
শবে কদরের ফজিলত: মহিমান্বিত রজনীর রহস্য ও মুমিনের আত্মিক উৎকর্ষ

রেজুয়ান আহম্মেদ
ইসলামের পবিত্রতম রাতগুলোর মধ্যে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী। এই রাতটি শুধুমাত্র একটি রাতই নয়; এটি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, ক্ষমা ও নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ। কুরআন-হাদিসে এই রাতের ফজিলত এত ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, মুমিনের হৃদয় বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায়। এই লেখায় শবে কদরের তাৎপর্য, ঐশ্বরিক মহিমা, ইবাদতের পদ্ধতি এবং আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করা হবে।
১. শবে কদর: পরিচয় ও কুরআনিক ভিত্তি
শবে কদর ফারসি শব্দ, যার অর্থ "মর্যাদার রাত" বা "ভাগ্যের রাত"। আরবিতে এটি লাইলাতুল কদর নামে পরিচিত। এটি পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯তম রাতে) সংঘটিত হয়। এই রাতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সম্পূর্ণ একটি সূরা (সূরা আল-কদর) নাজিল করেছেন—
"নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কী? কদরের রাত এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের রবের অনুমতিতে সকল বিষয়ে অবতরণ করেন। এটি শান্তির রাত, যা ফজরের সূচনা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।"
(সূরা আল-কদর: ১-৫)
এই আয়াতগুলোতে দুটি মূল বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে—
ক. এই রাতের মর্যাদা এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
খ. এ রাতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং এটি শান্তি ও কল্যাণে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে।
এক হাজার মাস বলতে সাধারণত ৮৩ বছর ৪ মাস বোঝানো হয়। অর্থাৎ, এই এক রাতের ইবাদত একজন মানুষের সারাজীবনের ইবাদতের সমান বা তার চেয়েও বেশি সওয়াবের অধিকারী!
২. শবে কদরের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপট
শবে কদর কেবল একটি রাত নয়; এটি মানব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এ রাতেই প্রথম কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আসমানে নাজিল হয়েছিল। পরবর্তীতে ২৩ বছর ধরে প্রয়োজনানুসারে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর তা অবতীর্ণ হয়।
আল্লাহর বিশেষ রহমত
এই রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের জন্য ক্ষমা, রিজিক, সুস্থতা ও ভাগ্য নির্ধারণের ফয়সালা করেন।
"এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।" (সূরা আদ-দুখান: ৪)
অর্থাৎ, পরবর্তী এক বছরের জীবন-মৃত্যু, ভালো-মন্দ, বিপদ-সুযোগ সবই এ রাতে লিপিবদ্ধ হয়। এজন্যই এ রাতকে "ভাগ্যের রাত" বলা হয়।
৩. হাদিসের আলোকে শবে কদরের ফজিলত
রাসুলুল্লাহ (সা.) বহু হাদিসে এই রাতের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন—
ক. গুনাহ মাফের সুযোগ
"যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব (আল্লাহর প্রতিদানের আশা) সহকারে শবে কদরে ইবাদত করে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।" (বুখারি: ১৯০১)
খ. এক হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াব
"এই রাতের ইবাদত এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।" (সূরা আল-কদর: ৩)
৪. শবে কদর খোঁজার নির্দেশ ও রহস্য
নবী (সা.) বলেছেন—
"রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ করো।" (বুখারি: ২০২১)
এর সঠিক তারিখ গোপন রাখার হিকমত হলো—
মুমিনরা যেন সমগ্র রমজান, বিশেষত শেষ দশকজুড়ে ইবাদতের প্রতি মনোযোগী থাকে।
ঈমানদারদের পরীক্ষার জন্য, যাতে তারা শুধু নির্দিষ্ট রাতের জন্য অপেক্ষা না করে বরং প্রতিটি রাতেই ইবাদত করে।
৫. শবে কদরের আমল: কিভাবে এই রাত কাটাবেন?
এই রাতের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে নিম্নোক্ত আমল করা উচিত—
ক. নফল নামাজ: তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, সালাতুত তাওবা ইত্যাদি পড়া।
খ. কুরআন তিলাওয়াত: এ রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছে, তাই এর তিলাওয়াত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ. দোয়া ও ইস্তিগফার: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো দোয়া—
"আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওয়ুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।" (হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করুন।)
৬. শবে কদরের নিদর্শন: কিভাবে চিনবেন?
কিছু হাদিসে এ রাতের আলামত বর্ণিত হয়েছে—
প্রাকৃতিক শান্তি: রাতটি অত্যন্ত নির্মল ও প্রশান্তিদায়ক হয়।
সূর্যের নিষ্প্রভ উদয়: সকালে সূর্য অনুজ্জ্বল থাকে (মুসলিম: ৭৬২)।
আধ্যাত্মিক অনুভূতি: অনেক মুমিন এই রাতে বিশেষ এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করেন।
৭. আধুনিক যুগে শবে কদরের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
সময় ব্যবস্থাপনা: ব্যস্ত জীবনে রাত জাগার কৌশল— ছোট ছোট নফল নামাজ, পরিবারের সাথে পালাক্রমে ইবাদত।
ডিজিটাল বিভ্রান্তি: মোবাইল ও সামাজিক মাধ্যম থেকে দূরে থেকে একাগ্রচিত্তে ইবাদত করা।
৮. শবে কদরের আহ্বান
শবে কদর মুমিনের জীবনে এক আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের রাত। এই রাতে আমাদের উচিত—
অতীতের গুনাহের জন্য অনুশোচনা করা
ভবিষ্যতে আল্লাহর পথে চলার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা
দোয়া, ইবাদত ও সমাজসেবার মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা
আসুন, আমরা এই মহিমান্বিত রজনীতে আল্লাহর দরবারে মাথা নত করি এবং তাঁর ক্ষমা ও রহমত প্রার্থনা করি।
লাইলাতুল কদর আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিক— এই প্রার্থনায়।