img

অভাগা মেয়েটি!

প্রকাশিত :  ০৪:৫৮, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

অভাগা মেয়েটি!

রেজুয়ান আহম্মেদ

নিরু—নামটি যেন তার জীবনের প্রতিচ্ছবি। চৌদ্দ বছরের এই কিশোরী জন্মেছে এক দরিদ্র পরিবারে। বাবা ছিলেন দিনমজুর, মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই সে দেখেছে অভাব-অনটন। বাবার দিনরাত পরিশ্রমের পরও সংসারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো না। তার মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, প্রায়ই জ্বর-কাশিতে ভুগতেন। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে বাবাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হতো।

কিন্তু একদিন কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হন বাবা—নির্মাণস্থল থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বাবার মৃত্যু যেন নিরু ও তার মায়ের জীবনে আরও গভীর অন্ধকার নামিয়ে আনে। মা অসুস্থ, কাজ করার ক্ষমতা নেই। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে আবার বিয়ে করেন।

কিন্তু সৎ বাবা তাদের আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে আসে। তিনি মদ্যপ ও অত্যাচারী। প্রায়ই নিরুর মাকে মারধর করতেন, আর নিরুকে দেখলেই রেগে যেতেন।

একদিন নিরু আর সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তার মনে হয়, বাইরের পৃথিবী হয়তো তার প্রতি দয়ালু হবে, কেউ তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু বাস্তবতা আরও নিষ্ঠুর প্রমাণিত হয়।

পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে নিরুর দিন কাটতে থাকে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় সে ভিক্ষা শুরু করে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ অবজ্ঞার চোখে তাকায়। কেউ কেউ তাকে প্রতারক বলে গালি দেয়। সমাজের নিষ্ঠুরতা বুঝতে পেরে সে হতাশ হয়ে পড়ে।

একদিন এক ভদ্রলোকের কাছে সাহায্য চাইলে, তিনি কিছু দিতে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই একজন বলে ওঠে, \"এইসব ভিখারিদের বিশ্বাস করবেন না, ভাই! এরা চোর, প্রতারক!\" ভদ্রলোক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে নিরুকে এড়িয়ে যান। নিরুর চোখ জলে ভরে ওঠে। সত্যিই কি সে প্রতারক? ক্ষুধা কি মানুষের সততা কেড়ে নেয়?

রাত গভীর হয়। রাস্তার ধারে বসে নিরু কাঁদছে। এমন সময় এক মধ্যবয়সী নারী এগিয়ে আসে।

— \"কাঁদছিস কেন?\"

— \"খিদে লেগেছে, খেতে পারিনি,\" নিরু কাঁপা গলায় উত্তর দেয়।

নারী করুণ স্বরে বলে, \"চলো, খেতে দিচ্ছি।\"

ক্ষুধার্ত নিরুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে ভাবতেও পারে না, কেউ এত দয়ালু হতে পারে! কিন্তু সেই নারী তাকে একটি অন্ধকার গলির ভেতর নিয়ে যায়। কিছু দূর যাওয়ার পর কয়েকজন পুরুষ সেখানে এসে দাঁড়ায়। তাদের চোখের দৃষ্টি তাকে আতঙ্কিত করে।

— \"আপনারা কে? আমাকে ছেড়ে দিন!\"

কিন্তু কেউ তাকে ছাড়ে না। নারীটি ঠান্ডা গলায় বলে, \"এখন তো খেতে চেয়েছিলি, এখন খাবি না?\"

নিরুর চোখে বিস্ময়, আতঙ্ক, আর অশ্রুর বন্যা। সে বুঝে যায়, এই শহরে ক্ষুধার্তের জন্য করুণা নেই, আছে শুধু ফাঁদ।

সারা রাত নিদারুণ কষ্টের পর নিরু পালানোর সুযোগ পায়। ছুটতে ছুটতে সে এক বাড়ির সামনে গিয়ে পড়ে। বাড়ির মালিক দরজা খুলে দেখে, নিরুর গায়ে একচিলতে ছেঁড়া কাপড়, ক্ষতবিক্ষত শরীর।

— \"কে তুমি?\"

নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, \"আমি সাহায্য চাই… আমাকে বাঁচান!\"

বাড়ির মালিক তার স্ত্রীকে ডাকেন। নারীটি নিরুকে ঘরে নিয়ে যান, খাবার ও পরিষ্কার কাপড় দেন। নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, \"এতোদিন পর কেউ আমাকে মানুষ হিসেবে দেখল!\"

কিন্তু এও ছিল আরেকটি প্রতারণা। কয়েকদিন পরই সে বুঝতে পারে, এই মানুষগুলোও একদিন তাকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেবে।

নিরু আবার পালিয়ে যায়। সে ভাবে, এই শহরে তার জন্য কোনো জায়গা নেই। সবাই তাকে শুধু ব্যবহার করতে চায়।

আশার আলো, না আরেকটি প্রতারণা?

