
মানুষ মানুষের জন্য!

রেজুয়ান আহম্মেদ
"মানুষ মানুষের জন্য"—এই ছোট্ট বাক্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সভ্যতার সবচেয়ে মৌলিক সত্য। কথাটা শুনতে সাদামাটা লাগলেও এর গভীরতা সমুদ্রের মতো। একদিন গুহায় বসবাসকারী আদিম মানুষ যখন প্রথম একসঙ্গে শিকার করেছিল, তখন থেকেই এই বাক্যের জন্ম। কিন্তু আজকের হাইটেক পৃথিবীতে আমরা কি আমাদের এই সহজাত সহমর্মিতা ভুলে যাচ্ছি?
ইতিহাসের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে নির্মম বাস্তবতা। সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা হোক বা মিশরের পিরামিড নির্মাণ—সবকিছুর পেছনে ছিল সম্মিলিত প্রচেষ্টা। মজার ব্যাপার হলো, প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য যখন দাস প্রথায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল, তখনই শুরু হয়েছিল তার পতন। আর সেই সময়েই গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, "সমাজের মঙ্গলেই ব্যক্তির মঙ্গল।" আজকের দিনে এই কথাটি কি অপ্রাসঙ্গিক?
১৯৭১ সালের কথা মনে পড়ে? যেদিন এই দেশের মানুষ একে অপরের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। আমার দাদু বলতেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিটি ঘর ছিল একেকটি অস্থায়ী হাসপাতাল। অচেনা মানুষও মুহূর্তেই আপন হয়ে উঠত। অথচ আজ? পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দার নামটুকু পর্যন্ত জানি না আমরা!
মনোবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন—মানুষ প্রকৃতিগত ভাবেই সামাজিক প্রাণী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিঃসঙ্গ মানুষের মস্তিষ্কে যে অংশ সক্রিয় হয়, শারীরিক ব্যথার সময়ও সেই একই অংশ সক্রিয় হয়। অর্থাৎ, একাকিত্ব ধীরে ধীরে আমাদের ভেতর বিষ ঢালে। জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপের দীর্ঘায়ু মানুষের রহস্য কী জানেন? সেখানে শতবর্ষী বৃদ্ধরাও প্রতিদিন অন্তত পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে গল্প করেন!
ডিজিটাল যুগে আমরা কি সত্যিই সংযুক্ত?
ফেসবুকে হাজারো বন্ধু থাকলেও জন্মদিনে ফোন করে শুভেচ্ছা জানায় কয়জন?
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একজন আমেরিকান কিশোর দিনে গড়ে ১০০ বার ফোন চেক করে, কিন্তু প্রকৃত কথোপকথনে ব্যয় করে মাত্র ২০ মিনিট! আমাদের দেশের শহুরে জীবন কি খুব ভিন্ন? রিকশাচালকের সঙ্গে কথা না বলে মোবাইলে মগ্ন থাকা আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস হয়ে গেছে।
মহামারির সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো মনে আছে?
রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনলেই জানালা বন্ধ করে দিতাম আমরা। অথচ একই সময়ে মানবতার কত অসাধারণ দৃষ্টান্তও দেখেছি! ইতালির এক বৃদ্ধা প্রতিদিন বারান্দা থেকে নামাজ পড়তেন, আর মুসলিম প্রতিবেশী তাকে খাবার পৌঁছে দিতেন। ভারতে এক শিখ পরিবার গুরুদ্বারার দরজা খুলে দিয়েছিল সব ধর্মের মানুষের জন্য। এগুলো কি শুধু সংবাদের শিরোনাম, নাকি আমাদের অন্তরের মানবতাকে নাড়া দেয়?
অর্থনীতির ক্লাসে শিখেছিলাম—"একতাই বল"।
গ্রামীণ ব্যাংকের গল্প জানেন তো? একসময় যেসব নারী স্বাক্ষর পর্যন্ত দিতে পারতেন না, তারাই আজ ব্যাংকের মালিক! কুমিল্লার এক গ্রামে কৃষকদের সমবায় সমিতি দেখেছিলাম, যারা শুধু জমির উর্বরতা বাড়ায়নি, গড়ে তুলেছে কমিউনিটি লাইব্রেরিও। সেখানে সপ্তাহে দুই দিন শিশুদের বিনামূল্যে কোচিং দেওয়া হয়!
