রথম পাতায়—  

“বংশের পরিচয় রক্তে নয়, কর্মে।” 

পঁচিশ বছর কেটে গেছে...  

গ্রামের মেলায় মাইক হাতে সজল দাঁড়িয়ে বলছে,  

— “আমার পেছনে নেই জমিদার বংশ, নেই ইতিহাসের ভারি গরিমা। আছে এক মাটির মানুষ, যিনি আমাকে শিখিয়েছেন—মানুষের পরিচয় তার আদর্শে, তার কাজে।”

মাঠজুড়ে করতালির শব্দ। ছাপড়া ঘর থেকে হেঁটে এলেন এক বৃদ্ধ—রতন মাস্টার। পায়ের জুতা নেই, কিন্তু চোখে জল। গ্রামের মানুষ চিৎকার করে উঠল,  

— “এই তো আমাদের গর্ব, আমাদের বংশ!”  

রতন মাস্টার চোখ মুছে শুধু বললেন,  

— “বংশ মানে জন্ম নয়। বংশ মানে নদীর মতো হওয়া—নিজের পথ নিজেই বানিয়ে, সবার পিপাসা মেটানো।”

তোমার জন্ম হয়তো মাটির ঘরে, কিন্তু কর্ম যদি হয় আকাশ ছোঁয়া, তবে সেই কর্মই তোমার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। কারণ, সত্যিকারের বংশ পরিচয় রক্তে নয়—আদর্শে।