রাতের আকাশে চাঁদ উঠেছিল কি না, কেউ খেয়াল করেনি। খেয়াল করবেই বা কেন? আলো থাকলেও অন্ধকার ছিল, নিশ্চুপ রাতে নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। একটা ছোট্ট জীবন নিভে গেছে—এটা নিশ্চিত। হয়তো তার ছোট্ট হাতে তখনও পুতুলের কোমল স্পর্শ লেগে ছিল। হয়তো সে স্বপ্ন দেখছিল এক রঙিন পৃথিবীর, যেখানে মা-বাবার আদর আছে, বড় বোনের ভালোবাসা আছে, আর আছে নিরাপত্তা। কিন্তু সেই পৃথিবী তার জন্য ছিল না। নিষ্ঠুর নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে গেছে এক অনিশ্চিত অন্ধকারে।
তার নাম জানার দরকার নেই, কারণ সে এখন শুধুই এক ব্যথার প্রতীক। এক ফুটন্ত কুঁড়ি, যা খোলসেই ঝরে গেল। জীবন বোঝার আগেই তাকে বুঝতে হলো মানুষের নিষ্ঠুরতা। ছোট্ট পায়ে ছুটে গিয়েছিল বড় বোনের বাড়িতে, আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে। কে জানত, সেই ঘরই তার শেষ ঠিকানা হয়ে উঠবে?
রাত গভীর হচ্ছিল। শিশুটি হয়তো ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়েছিল, চোখের পাতায় ঘুম জমছিল। ঘরের আলো নিভে গিয়েছিল, কিন্তু কোথাও যেন অন্য এক ছায়া নেমে এসেছিল। কিছুক্ষণ পরেই সেই ছোট্ট চোখদুটো নিথর হয়ে গেল, নিঃশ্বাস থেমে গেল চিরতরে। বড় বোন যখন ফিরে এলেন, তখন কী যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার! আলো জ্বালাতেই দেখলেন, ছোট্ট শরীরটা নিথর পড়ে আছে। বুকের ভেতর কীসের যেন এক প্রচণ্ড ধাক্কা! ভয়, কান্না, চিৎকার—সবকিছু যেন এক অদৃশ্য দেয়ালে আটকে গেল।
সমাজের নিস্তব্ধতা, অন্যায়ের আস্ফালন
শাশুড়ির কঠোর নিষেধ—পরিবারের মান-সম্মান নষ্ট করা যাবে না। কিন্তু মান-সম্মান কি একজন শিশুর জীবনের চেয়ে বড়? একটা নিষ্পাপ প্রাণ নিঃশেষ হয়ে গেল, আর সমাজ নিশ্চুপ! এই সমাজ কি কখনো তার উত্তর দেবে, কেন শিশুরা এখনো নিরাপদ নয়? কেন তারা দানবদের লালসার শিকার হয়?
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে, কিন্তু চিকিৎসকরা দায়সারা দায়িত্ব পালন করলেন। মেয়েটি তখনও কষ্টে ছটফট করছিল, আর সমাজ তখনও মুখ ফিরিয়ে ছিল। এ কেমন সভ্যতা, যেখানে নিষ্পাপ চোখের কান্না দেওয়ালের মতো উপেক্ষিত হয়?
মা আর বড় বোনের মনে একটাই প্রশ্ন—কাদের প্রতি তাদের সন্দেহ করা উচিত? সেই দুলাভাই? নাকি শ্বশুর? কিংবা আরও কেউ? কিন্তু একটা শিশুর কী দোষ ছিল? তার তো ওড়না পরার বয়সও হয়নি!
এতগুলো প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই, শুধু এক নিঃসঙ্গ শোকের স্রোত বইতে থাকে। চারদিকে অন্ধকার, আর অন্ধকারের মাঝেই হারিয়ে যায় শিশুটির নিথর শরীর।
শেষ আর্তনাদ: এক পরিত্যক্ত স্বপ্ন
জানি না, শেষ মুহূর্তে কী ভেবেছিল সে। কী দেখে চোখ বন্ধ করেছিল? ভালোবাসাহীন এই পৃথিবী, নাকি নিষ্ঠুর মানুষের মুখ? সে কি চেয়েছিল একবার মাকে জড়িয়ে ধরতে? না কি বড় বোনের কোলে ফিরে যেতে?
এই পৃথিবী কি তার ছিল? নাকি সে ভুল করে এমন এক গ্রহে জন্মেছিল, যেখানে ভালোবাসা নেই, সুরক্ষা নেই, নেই শিশুর নিষ্পাপ হাসির মূল্য?
কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই, কোনো প্রতিশোধ নেই। এই সমাজ কেবল শোক পালন করে, তারপর ভুলে যায়। নতুন কোনো খবর এলেই তার শোকও ভেসে যায় অন্য তরঙ্গে।
আমরা কি সত্যিই মানুষ? নাকি আমরা কেবলই মানুষ হওয়ার ভান করে যাচ্ছি?