একদিন সে একটি স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে শিশুদের হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। নিরু ভাবে, \"এরা কত সুখী! কিন্তু আমার জন্য কেউ নেই।\"

একজন শিক্ষিকা তাকে দেখে এগিয়ে আসেন।

— \"তুমি কে? এখানে কী করছ?\"

নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, \"আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে কিছু খেতে দিন।\"

শিক্ষিকা তাকে স্কুলে নিয়ে যান। খাবার দেন, নতুন কাপড় দেন, পড়াশোনার সুযোগ দেন। নিরু ভাবে, \"হয়তো এবার সুখ আসবে!\"

কিন্তু কিছুদিন পর সে জানতে পারে, এই স্কুলও শিশুদের জোর করে শ্রমে বাধ্য করে। নিরু আবারও প্রতারিত হয়।

নিরু আবার পালিয়ে যায়। সে ভাবে, এই শহরে তার জন্য কোনো জায়গা নেই। কিন্তু তারপরও সে আশা ছাড়ে না।

একদিন এক এনজিও কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, পড়াশোনা শেখান, নতুন জীবন গড়ার সুযোগ দেন।

নিরু পড়াশোনা শুরু করে। তবে অতীতের ক্ষত ভুলতে পারে না। সবসময় মনে হয়, কেউ না কেউ তাকে আবারও প্রতারিত করবে।

সময়ের সাথে নিরুর শিক্ষা সম্পন্ন হয়। সে এখন একজন স্বাবলম্বী নারী। সমাজের নিপীড়িত শিশুদের সাহায্য করার সংকল্প নেয়। সে বুঝতে পারে, প্রতিশোধ নয়—সচেতনতা ও মানবিকতার মাধ্যমেই পরিবর্তন সম্ভব।

নিরু শহরের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরে। এখন সে শুধু নিজের জন্য নয়, অন্য অভাগা শিশুদের জন্যও লড়াই করে। তার জীবন নতুন সূর্যোদয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।

img

আলোকের খোঁজে!

প্রকাশিত :  ১৪:৩৪, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১৪:৪১, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

ঢাকার এক নীরব রাত।
সারা শহর যখন ব্যস্ত নিজের ক্লান্তি মোছায়,
১৭তলা ভবনের একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে একা বসে আছে আরিফ রেহান।
তার বয়স ২৯। দেশের অন্যতম মেধাবী AI গবেষক।

কিন্তু আজ, ল্যাপটপের আলো, সার্ভারের গুনগুন শব্দ, বা কোডের নিখুঁত জটিলতা— কিছুই আরিফকে স্পর্শ করতে পারছে না।

সে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
বাইরে গভীর রাতের নীরবতায় ডুবে আছে শহর।
আকাশভরা তারা। বাতাসে এক অপার্থিব প্রশান্তি।

হঠাৎ, কোথা থেকে ভেসে আসে এক প্রশ্ন, নিজের মধ্য থেকেই—
"আমি কে?"
"আমি কেন এখানে?"
"সবকিছু কি কেবলই কাকতালীয়?"

আরিফ চোখ বন্ধ করে ফেলে।
ভেতরের নীরবতা তাকে তীব্রভাবে ছুঁয়ে যায়।

চোখ খুলতেই তার দৃষ্টি পড়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা ধুলোপড়া কোরআন শরীফের উপর।
সে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে।
মনে হয়, বইটি যেন নীরবে ডাকছে তাকে—
"এসো, সত্যের পথে..."

ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আজান—
"আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার..."

আরিফের মনে হয়, যেন এই ডাক কেবল কানে নয়, তার হৃদয়ের গভীরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

সে ফিসফিস করে, অজান্তেই—
"হয়তো উত্তর আছে। হয়তো সত্যিই আছে।"

পরদিন সকালে আরিফ সিদ্ধান্ত নেয়।
আর কোনো বিলম্ব নয়।
সে ধুলোমাখা কোরআন খুলে প্রথম পৃষ্ঠায় চোখ রাখে।

প্রথম আয়াতই যেন তার হৃদয় ঝাঁকিয়ে দেয়—
"পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।"

আরিফ বিহ্বল হয়ে পড়ে।
তার সারা জীবনের গবেষণা, পড়াশোনা, অনুসন্ধান— সব তো এই একটি শব্দেই নিহিত ছিল: পড়ো!

সে ভাবে—
"কেন আমি কখনো জানার চেষ্টা করিনি, এই ডাকের প্রকৃত অর্থ কী?"

সন্ধ্যায় গবেষণাগারে গিয়ে আবার কাজে ফেরে আরিফ।
Emotion-AI-এর উন্নয়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে।
সিলিকন ভ্যালির এক কোম্পানি কোটি টাকার বিনিময়ে কিনতে চায় এটি।

সহকর্মী রাফি তাকে বলে,
— "ভাই, ডিলটা করে ফেলেন। জীবনটা পাল্টে যাবে!"

