
ড. ইউনূসের চীন সফর: ভারত কি উদ্বিগ্ন, নাকি নির্লিপ্ত?

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন সফরে গিয়েছেন। এই সফরকে ঘিরে যেমন বাংলাদেশে নানা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তেমনি আঞ্চলিক কূটনীতিতেও নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে ভারত এই সফরকে কীভাবে দেখছে, তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে। কেউ বলছেন, ভারত উদ্বিগ্ন; আবার কেউ মনে করছেন, দিল্লি এখনো অপেক্ষার নীতিতে রয়েছে।
ড. ইউনূসের এই সফরের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা, বিশেষ করে তিস্তা নদী প্রকল্পে চীনা অর্থায়ন নিশ্চিত করা, দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বাড়ানো এবং রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করা। তবে সফরের শুরুতেই জানা গেছে, চীন এখনো কোনো বড় প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
এদিকে, ভারতের কূটনৈতিক মহলও এই সফর নিয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও চীনের ঘনিষ্ঠতা বাড়লে ভারত তার দীর্ঘদিনের প্রভাব হারাতে পারে। যদিও দিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সংক্ষেপে বলেছেন, \"বাংলাদেশ তার সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিতে স্বাধীন। তবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতার জন্য ভারত বরাবরই বাংলাদেশের পাশে থাকবে।\"
বিশ্লেষকদের মতে, ভারত সরকারের এই সংযত প্রতিক্রিয়া আসলে ভেতরের গভীর উদ্বেগ আড়াল করার প্রচেষ্টা। চীনের দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে ভারত বরাবরই সতর্ক। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান এবং মালদ্বীপের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠায় দিল্লি কৌশলগত চাপে রয়েছে। বাংলাদেশে চীনের প্রভাব বাড়লে ভারত এই অঞ্চলে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য হারানোর আশঙ্কা করছে।
একজন ভারতীয় কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, \"আমরা বাংলাদেশকে আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে দেখি। তবে চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কতটা গভীর হবে, তা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।\"
তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে চীনের কাছ থেকে অর্থায়ন চাইছে। শেখ হাসিনা সরকারের সময় ভারত এই প্রকল্পে চীনের সম্পৃক্ততার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। কারণ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যুতে বরাবরই সংবেদনশীল। ভারত চায় না যে বাংলাদেশ এই প্রকল্পে চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়ুক।
বর্তমান সরকার আবারও তিস্তা প্রকল্পে চীনের সহায়তা চাইলে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস ও টাইমস অব ইন্ডিয়া-তে প্রকাশিত বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ যদি চীনের কাছ থেকে এই প্রকল্পের জন্য বড় অঙ্কের ঋণ নেয়, তবে ভারত তা ভালোভাবে নেবে না। কারণ, এটি শুধু একটি অবকাঠামোগত প্রকল্প নয়; এটি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিরও অংশ।
বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সংকট একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চীন কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করছে, কিন্তু এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার আশা করছে, চীন এ বিষয়ে আরও কার্যকর ভূমিকা নেবে।
একজন ভারতীয় পররাষ্ট্র বিশ্লেষক বলেন, \"বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সমর্থন আশা করছে, কিন্তু চীন কখনোই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে না। ভারতও এই বিষয়ে খুব একটা সক্রিয় নয়। ফলে বাংলাদেশকে নিজস্ব কৌশলেই সমাধান খুঁজতে হবে।\"
বাংলাদেশের নতুন সরকার গঠনের পর ভারত কিছুটা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। ড. ইউনূসের সরকার এখনো ভারতের সঙ্গে বড় কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসেনি, যা দিল্লির জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ও নীতি বিশ্লেষক ব্রহ্ম চেলানি বলেন, \"ভারত এখনো দেখছে, বাংলাদেশের নতুন সরকার কীভাবে কাজ করে। তারা এখনো সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানাতে চায় না। তবে একবার যদি বাংলাদেশ চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে, তাহলে ভারত নিশ্চিতভাবেই পদক্ষেপ নেবে।\"
ড. ইউনূসের সফরের পর অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে চীনের দিকে ঝুঁকছে। যদিও বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির পক্ষে, তবে এই সফর নতুন প্রশ্ন তুলেছে।
একজন বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ বলেন, \"বাংলাদেশের জন্য চীন ও ভারতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ভারত আমাদের ঐতিহ্যগত মিত্র, অন্যদিকে চীন আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে।\"
ড. ইউনূসের চীন সফর শুধু অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক সফর নয়; এটি বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানেরও একটি পরীক্ষা। ভারত যদি মনে করে বাংলাদেশ চীনের দিকে বেশি ঝুঁকছে, তাহলে ভবিষ্যতে তারা নতুন কৌশল গ্রহণ করতে পারে।
তবে বাংলাদেশ সরকার এখনো ভারসাম্য বজায় রাখার নীতিতেই রয়েছে। ড. ইউনূস চীন সফর শেষে ভারত সফর করতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। যদি এটি সত্য হয়, তবে বোঝা যাবে যে বাংলাদেশ উভয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।
আসন্ন দিনগুলোতে বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের সম্পর্ক কোন পথে গড়াবে, তা নির্ভর করবে কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোর ওপর। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই সফরের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে গভীর ছাপ ফেলবে।