এই প্রশ্ন ছুঁড়ে রইল নিঃসঙ্গ অন্ধকারে। কেউ কি দেবে তার উত্তর?
রেজুয়ান আহম্মেদ: লেখক, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম
আমি মাঝে মাঝে ভাবি—আজ যদি কবি নজরুল ইসলাম জীবিত থাকতেন, তবে তিনি কী করতেন? যদিও এই প্রশ্নটি স্থান, কাল ও পাত্রের সূচকগুলোকে বিবেচনায় না নিয়েই করা হচ্ছে, তারপরও কিছু আকাঙ্ক্ষা মনের গভীর থেকে উঠে আসে, যা প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু সত্য উপলব্ধির ফসল।
আমার মতে, এটি একটি যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক মতও বটে যে নজরুল ইসলাম, একজন ধর্মপরায়ণ পরিবারের সন্তান হয়েও ধর্মের মূল উদ্দেশ্য—মানবকল্যাণ—উপলব্ধি করেছেন জ্ঞান, যুক্তি ও ঈশ্বর-চেতনার মাধ্যমে। তাইতো তিনি লিখেছেন:
“খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে,
প্রলয়-সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে, প্রভু নিরজনে...”
এই উপলব্ধি কোথা থেকে এসেছে? আমার ধারণা, ঈশ্বরের করুণা ব্যতিরেকে এমন চিন্তা সম্ভব নয়। তবে এটাও আমার বিশ্বাস—সারাক্ষণ ঈশ্বরচিন্তা করলেও তাঁর করুণা সবসময় নাও আসতে পারে। এখানে গ্রন্থগুলোতে ঈশ্বর যেখানে মানুষের মানবতাকে মূল্য দিয়েছেন, সেই ধর্মীয় উপলব্ধির গভীরতাই নজরুলকে অনন্য করে তোলে।
নজরুল এক অনন্য মাত্রায় ঈশ্বর ও মানবতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তিনি সব ধর্মের প্রতি সম্মান রেখেছেন এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে নিজের জীবনে ধারণ করেছেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়, বরং অসীম ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিনীত নিবেদন ও আনুগত্য, যেখানে তিনি সকল ধর্মের ঈশ্বরের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে ইসলামি ধর্মীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তিনি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা একজন অমুসলিম পাঠকের মনেও ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা ও সংবেদনশীলতা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম—যেমনটি দুই বাংলাতেই আমাদের বাঙালি মননে অনেকের মধ্যেই ঘটেছে।
নজরুলের এই সাহিত্য-শক্তির কারণেই তাঁর ধর্ম, নানান সংস্কৃতি ও বিশ্বময় বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি করে। তিনি এতটাই বৈচিত্র্যে আকৃষ্ট সাহিত্যিক ছিলেন, যিনি সারা পৃথিবীর বৈচিত্র্যকে তাঁর সৃষ্টিতে ও জীবনবোধে এক বৈশ্বিক রূপ দিয়েছেন। যেখানে ছিল না কোনো গণ্ডি ও সংকীর্ণতা। একজন কবি এত দারিদ্র্য ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও কোনো অভিযোগ ছাড়াই কী রকম মুক্তমন নিয়ে নিজেকে বিকশিত করেছিলেন, আর বাঙালি মননকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় শুদ্ধ করেছিলেন।
বাংলা সাহিত্যে নজরুলের মতো করে শ্যামাসঙ্গীত, ভজন বা সনাতন ধর্মীয় গানে মৌলিক অবদান আর কেউ রাখেননি। এই বৈচিত্র্যই তাঁকে তুলনার ঊর্ধ্বে স্থাপন করে। সাহিত্যের প্রতিটি শাখা স্বতন্ত্র—এখানে কারও সাথে কারও তুলনা হয় না, কারণ এই ক্ষেত্রটি বিশাল, যার কোনো কোলকিনারা নেই। এখানে নানান সাহিত্য উপাদান বা কনটেন্ট উপস্থাপনাই গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প ও সাহিত্যের বিজ্ঞানের নিয়মের বিচারে একেক জনের সৃষ্টি একেক জনকে অনন্য সাধারণ হিসেবে স্থান করে দিয়েছে।
উপনিবেশিক রাজনীতির সংকীর্ণ প্রয়োজনে যখন হিন্দু-মুসলমান বিভাজন সমাজে প্রকট হয়ে উঠল—যা মুঘল আমলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় ছিলই না—তখন নজরুল হয়ে উঠলেন জাতির বিবেক। তিনি শুধু কবিই ছিলেন না, ছিলেন সাম্যবাদী চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী। বিপ্লবী রাজনীতিবিদদের সাংস্কৃতিক মানের প্রশ্নে তিনি তাদেরকে তাঁর সাহিত্যরস দিয়ে পরিচালিত করেছেন, শক্তি জুগিয়েছেন।
