img

১৯৭০ সালে পাকিস্তান ভাঙ্গার অভিযোগে ৬ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলে গ্রেফতার হয়েছিলেন ৪ জাদরেল নেতা

প্রকাশিত :  ১৭:৪৭, ১০ এপ্রিল ২০২৫

১৯৭০ সালে পাকিস্তান ভাঙ্গার অভিযোগে ৬ এপ্রিল শ্রীমঙ্গলে গ্রেফতার হয়েছিলেন ৪ জাদরেল নেতা

সংগ্রাম দত্ত: রোববার ৬ এপ্রিল। পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ সালের এই দিনে পাক সরকার তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার শ্রীমঙ্গল থানার চার জাঁদরেল নেতাকে  পাকিস্তান ভাঙ্গার অভিযোগে তথা জয় বাংলা মামলায় গ্রেফতার করে মৌলভীবাজার জেল হাজতে প্রেরণ করে। শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ন্যাপ ও আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের জনসাধারণ গ্রেফতারের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমে পড়ে। 

\'৬০ এর দশকের শেষ দিকে পাক আমলে শ্রীমঙ্গলের এই দুঃসাহসী চার নেতা আন্দোলন সংগ্রাম সৃষ্টি করে পাক সরকারকে এলাকায় ভীত নাড়িয়ে দিতেন। স্থানীয় কৃষক শ্রমিক ও ছাত্রসহ জনসাধারণকে উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে আন্দোলনে জড়িত করতেন। পাক সরকার থাকতো তটস্থ।

পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালের ৬ এপ্রিল  জয় বাংলা মামলা তথা পাকিস্তান ভাঙ্গার অভিযোগে সামরিক আইনের স্কিষ্টটি এমন এল আর ক্লোজ এইট এর অধীনে ন্যাপ নেতা রাসেন্দ্র দত্ত, মোহাম্মদ শাহজাহান মিয়া, ছাত্রলীগ নেতা এম এ রহিম ও এস এ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে মৌলভীবাজার জেলহাজতে প্রেরণ করে। পরদিন শ্রীমঙ্গল পৌরসভা মাঠে ন্যাপের পূর্বনির্ধারিত জনসভা থাকায় এতে যুগের অগ্নিকন্যা বলে খ্যাত তৎকালীন ন্যাপনেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও সাবেক ডাকসুর ভিপি ও ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আহমেদুল কবির ওই জনসভায় তাদের মুক্তির দাবিতে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের হাজারো নেতাকর্মী অসাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার তাদেরে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। উল্লেখিত এই চার নেতা সহ ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ সহ স্বাধীনতাকামী লোকজন ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

রাসেন্দ্র দত্ত চৌধুরী  ১৯৪০ সালের ১২ এপ্রিল  তৎকালীন মৌলভীবাজার মহকুমার শ্রীমঙ্গল থানার নোয়াগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে \'৬২ শিক্ষা আন্দোলন, \'৬৫ সালের কফের নির্বাচন, ৬৬ সালের ৬ দফা, \'৬৯এর গণঅভ্যুত্থান, ও সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৩ সালে শ্রীমঙ্গল সদর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিপুল ভোটার দিকে জয়লাভ করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সাল থেকে একটানা ৪ দশকের উপর দৈনিক সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকতার জগতে জড়িত ছিলেন। শ্রীমঙ্গলে 

ভাষা আন্দোলন, বালিশিরা পাহাড় আন্দোলন ও  পাকিস্তান ভাঙ্গা তথা জয় বাংলা মামলার  আসামিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র  জীবিত ব্যক্তি। 

ন্যাপ নেতা মোঃ শাহজাহান মিয়া ১৯৩৮ সালে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার কালাপুর ইউনিয়ন এর লামুয়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে এদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর সংকল্প নিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তিনি \'৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, \'৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, \'৬৬ সালের ৬ দফা, \'৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। দেশ স্বাধীন হলে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে ভূমিকা পালন করেন।

আজীবন সংগ্রামী ত্যাগী এই জননেতা ৮ ফেব্রুয়ারী ’৯২ গ্যষ্টিক আলসার রোগে ভোগে ৫৫ বছর বয়সে মারা যান।