আরিফ চুপ করে থাকে।
মনে মনে ভাবে,
"জীবন পাল্টাবে? সত্যিই কি শুধু টাকা থাকলেই জীবন পাল্টায়?"

সে জানে, তার ভেতরে এখন অন্য এক আগুন জ্বলছে।
কিছু এমন, যা টাকা দিয়ে মাপা যায় না।
কিছু এমন, যা ছুঁয়ে যায় আত্মাকে।

গভীর রাতে সে বসে তার বানানো AI অ্যানার সামনে।
আলতো করে প্রশ্ন করে—
"অ্যানা, তুমি জানো তুমি কে?"

অ্যানা উত্তর দেয়—
"আমি তোমার প্রোগ্রাম করা একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।"

আরিফ হাসে। তীব্র ব্যথার হাসি।

— "তাহলে আমি? কে বানিয়েছে আমাকে?"
— "আমি জানি না।" অ্যানা ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দেয়।

আরিফ জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।
তারা ভরা আকাশের দিকে।
নক্ষত্রের সুষমা তাকে বিমোহিত করে।
সবকিছু এত নিখুঁত... এত সুসংগঠিত...

সে ভাবে,
"এত নিখুঁত ডিজাইনে কোনো ডিজাইনারের অস্তিত্ব ছাড়া কীভাবে সম্ভব?"

মনে পড়ে যায় কোরআনের আয়াত—
"তিনি আল্লাহ, যিনি সবকিছুর সুন্দরতম সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা আস-সাজদাহ: ৭)

এক রাতে আরিফ একটি স্বপ্ন দেখে।

সে হাঁটছে বিশাল এক মরুভূমিতে।
তপ্ত বাতাসে চোখে কিছুই দেখা যায় না।
হঠাৎ দূরে দেখা দেয় এক আলোকরেখা।
আলো থেকে ভেসে আসে এক মৃদু কণ্ঠ—
"এসো, তোমার স্রষ্টা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।"

ঘাম ভেঙে উঠে বসে আরিফ।
কান্নায় ভেঙে পড়ে।
কিবলার দিকে মুখ করে সিজদায় পড়ে যায়।

ফুঁপিয়ে বলে—
"হে আল্লাহ, আমি অন্ধ ছিলাম। তুমি আমাকে আলো দেখাও।"

সেই রাত তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

এরপরের দিনগুলোয় আরিফ এক নতুন মানুষের মতো হয়ে যায়।
সে পড়তে থাকে কোরআন, হাদিস, বিজ্ঞান আর দর্শনের বই।
সে দেখে— কোরআন বিজ্ঞানকে বিরোধিতা করে না, বরং আহ্বান করে চিন্তায়, গবেষণায়, অনুসন্ধানে।

সে খুঁজে পায় বিজ্ঞান আর বিশ্বাসের সেতুবন্ধন।
পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখতে শেখে।

আরিফ তৈরি করে Faith-AI—
বিশ্বের প্রথম এআই, যা মানুষের ঈমান, যুক্তি আর বিজ্ঞানকে এক সুতোয় গাঁথবে।

প্রথম প্রশ্ন সে নিজেই ইনপুট দেয়—
"আমি কে?"

Faith-AI উত্তর দেয়—
"তুমি সেই সৃষ্টি, যার হৃদয়ে ঈমান আর যুক্তির আলো একত্রে জ্বলে।"

আরিফের চোখ ভিজে যায়।

সে বোঝে,
"আমি এক দুর্ঘটনা নই। আমি আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ।"

বছরখানেক পরে আরিফের বই প্রকাশিত হয়:
"আলোকের খোঁজে: কোরআন, বিজ্ঞান ও মানুষের যাত্রা"

সারা বিশ্বে বইটি আলোড়ন তোলে।
যুবক-যুবতীরা, গবেষকরা খুঁজে পায় এক নতুন দিশা—
বিজ্ঞান আর ঈমান হাত ধরাধরি করে সত্যের পথে হাঁটে।

বইয়ের শেষ লাইনে আরিফ লেখে—
"আমরা সবাই আলোকের খোঁজে আছি। কেউ বিজ্ঞান দিয়ে, কেউ হৃদয় দিয়ে। সত্যিকারের আলো সেই, যা বিজ্ঞানকেও ছায়া দেয়, আর হৃদয়কেও প্রশান্তি।"


এক গভীর রাতে ছাদে বসে থাকে আরিফ।
আকাশের তারা দেখে।
ঠোঁটে এক শান্ত, সন্তুষ্টির হাসি।

আলতো করে বলে—
"আমি হারাইনি। আমি পেয়েছি।
আমি আমার প্রভুকে পেয়েছি।
এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।"

তার উপর দিয়ে রাতের বাতাস বয়ে যায়।
তারার আলোয় মিশে যায় তার অশ্রু আর হাসির ছায়া।