সংস্কৃতির বৈচিত্র্যেও সহমর্মিতার প্রকাশ দেখা যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার "উবুন্টু" দর্শন শিহরণ জাগায়—"আমি কারণ আমরা আছি।"
বর্ণবাদে বিদীর্ণ দেশটিকে যখন নেলসন ম্যান্ডেলা এই দর্শন দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন, তখনই জন্ম নিয়েছিল নতুন দক্ষিণ আফ্রিকা।
অন্যদিকে জাপানের "ওমোতেনাশি" শুধুই আতিথেয়তা নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক অনুভূতি। টোকিও অলিম্পিকের স্বেচ্ছাসেবকদের চোখে যে উষ্ণতা দেখেছিলাম, তা কি ভোলার মতো?
একটি ছোট গল্প বলি—
ভারতের চেন্নাইয়ে এক রেস্তোরাঁর দেয়ালে লেখা— "একটি খাবার কিনুন, আরেকটি দান করুন।"
রেস্তোরাঁর মালিক জানালেন, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রতিদিন অতিরিক্ত খাবার সংগ্রহ করে দরিদ্রদের জন্য রেখে দেয়। অথচ আমাদের দেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে প্লেটের পর প্লেট খাবার ফেলে দেওয়া হয়!
প্রযুক্তি কি কেবল আমাদের বিচ্ছিন্ন করছে?
ইউক্রেন যুদ্ধের সময় "ইউনাইটেড২৪" প্ল্যাটফর্মে বিশ্ববাসী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে ভার্চুয়াল রিয়ালিটি ব্যবহার করে অটিস্টিক শিশুরা শিখছে সামাজিক আচরণ!
প্রযুক্তি একদিকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, আবার নতুন সেতুও গড়ে দিচ্ছে।
শিক্ষা প্রসঙ্গে ফিনল্যান্ডের কথা মনে পড়ে। ওখানে স্কুলগুলোতে "সহানুভূতি" নামে আলাদা শ্রেণি আছে! সেখানে শিশুরা শেখে অন্যদের কষ্ট বোঝার কৌশল।
আমাদের দেশেও কি এটি সম্ভব? হ্যাঁ, যদি ছোট পরিসরে শুরু করি।
আমার বোনের স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রতি শুক্রবার পুরোনো বই সংগ্রহ করে গরিব ছাত্রদের দেয়। এটাও তো এক ধরনের মানবতা!
রাজনীতির অস্থিরতা দেখে হতাশ লাগে, কিন্তু নরওয়ের কারাগারের গল্প আশা জাগায়। ওখানে বন্দিরা বাগান করেন, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান।ফলাফল? অপরাধে পুনরায় জড়ানোর হার মাত্র ২০%!
বাংলাদেশের "একটি বাড়ি একটি খামার" প্রকল্পও তো সমাজ গঠনেরই অংশ। আর যখন তরুণেরা স্বেচ্ছায় রক্তদান গ্রুপ গড়ে তোলে, তখন মনে হয়—
অন্ধকারের মধ্যেও আলোর রেখা আছে।
২০৫০ সালের পৃথিবীর কথা ভাবুন!
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে, রোবট আমাদের কাজ করবে। কিন্তু বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের সতর্কবাণী ভুললে চলবে না— "বিভেদই আমাদের ধ্বংস করবে।"
তখনই মনে পড়ে কবির সেই অমোঘ পঙ্ক্তি— "মানুষই মানুষের ভরসা।"
একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে শেষ করি—
গত সপ্তাহে রিকশা থেকে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। এক অচেনা ভাই তাঁর নতুন শার্ট খুলে ব্যান্ডেজ বানিয়ে দিলেন। দুই দিন পর দেখা করতে গিয়ে দেখি, তিনি সেই একই শার্ট পরা—দাগটি এখনো রয়ে গেছে!
এটাই কি নয়—"মানুষ মানুষের জন্য"?
পৃথিবী বদলাবে না, যদি আমরা বদলাতে না চাই।
একটি হাত বাড়িয়ে দেওয়া, একটি হাসি ভাগ করে নেওয়া—এই ছোট্ট কাজগুলোই ইতিহাস গড়ে। আসুন, আমরা সবাই মিলে সেই ইতিহাস রচনা করি।
কারণ শেষ পর্যন্ত সত্য একটাই—
"প্রতিটি মানুষই আরেক মানুষের আশ্রয়।"