
পত্রিকা বিক্রেতা

রেজুয়ান আহম্মেদ
শীতের ভোরে ময়মনসিংহ শহরটাকে মনে হচ্ছিল ধূসর চাদরে মোড়ানো এক বিষণ্ণ চিত্রকর্ম। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানগুলো কাঁপতে কাঁপতে আগুনের ধোঁয়া তুলছিল, আর ফুটপাতজুড়ে জড়ো হয়েছিলেন দিনমজুর থেকে শুরু করে স্কুলের ছাত্ররা—সবাই যেন ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমেছিলেন। সেই ভিড়ের মধ্যেই এক চিরচেনা চেহারা—হাশেম চাচা। তাঁর বয়স এখন সত্তর পেরিয়েছে, কিন্তু সংসারের চাকা এখনও থামেনি।
চার দশক আগে, যখন এই শহরে প্রথম এসেছিলেন, তখন তিনি ছিলেন উজ্জ্বল চোখের এক তরুণ, যার হাতে ছিল সাইকেল আর স্বপ্নের বোঝা। সেই সাইকেলটাই এখন জীর্ণ, আর তার ব্যাগে ভরা থাকে আজকের পত্রিকা। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় প্রেস থেকে পত্রিকা নিয়ে তিনি তিন কিলোমিটার সাইকেল চালাতেন। কোমরে ব্যথা, হাঁটুতে বাত—তবুও থামতেন না। মিষ্টি হেসে বলতেন, \"এটাই তো আমার সকালের নামাজ।\"
আশির দশকে হাশেম চাচার দিন শুরু হতো মানুষের হাসি আর গল্পে। অফিসার সাহেবরা তাঁর কাছ থেকে পত্রিকা কিনে গ্রামের খবর জানতে চাইতেন, ছাত্ররা বক্সিং ম্যাচের স্কোর জানতে চাইত। তখন পত্রিকা ছিল সমাজের আয়না। কিন্তু এখন? এখন তাঁর ডাকে সাড়া দেয় না কেউ। মানুষের হাতে স্মার্টফোন, চোখে স্ক্রিনের নেশা। পত্রিকার পাতায় জমে থাকা কালির মতো হাশেম চাচার জীবনও যেন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে।
\"দৈনিক খবর! আজকের বড় শিরোনাম! খবর নেবেন, সাহেব?\"—হাশেম চাচার কণ্ঠে এখনও সেই জোর, কিন্তু কোনো প্রতিধ্বনি নেই। একদিন এক যুবক বলেছিল, \"চাচা, আপনি ইন্টারনেটে খবর পড়েন? এখানে তো সব ফ্রি!\" হাশেম চাচা মুচকি হেসেছিলেন, \"বাবা, আমার হাতের স্পর্শটাই তো খবরের স্বাদ। পর্দায় কি সেটা পাবে?\"
হাশেম চাচার ঘর বলতে টিনের চালাওয়ালা এক ঝুপড়ি, যার দেয়ালে ছেঁড়া চটের আস্তরণ। স্ত্রী মারা গেছেন দশ বছর আগে। তিন সন্তান—বড় ছেলে রিকশা চালায়, মেজো ছেলে কাজের সন্ধানে মালয়েশিয়ায়, আর ছোট মেয়ে মিতু স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েই গার্মেন্টসে কাজে নেমেছে। রাতের খাবারের টেবিলে কথার চেয়ে নিঃশ্বাসের শব্দই বেশি।
\"বাবা, তুমি আর কত দিন এই কষ্ট করবে?\" মিতুর চোখে জল। শুকনো রুটি খাওয়ার সময় হাশেম চাচা বলতেন, \"যত দিন হাত-পা চলে, তত দিন।\"
