
শবে বরাতের আলো!

রেজুয়ান আহম্মেদ
রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র ঝলমল করছে, তারাদের আলো মাটিতে পড়লে মনে হয় যেন স্বর্গের কোনো দ্বার খুলে গেছে। আজ পবিত্র শবে বরাত। গ্রামের প্রতিটি ঘরে এক অন্যরকম অনুভূতি। কারও হাতে তসবিহ, কেউ কুরআন তিলাওয়াত করছে, কেউ আবার সুগন্ধি মিষ্টি বানাচ্ছে পরিবারের জন্য। মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছে সুরেলা আজান, বাতাসে ভাসছে আতরের সৌরভ।
রাশেদ উঠোনে বসে আছে। তার চোখের সামনে খেলা করছে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো। ছোটবেলায় এই রাত এলেই মা তাকে নিয়ে মসজিদে যেতেন। বাবা হাত ধরে শেখাতেন, কীভাবে দোয়া করতে হয়। কিন্তু এখন? এখন সে বড় হয়েছে, কেমন যেন বদলে গেছে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজও ঠিকমতো পড়ে না, এমনকি এই পবিত্র রাতেও তার অন্তরে কোনো অনুভূতিও ছিল না।
কিন্তু আজকের রাতটায় যেন কিছু একটা আছে। চারপাশের পরিবেশ তাকে নাড়া দিচ্ছে। সে মনে মনে ভাবল, শবে বরাত সম্পর্কে যা কিছু শুনেছে, তা কি সত্যি? এই রাতে কি সত্যিই গুনাহ মাফ হয়? তার মনের প্রশ্নগুলো যেন উত্তর খুঁজছিল।
রাশেদ ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে, শবে বরাত মানে মুক্তির রাত। এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন, ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেন। কোরআনে বলা হয়েছে,
\"হা-মিম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি এটি এক বরকতময় রাতে নাজিল করেছি। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করা হয় আমার পক্ষ থেকে।\" (সূরা আদ-দুখান: ১-৫)
হাদিসেও আছে,
\"যখন শাবান মাসের মধ্যরাত্রি আসে, তখন আল্লাহ দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে আসেন এবং ঘোষণা করেন, ‘কেউ কি ক্ষমা প্রার্থনাকারী আছে? আমি তাকে ক্ষমা করব। কেউ কি রিজিক প্রার্থনাকারী আছে? আমি তাকে রিজিক দেব।\' এই ঘোষণা ফজর পর্যন্ত চলতে থাকে।\" (ইবনে মাজাহ: ১৩৮৮)
মা ছোটবেলা থেকেই এসব বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বড় হওয়ার পর থেকে এসব নিয়ে আর ভাবেনি রাশেদ। কিন্তু আজ যেন কিছু একটা তার ভেতর নাড়া দিচ্ছে।
সে ভাবল, \"আমি তো কত গুনাহ করেছি! আজ যদি সত্যিই আল্লাহর দরবারে ফিরে যাই, তাহলে কি আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন?\"
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাশেদ দাদার কাছে গিয়ে বসে। দাদার বয়স হয়েছে, কিন্তু তার কণ্ঠে এখনো দৃঢ়তা। চোখে এক অদ্ভুত আলো, যেন অনেক কিছু বলার আছে।
দাদা ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, \"বাবা, জানিস, একবার এক যুবক ছিল, নাম তার ফয়সাল। সে খুব গুনাহ করত, নামাজ পড়ত না, মিথ্যা বলত, মানুষকে কষ্ট দিত। একদিন শবে বরাতের রাতে সে ঘুরতে বের হলো, মনে একটুও ভয় বা লজ্জা ছিল না। হঠাৎ এক মসজিদের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে শুনল, ইমাম সাহেব কাঁদছেন, দোয়া করছেন, ‘হে আল্লাহ, এই রাতে সব বান্দাকে ক্ষমা করো!’
ফয়সালের বুক কেঁপে উঠল। সে ভাবল, আল্লাহ কি আমাকেও ক্ষমা করবেন? সে কাঁদতে কাঁদতে সিজদায় পড়ে গেল। এরপর থেকে তার জীবন বদলে গেল।\"
রাশেদ স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তার চোখে পানি চলে এল। দাদার কণ্ঠে যেন এক মহাশক্তি ছিল, যা তার হৃদয়ের প্রতিটি বন্ধ দরজা খুলে দিল।
সে ভাবল, আমিও তো অনেক ভুল করেছি। অনেকবার নামাজ কাজা হয়েছে, মিথ্যা বলেছি, অন্যদের কষ্ট দিয়েছি। আল্লাহ কি আমাকেও ক্ষমা করবেন?
সে অজু করল, জায়নামাজে দাঁড়াল। নামাজ শেষে দু’হাত তুলে আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে বলল,
\"হে আল্লাহ! আমি পাপী, আমি গুনাহগার! কিন্তু তুমি যদি আমাকে ক্ষমা না করো, তাহলে আমার আশ্রয় কোথায়? হে দয়াময়, আমাকে তুমি মাফ করে দাও!\"
তার কান্না থামছিল না। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরছিল। বুকের ভেতর পাথরের মতো যে ভার ছিল, সেটি যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, আজ রাতের আলো তার হৃদয়ের অন্ধকার দূর করে দিয়েছে।
ফজরের আযান হলে রাশেদের চোখে জল ছিল, কিন্তু মনে ছিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি। মনে হচ্ছিল, সে নতুন করে জন্ম নিয়েছে।
সেই রাতের পর থেকে রাশেদ আর আগের রাশেদ নেই। নামাজে আগ্রহ বেড়ে গেল, কুরআন পড়তে লাগল, ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে লাগল। সে বুঝতে পারল, শবে বরাত শুধু একটা রাত নয়—এটা এক পরিবর্তনের নাম, এক নবজীবনের আহ্বান।
শবে বরাতের সেই রাত তাকে নতুন জীবন দিল।