
অভাগা মেয়েটি!

রেজুয়ান আহম্মেদ
নিরু—নামটি যেন তার জীবনের প্রতিচ্ছবি। চৌদ্দ বছরের এই কিশোরী জন্মেছে এক দরিদ্র পরিবারে। বাবা ছিলেন দিনমজুর, মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকেই সে দেখেছে অভাব-অনটন। বাবার দিনরাত পরিশ্রমের পরও সংসারের চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো না। তার মা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, প্রায়ই জ্বর-কাশিতে ভুগতেন। চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে গিয়ে বাবাকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হতো।
কিন্তু একদিন কর্মস্থলে দুর্ঘটনার শিকার হন বাবা—নির্মাণস্থল থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন। হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। বাবার মৃত্যু যেন নিরু ও তার মায়ের জীবনে আরও গভীর অন্ধকার নামিয়ে আনে। মা অসুস্থ, কাজ করার ক্ষমতা নেই। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে আবার বিয়ে করেন।
কিন্তু সৎ বাবা তাদের আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে আসে। তিনি মদ্যপ ও অত্যাচারী। প্রায়ই নিরুর মাকে মারধর করতেন, আর নিরুকে দেখলেই রেগে যেতেন।
একদিন নিরু আর সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তার মনে হয়, বাইরের পৃথিবী হয়তো তার প্রতি দয়ালু হবে, কেউ তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু বাস্তবতা আরও নিষ্ঠুর প্রমাণিত হয়।
পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে নিরুর দিন কাটতে থাকে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় সে ভিক্ষা শুরু করে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ অবজ্ঞার চোখে তাকায়। কেউ কেউ তাকে প্রতারক বলে গালি দেয়। সমাজের নিষ্ঠুরতা বুঝতে পেরে সে হতাশ হয়ে পড়ে।
একদিন এক ভদ্রলোকের কাছে সাহায্য চাইলে, তিনি কিছু দিতে যাচ্ছিলেন। ঠিক তখনই একজন বলে ওঠে, \"এইসব ভিখারিদের বিশ্বাস করবেন না, ভাই! এরা চোর, প্রতারক!\" ভদ্রলোক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে নিরুকে এড়িয়ে যান। নিরুর চোখ জলে ভরে ওঠে। সত্যিই কি সে প্রতারক? ক্ষুধা কি মানুষের সততা কেড়ে নেয়?
রাত গভীর হয়। রাস্তার ধারে বসে নিরু কাঁদছে। এমন সময় এক মধ্যবয়সী নারী এগিয়ে আসে।
— \"কাঁদছিস কেন?\"
— \"খিদে লেগেছে, খেতে পারিনি,\" নিরু কাঁপা গলায় উত্তর দেয়।
নারী করুণ স্বরে বলে, \"চলো, খেতে দিচ্ছি।\"
ক্ষুধার্ত নিরুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে ভাবতেও পারে না, কেউ এত দয়ালু হতে পারে! কিন্তু সেই নারী তাকে একটি অন্ধকার গলির ভেতর নিয়ে যায়। কিছু দূর যাওয়ার পর কয়েকজন পুরুষ সেখানে এসে দাঁড়ায়। তাদের চোখের দৃষ্টি তাকে আতঙ্কিত করে।
— \"আপনারা কে? আমাকে ছেড়ে দিন!\"
কিন্তু কেউ তাকে ছাড়ে না। নারীটি ঠান্ডা গলায় বলে, \"এখন তো খেতে চেয়েছিলি, এখন খাবি না?\"
নিরুর চোখে বিস্ময়, আতঙ্ক, আর অশ্রুর বন্যা। সে বুঝে যায়, এই শহরে ক্ষুধার্তের জন্য করুণা নেই, আছে শুধু ফাঁদ।
সারা রাত নিদারুণ কষ্টের পর নিরু পালানোর সুযোগ পায়। ছুটতে ছুটতে সে এক বাড়ির সামনে গিয়ে পড়ে। বাড়ির মালিক দরজা খুলে দেখে, নিরুর গায়ে একচিলতে ছেঁড়া কাপড়, ক্ষতবিক্ষত শরীর।
— \"কে তুমি?\"
নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, \"আমি সাহায্য চাই… আমাকে বাঁচান!\"
বাড়ির মালিক তার স্ত্রীকে ডাকেন। নারীটি নিরুকে ঘরে নিয়ে যান, খাবার ও পরিষ্কার কাপড় দেন। নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, \"এতোদিন পর কেউ আমাকে মানুষ হিসেবে দেখল!\"
কিন্তু এও ছিল আরেকটি প্রতারণা। কয়েকদিন পরই সে বুঝতে পারে, এই মানুষগুলোও একদিন তাকে অন্য কারও কাছে বিক্রি করে দেবে।
নিরু আবার পালিয়ে যায়। সে ভাবে, এই শহরে তার জন্য কোনো জায়গা নেই। সবাই তাকে শুধু ব্যবহার করতে চায়।
আশার আলো, না আরেকটি প্রতারণা?
একদিন সে একটি স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে শিশুদের হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। নিরু ভাবে, \"এরা কত সুখী! কিন্তু আমার জন্য কেউ নেই।\"
একজন শিক্ষিকা তাকে দেখে এগিয়ে আসেন।
— \"তুমি কে? এখানে কী করছ?\"
নিরু কাঁদতে কাঁদতে বলে, \"আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে কিছু খেতে দিন।\"
শিক্ষিকা তাকে স্কুলে নিয়ে যান। খাবার দেন, নতুন কাপড় দেন, পড়াশোনার সুযোগ দেন। নিরু ভাবে, \"হয়তো এবার সুখ আসবে!\"
কিন্তু কিছুদিন পর সে জানতে পারে, এই স্কুলও শিশুদের জোর করে শ্রমে বাধ্য করে। নিরু আবারও প্রতারিত হয়।
নিরু আবার পালিয়ে যায়। সে ভাবে, এই শহরে তার জন্য কোনো জায়গা নেই। কিন্তু তারপরও সে আশা ছাড়ে না।
একদিন এক এনজিও কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন, পড়াশোনা শেখান, নতুন জীবন গড়ার সুযোগ দেন।
নিরু পড়াশোনা শুরু করে। তবে অতীতের ক্ষত ভুলতে পারে না। সবসময় মনে হয়, কেউ না কেউ তাকে আবারও প্রতারিত করবে।
সময়ের সাথে নিরুর শিক্ষা সম্পন্ন হয়। সে এখন একজন স্বাবলম্বী নারী। সমাজের নিপীড়িত শিশুদের সাহায্য করার সংকল্প নেয়। সে বুঝতে পারে, প্রতিশোধ নয়—সচেতনতা ও মানবিকতার মাধ্যমেই পরিবর্তন সম্ভব।
নিরু শহরের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরে। এখন সে শুধু নিজের জন্য নয়, অন্য অভাগা শিশুদের জন্যও লড়াই করে। তার জীবন নতুন সূর্যোদয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে।