img

শবে কদরের ফজিলত: মহিমান্বিত রজনীর রহস্য ও মুমিনের আত্মিক উৎকর্ষ

প্রকাশিত :  ০৫:২৩, ২৫ মার্চ ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৫:২৯, ২৫ মার্চ ২০২৫

শবে কদরের ফজিলত: মহিমান্বিত রজনীর রহস্য ও মুমিনের আত্মিক উৎকর্ষ

রেজুয়ান আহম্মেদ

ইসলামের পবিত্রতম রাতগুলোর মধ্যে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী। এই রাতটি শুধুমাত্র একটি রাতই নয়; এটি আল্লাহর অফুরন্ত রহমত, ক্ষমা ও নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ। কুরআন-হাদিসে এই রাতের ফজিলত এত ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, মুমিনের হৃদয় বিস্ময় ও শ্রদ্ধায় নত হয়ে যায়। এই লেখায় শবে কদরের তাৎপর্য, ঐশ্বরিক মহিমা, ইবাদতের পদ্ধতি এবং আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করা হবে।

 ১. শবে কদর: পরিচয় ও কুরআনিক ভিত্তি

শবে কদর ফারসি শব্দ, যার অর্থ "মর্যাদার রাত" বা "ভাগ্যের রাত"। আরবিতে এটি লাইলাতুল কদর নামে পরিচিত। এটি পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকের কোনো এক বেজোড় রাতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭ বা ২৯তম রাতে) সংঘটিত হয়। এই রাতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে সম্পূর্ণ একটি সূরা (সূরা আল-কদর) নাজিল করেছেন—

"নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) কদরের রাতে নাজিল করেছি। তুমি কি জানো, কদরের রাত কী? কদরের রাত এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের রবের অনুমতিতে সকল বিষয়ে অবতরণ করেন। এটি শান্তির রাত, যা ফজরের সূচনা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।"

(সূরা আল-কদর: ১-৫)

এই আয়াতগুলোতে দুটি মূল বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে—

ক. এই রাতের মর্যাদা এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

খ. এ রাতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং এটি শান্তি ও কল্যাণে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে।

এক হাজার মাস বলতে সাধারণত ৮৩ বছর ৪ মাস বোঝানো হয়। অর্থাৎ, এই এক রাতের ইবাদত একজন মানুষের সারাজীবনের ইবাদতের সমান বা তার চেয়েও বেশি সওয়াবের অধিকারী!

 ২. শবে কদরের ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপট

শবে কদর কেবল একটি রাত নয়; এটি মানব ইতিহাসের এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এ রাতেই প্রথম কুরআন লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আসমানে নাজিল হয়েছিল। পরবর্তীতে ২৩ বছর ধরে প্রয়োজনানুসারে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর তা অবতীর্ণ হয়।

আল্লাহর বিশেষ রহমত

এই রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের জন্য ক্ষমা, রিজিক, সুস্থতা ও ভাগ্য নির্ধারণের ফয়সালা করেন।

 "এ রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।" (সূরা আদ-দুখান: ৪)

অর্থাৎ, পরবর্তী এক বছরের জীবন-মৃত্যু, ভালো-মন্দ, বিপদ-সুযোগ সবই এ রাতে লিপিবদ্ধ হয়। এজন্যই এ রাতকে "ভাগ্যের রাত" বলা হয়।

 ৩. হাদিসের আলোকে শবে কদরের ফজিলত

রাসুলুল্লাহ (সা.) বহু হাদিসে এই রাতের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন—

ক. গুনাহ মাফের সুযোগ

 "যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাব (আল্লাহর প্রতিদানের আশা) সহকারে শবে কদরে ইবাদত করে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।" (বুখারি: ১৯০১)

খ. এক হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াব

"এই রাতের ইবাদত এক হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।" (সূরা আল-কদর: ৩)

 ৪. শবে কদর খোঁজার নির্দেশ ও রহস্য

নবী (সা.) বলেছেন—

"রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর তালাশ করো।" (বুখারি: ২০২১)

এর সঠিক তারিখ গোপন রাখার হিকমত হলো—

মুমিনরা যেন সমগ্র রমজান, বিশেষত শেষ দশকজুড়ে ইবাদতের প্রতি মনোযোগী থাকে।

ঈমানদারদের পরীক্ষার জন্য, যাতে তারা শুধু নির্দিষ্ট রাতের জন্য অপেক্ষা না করে বরং প্রতিটি রাতেই ইবাদত করে।

 ৫. শবে কদরের আমল: কিভাবে এই রাত কাটাবেন?

এই রাতের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে নিম্নোক্ত আমল করা উচিত—

ক. নফল নামাজ: তাহাজ্জুদ, সালাতুত তাসবিহ, সালাতুত তাওবা ইত্যাদি পড়া।

খ. কুরআন তিলাওয়াত: এ রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছে, তাই এর তিলাওয়াত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গ. দোয়া ও ইস্তিগফার: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো দোয়া—

"আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুওয়ুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।" (হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করুন।)

 ৬. শবে কদরের নিদর্শন: কিভাবে চিনবেন?

কিছু হাদিসে এ রাতের আলামত বর্ণিত হয়েছে—

প্রাকৃতিক শান্তি: রাতটি অত্যন্ত নির্মল ও প্রশান্তিদায়ক হয়।

সূর্যের নিষ্প্রভ উদয়: সকালে সূর্য অনুজ্জ্বল থাকে (মুসলিম: ৭৬২)।

আধ্যাত্মিক অনুভূতি: অনেক মুমিন এই রাতে বিশেষ এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করেন।

 ৭. আধুনিক যুগে শবে কদরের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

সময় ব্যবস্থাপনা: ব্যস্ত জীবনে রাত জাগার কৌশল— ছোট ছোট নফল নামাজ, পরিবারের সাথে পালাক্রমে ইবাদত।

ডিজিটাল বিভ্রান্তি: মোবাইল ও সামাজিক মাধ্যম থেকে দূরে থেকে একাগ্রচিত্তে ইবাদত করা।

 ৮. শবে কদরের আহ্বান

শবে কদর মুমিনের জীবনে এক আধ্যাত্মিক পুনর্জাগরণের রাত। এই রাতে আমাদের উচিত—

অতীতের গুনাহের জন্য অনুশোচনা করা

ভবিষ্যতে আল্লাহর পথে চলার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা

দোয়া, ইবাদত ও সমাজসেবার মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা

আসুন, আমরা এই মহিমান্বিত রজনীতে আল্লাহর দরবারে মাথা নত করি এবং তাঁর ক্ষমা ও রহমত প্রার্থনা করি।

লাইলাতুল কদর আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিক— এই প্রার্থনায়।


রেজুয়ান আহম্মেদ: কলামিস্ট, বিশ্লেষক; সম্পাদক অর্থনীতি ডটকম
img

বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা

প্রকাশিত :  ১৮:৫৫, ১১ জুন ২০২৫

গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা অন্যান্য ধর্মের তুলনায় সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি অন্যান্য সব প্রধান ধর্মের সম্মিলিত প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে ইসলামের সম্প্রসারণ। ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, ইসলাম এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম।
গবেষণাটি ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কাল ঘিরে পরিচালিত হয়েছে এবং এটি ‘গ্লোবাল রিলিজিয়াস ল্যান্ডস্কেপ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

পিউ রিসার্চ জানিয়েছে, ইসলাম ধর্মে এই বৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি হলো প্রাকৃতিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ধর্মান্তরণের ভূমিকা এখানে খুবই সীমিত। মুসলিম পরিবারে গড় সন্তানসংখ্যা অন্য ধর্মের তুলনায় বেশি। বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ এই ধর্মের অনুসারী।
২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি মুসলিম নারী গড়ে ২.৯ সন্তান জন্ম দিয়েছেন, যেখানে অমুসলিম নারীর ক্ষেত্রে এই হার ২.২। তাছাড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর গড় বয়স তুলনামূলকভাবে কম, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
গবেষণা অনুযায়ী, খ্রিষ্টধর্ম এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্ম, যার অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি। তবে ইসলাম দ্রুত বাড়তে থাকায় দুই ধর্মের মধ্যকার সংখ্যাগত ব্যবধান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
২০১০ সাল থেকে খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীর সংখ্যা বিশ্বে গড়ে ১.৮ শতাংশ হারে কমেছে। এ সময়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারী বেড়েছে প্রায় ৩৫ কোটি, যা খ্রিষ্টধর্মের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
অঞ্চলভিত্তিক পরিবর্তন
বিশ্বজুড়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেই ইসলাম ধর্মের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। কাজাখস্তান, বেনিন ও লেবাননে ইসলাম ধর্মে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। তবে ওমান ও তানজানিয়ায় মুসলমানদের অনুপাত কিছুটা কমেছে।
ধর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। চীনে সবচেয়ে বেশি ধর্মহীন মানুষ বাস করেন, যাদের সংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা ২০১০ সালের তুলনায় বেড়েছে ৯৭ শতাংশ।
ধর্মত্যাগ ও ধর্মান্তর প্রবণতা
গবেষণায় দেখা গেছে, খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মে ধর্মত্যাগের হার ধর্মান্তরের চেয়ে বেশি।
বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্মে, প্রতি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নতুন অনুসারীর বিপরীতে তিনজন ধর্ম ত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে, ধর্মহীনতায় প্রবেশের হারও বেশি—প্রতি একজন ধর্মহীনতা ছেড়েছেন, আর তিনজন নতুন করে ধর্মহীন হয়েছেন।

তবে ইসলাম একমাত্র প্রধান ধর্ম, যেখানে ধর্মান্তরিত হয়ে আসা মানুষের সংখ্যা ধর্মত্যাগীদের চেয়ে বেশি।

বিশ্ব ধর্মের বর্তমান চিত্র
ইসলাম : এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। প্রায় ২০০ কোটি মানুষ এই ধর্মের অনুসারী, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
খ্রিষ্টধর্ম : বৃহত্তম ধর্ম, যার অনুসারী সংখ্যা ২৩০ কোটি।
ধর্মহীন : সংখ্যা বেড়ে ২০০ কোটিতে, ২০১০ সালের তুলনায় বেড়েছে ২৭ কোটি।
হিন্দুধর্ম : তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম, এর ১২০ কোটি অনুসারী রয়েছে; গত এক দশকে বেড়েছে ১২.৬ কোটি, তবে বৈশ্বিক হারে অপরিবর্তিত।

বৌদ্ধধর্ম : একমাত্র ধর্ম যার অনুসারীর সংখ্যা কমেছে — ১.৮৬ কোটি হ্রাস পেয়ে হার ৫% থেকে ৪%-এ নেমেছে।
ইহুদি ধর্ম : গত এক দশকে এর মাত্র ১০ লাখ জনসংখ্যা বেড়েছে। অন্যান্য ধর্ম (শিখ, বাহাই ইত্যাদি) সম্মিলিতভাবে প্রায় ২০ কোটি অনুসারী, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২.২ শতাংশ।
এই গবেষণাটি পরিষ্কারভাবে দেখায় যে, ইসলাম শুধু প্রাকৃতিকভাবে নয়, বৈশ্বিক ধর্মীয় পরিবর্তনের ধারাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি, ধর্মহীনতা ও ধর্মত্যাগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আগামী দশকে বিশ্ব ধর্মীয় মানচিত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।