কিন্তু সংখ্যাগুলো তাঁর বিরুদ্ধে। আগে দিনে দুশো টাকা আয় হতো, এখন পঞ্চাশ টাকাও দুষ্কর। পত্রিকার দাম বাড়লেও ক্রেতা কমেছে। কখনো কখনো তিনি নিজের চায়ের পয়সা বাঁচিয়ে মিতুর জন্য একটি কলম কিনে দিতেন।
সেদিন সন্ধ্যার রোদ লাল হয়ে এসেছিল। হাশেম চাচার ব্যাগে তখনও কুড়িটি পত্রিকা অবিক্রীত। ঠিক তখন এক কিশোর এসে দাঁড়াল—স্কুল ড্রেস, চোখে উজ্জ্বলতা। \"চাচা, একটা পত্রিকা দিন।\" হাশেম চাচা উৎসাহভরে পত্রিকা বাড়িয়ে দিলেন।
\"টাকা নেই আজ। কাল দেব,\" এক মুহূর্ত নীরবতা। তারপর হাশেম চাচার হাসি: \"নাও বাবা, পড়ে ফেলো। টাকার চেয়ে জ্ঞান বড়।\"
সেই ছেলেটির নাম আরিফ। পরের দিন সে ফিরে এলো দুটি আপেল নিয়ে। \"চাচা, বাবা বললেন আপনাকে দিতে।\" সেদিন থেকে প্রতি শুক্রবার আরিফ আসে, কখনো একটি ফল, কখনো পুরনো বই—বিনিময়ে নেয় পত্রিকা। এই সম্পর্ক হয়ে উঠল হাশেম চাচার জীবনের একমাত্র উজ্জ্বল দাগ।
মার্চের এক ঠাণ্ডা বিকেলে হাশেম চাচা সাইকেল ঠেলছিলেন। হঠাৎ বুকে তীক্ষ্ণ ব্যথা—বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো। তিনি ধপ করে ফুটপাতে বসে পড়লেন। পাশ দিয়ে যাওয়া মানুষজন ভেবেছিল, হয়তো বিশ্রাম নিচ্ছেন। কেউ থামল না।
আরিফ সেদিন স্কুল থেকে দৌড়ে এসেছিল। \"চাচা! আজকে বিজ্ঞান প্রজেক্টের জন্য...\" সে থমকে গেল। হাশেম চাচার হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরা একটি পত্রিকা, চোখ বন্ধ।
পরদিন সকালে শহরের প্রথম পাতার খবর: \"ডিজিটাল যুগে হারিয়ে গেলেন শেষ পত্রিকা বিক্রেতা!\" কিন্তু কেউ পড়ল না সেই খবর।
আরিফ সাইকেলের পাশে একটি ফুল রেখে গেল। মিতু কাঁদতে কাঁদতে বাবার পুরনো ডায়েরি খুলল—সেখানে লেখা:
\"আমার জীবনটা যেমন পত্রিকার পাতার মতো—কিছু মানুষ পড়ে, বেশির ভাগ উড়ে যায়। তবুও আমি লিখে যাই...\"
হাশেম চাচার মৃত্যুর পর তাঁর জায়গায় এলো এক তরুণ, বিক্রি করে মোবাইল রিচার্জ কার্ড। কিন্তু রাস্তার মোড়ে এখনও কানে বাজে এক বৃদ্ধের ডাক: \"খবর নেবেন, সাহেব?\"
পরিশিষ্ট: সংখ্যায় হাশেম চাচা
- ৪২ বছর: পত্রিকা বিক্রির সময়
- ১,২০,০০০+: হাতে বিক্রি করা পত্রিকা
- ০ টাকা: শেষ দিনের আয়
- ১টি আপেল: শেষ উপহার
এই গল্প কোনো একক মানুষের নয়—এটি সকল হারিয়ে যাওয়া হাতের স্পর্শ, মুখের কথার মৃত্যুঞ্জয়ী সাক্ষ্য।
হাশেম চাচারা চলে যান, কিন্তু তাদের ফাঁকা জায়গায় থেকে যায় এক অদৃশ্য প্রশ্ন:
\"প্রগতির মিছিলে আমরা কতজনকে পেছনে ফেলে যাচ্ছি?