সম্প্রতি নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কিছু সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতা তাঁকে স্মরণ করে বাণী দিয়েছেন। এটি প্রশংসনীয়। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম—সাম্য, বিদ্রোহ, শোষণবিরোধিতা ইত্যাদি—সব শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে, শুধু “অসাম্প্রদায়িকতা” শব্দটি নেই। কেন? এই শব্দ ব্যবহার করলে কি বেশিরভাগ সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন মানুষগুলোর বিশ্বাসে আঘাত আসতে পারে? এই বিশ্বাস কি তার ধর্মীয় চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক? না তার অজ্ঞানতা বা না বোঝার ফলে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আজ সংক্রামিত হয়েছে? আমার মতে, এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কবি নজরুলকে বোঝা খুবই গুরুত্ব বহন করবে।
অসাম্প্রদায়িকতা কি সাম্যের অংশ নয়? অন্য ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সম্মান, নারীর সমমর্যাদা, ধর্মভিত্তিক বৈষম্য রোধ—এগুলো কি সাম্যের পরিপূরক নয়? তাহলে নজরুলের সাম্যের দর্শনে এই বিষয়গুলো কি অনুপস্থিত থাকবে, যারা এই শব্দগুলো ব্যবহার করছেন?
আমরা সবাই জানি, নজরুল ভারতের কবি হলেও বাংলাদেশ তাঁর শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার পেয়েছে। এই পাওয়া আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া, কিন্তু ভারতের অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষদের ক্ষোভ আছে এই বিষয়ে। এই অমূল্য রত্নকে যদি শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করি—সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি বাদ দিয়ে কেবল দলীয় ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যাত করি—তাহলে আমরা আসলে কী শিখছি? ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকেও কি এমনটাই শেখাব?
এই প্রশ্নগুলোর সাথে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও জাতিসত্তাভিত্তিক বাংলাদেশের ভাগ্য জড়িত। তথাকথিত \"বহুত্ববাদ\"ও এই প্রশ্নগুলোর সাথেই সম্পর্কিত।
বহুত্ববাদ মানে শুধু কারও ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায় শুধরে দেওয়া নয়—বরং সকল মত, জাতি ও ধর্মের সহাবস্থান নিশ্চিত করা। নিজের বিশ্বাসকে অন্যের ওপর চাপিয়ে না দেওয়ার সহিষ্ণুতা। এই বহুত্ববাদই বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। এই ভূখণ্ডে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান—সবাই যুগে যুগে ধর্ম প্রচার করেছেন, আবার সহঅবস্থানেরও দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে, পেছনে ফিরে যাওয়াকে কখনো উৎসাহ দেয় না। তাই বাঙালির প্রকৃত পরিচয়—বৈচিত্র্য-বিশ্বাসী ও পরমত সহিষ্ণু জাতি—যদি জোর করে চেপে ধরা হয়, তবে প্রকৃতি একদিন এর প্রতিক্রিয়া দেবে—যা আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে না।
এটাই সামাজিক বাস্তবতা।
গণতন্ত্রে বিশ্বাস যদি সত্যিই কেউ করে, তাহলে তা কখনোই সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে অবজ্ঞা করে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সুইজারল্যান্ড মাত্র কয়েক হাজার ইতালিয়ান ভাষাভাষীর জন্য রোমানশ ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়েছে। আমরা ইউরোপে থাকি, কিন্তু ইউরোপ থেকে কী শিখছি? দেশে কী ফিরিয়ে নিচ্ছি? নজরুলের কথা বলছি, কিন্তু তাঁকে বুঝে? না না বুঝে?
যুক্তরাজ্য থেকে আইনে ডিগ্রি নিয়ে ব্যারিস্টার হয়ে অনেকেই দেশে রাজনীতি করছেন বা করবেন, কিন্তু দেশে গিয়ে বিদেশের সোনা লোহা হয়ে যায় কেন? এটা সামাজিক বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে অস্বীকার করা নয়, যুক্তির কষ্ঠিপাথরে থেকেও নিজের সাথে প্রতারণা করে অবিশ্বাস করা।
আগামী দিনে যারা রাজনীতি করবেন, তাদের নৈতিকতাবোধ কি বিবেচনায় আসবে না? যদি না আসে, তাহলে কি আমরা একই বৃত্তে ঘোরপাক খাবো? আগাবো না?
এই প্রশ্নগুলো আজকের বিশ্বায়িত রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির যুগে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জয়দ্বীপ রায়: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংস্কৃতি কর্মী, লন্ডন।