১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ রহিম জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮  সালে তাঁর নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম ছাত্রলীগের থানা কমিটি গঠিত হয়। ছাত্রলীগ গঠন করার পর বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি লাভ গড়ায় বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা সারাদেশে বৃদ্ধি পেলে ডাক্তার মোঃ আব্দুল আলী, ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াস, মোহাম্মদ আলতাফুর রহমান চৌধুরী শ্রীমঙ্গল থানায় আওয়ামী লীগ গঠন করলে তিনি তাতে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন। ১৯৭০ সালের জয় বাংলা মামলায় তিনিও তিন নম্বর আসামি হিসেবে গ্রেফতার হন। মুক্তি লাভ করে পড়ে ভারতে মুজিব বাহিনীতে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেন। মূলত তার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ শ্রীমঙ্গল থানায় শক্তিশালী ও সুসংগঠিত দল হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯৮৩ ও ১৯৮৮ সালে পর পর দুবার তিনি পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালের ১৯ এপ্রিল রাত ১১:৪০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আওয়ামী লীগের অপর নেতা এস এ মুজিব  ১৯৬৮ সালে শ্রীমঙ্গলে তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। তিনি খুবই বাগ্মী ছিলেন। ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।

উপরোক্ত ৪  জাঁদরেল নেতার মধ্যে তিনজন ২০১৪ সালের সরকারের আহবানে মুক্তিযুদ্ধের তালিকা নাম অন্তর্ভুক্তি করার লক্ষ্যে অনলাইনে আবেদন করা হয়। এস এ মুজিব সাহেবের পরিবারের লোকজন সরকারের ঘোষণা সম্পর্কে অবহিত না থাকার কারণে তার পক্ষে মুক্তিযোদ্ধার হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তির লক্ষ্যে কোন আবেদন করা হয়নি বলে জানা গেছে । কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে স্বাধীনতার দাবিদার বলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটির সভাপতি উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদ ( যিনি পরে আওয়ামী লীগের কৃষি মন্ত্রী পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন) ও কিছু সদস্যের সংকীর্ণ রাজনীতির কারণে উপরোক্ত তিনজনের আবেদনের মন্তব্যের ঘরে মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে মন্তব্য দিয়ে তাদের আবেদনগুলো জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এ প্রেরণ করা হয়। তাদের মধ্যে একমাত্র রাসেন্দ্র দত্তের আবেদনের শুনানি না হওয়ার কারণে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়। মোহাম্মদ শাজাহান ও এম এ রহিম জীবিত না থাকার কারণে ও তাদের পক্ষে কোন পরিবারের লোকজন আপিল করার নিয়ম কানুন সম্পর্কে অবগত না থাকার কারণে ও যা ঝামেলা পোড়াতে হবে এসব বিবেচনায় আপিল পর্যন্ত যাননি।

সিলেটের খবর এর আরও খবর

img

আজ ঐতিহাসিক চা শ্রমিক দিবস বা মুল্লুকে চলো দিবস

প্রকাশিত :  ১০:৩৩, ২০ মে ২০২৫

সংগ্রাম দত্ত: আজ ২০ মে ঐতিহাসিক চা শ্রমিক দিবস বা মুল্লুকে চলো দিবস । তৎকালীন ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের প্রভাব চা-শ্রমিকদেরও স্পর্শ করেছিল। চা শ্রমিকদের মাঝে আওয়াজ উঠে ‘মুল্লুকে ফিরে চল’  মানে তারা যেসব স্থান থেকে এসেছিলেন সে জায়গায় ফিরে যাওয়া।

১৯২১ সালের ২০ মে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা শ্রমিক সিলেট থেকে পায়ে হেটে চাঁদপুরে মেঘনা স্টিমার ঘাটে পৌঁছান। তারা জাহাজে চড়ে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইলে ব্রিটিশ গোর্খা বাহিনীর সৈনিকরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে চা শ্রমিককে হত্যা করে মেঘনা নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে এসেছিলেন তাদেরকেও আন্দোলন করার অপরাধে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পায়নি তারা ভূমির অধিকার। এরপর থেকেই প্রতি বছর ২০ মে চা শ্রমিক দিবস হিসেবে দিনটি পালন করে আসছেন নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত শোষণ বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার চা শ্রমিকরা।

পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না।

১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতবর্ষের আসাম প্রদেশের সিলেটের মালিনীছড়া বাগানে চা চাষ শুরু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেই সময় বৃহত্তর  সিলেট জেলায় চা বাগান তৈরির জন্য ভারতবর্ষের উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকদের আনা হয়। 

‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগা’ এমন প্রলোভনে শ্রমিকরা বৃহত্তর সিলেট জেলায় আগমন ঘটলেও তাদের ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি। বিশাল পাহাড় পরিষ্কার করতে গিয়ে এবং চা বাগান করতে গিয়ে কত শ্রমিকের জীবন গেছে তার কোনো হিসেব নেই। তাছাড়াও বৃটিশদের অসহনীয় অত্যাচার ছিল চা শ্রমিকদের উপর।

শ্রমিকদের অব্যাহত নির্যাতনের প্রতিবাদে তৎকালীন চা শ্রমিক নেতা পন্ডিত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত ও পন্ডিত দেওসরন \'মুল্লুক চল অর্থাৎ নিজ দেশে চল\' আন্দোলনের ডাক দেন। 

১৯২১ সালের ১ মে ধলাই ভ্যালির বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার  আদমপুরে এক সভা অনুষ্টিত হয়। গোপনে কয়েকজন শ্রমিক যোগদান করে। মে দিবসের এই সভায় পুরুষ শ্রমিকদের মজুরি দৈনিক আট আনা ও মহিলা শ্রমিকের মজুরি ছয় আনার করার দাবী ওঠে। অর্থাৎ ভেতরে ভেতরে বাগানগুলো অগ্নিগর্ভ হয়ে যায়।

১৯২১ সালের ৩ মার্চ আনিপুর চা-বাগান থেকে ৭৫০ জন শ্রমিক স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ‘গান্ধী কা জয়’ বলে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। তাদের সাথে যোগ দেয় আশপাশের চাবাগানের শ্রমিকরা। ‘মুল্লুকে চল\' খবরটি ঘন বন-পাহাড় ভেদ করে আশপাশের বাগানে ছড়িয়ে পড়ে। শ্রমিকরা বাঁধা উপেক্ষা করে বাগান ছাড়তে শুরু করে। বাগান কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের সহায়তায় পথে পথে সর্দার ও পুলিশ বসায়। চা বাগানের অনেক জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বাগানের রাস্তায় শ্রমিক চলাচল বন্ধ করা হয়। পুলিশ শ্রমিকদেরকে  ধরতে শুরু করে। চা-বাগানের বাইরে থেকে অসহযোগ কর্মীরা শ্রমিকদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। শ্রমিকরা চা বাগানের আইন অমান্য করে নিজ জন্মভূমির দিকে রওয়ানা দেওয়াকে বলা হয় \"মুল্লুকে চল\"।

চা বাগানগুলোর  প্রায় ত্রিশ হাজার শ্রমিক মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রওয়ানা দেয়। এই প্রথম চা-বাগান একসাথে আগুন জ্বলে ওঠে। তবে সকল চা বাগানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লেগে যায়। চা-বাগান ছেড়ে শ্রমিকরা অনিশ্চিত ও অচিনপথে প্রথমে তৎকালীন আসামের করিমগঞ্জ  রেল স্টেশনে জড়ো হয়।  আসাম-বেঙ্গল রেল পথে চাঁদপুর-গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটে যাওয়ার চেষ্টা চালায়।

আসাম-বেঙ্গল \"উপরওয়ালার\" নির্দেশে রেল শ্রমিকদের পরিবহন করতে অপারগতা প্রকাশ করে। ভারতবর্ষের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা এডভোকেট কামিনী কুমার চন্দ ও  রাজনীতিবিদ শ্রীশ চন্দ্র দত্তের প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

চা শ্রমিকদের হাতে কোন টাকা ছিল না। এই বিপর্যয়ে অভুক্ত চা-শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ায় কংগ্রেস নেতা  রাজনীতিবিদ শ্রীশ চন্দ্র দত্ত।  মানুষের কাছ থেকে চাউল-টাকা সংগ্রহ করে শ্রমিকদের খিচুড়ি খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। নিরুপায় শ্রমিকরা করিমগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে সিলেট রেল স্টেশনে চলে আসে।  রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয় নব গঠিত জাতীয় বিদ্যালয়ে।

শ্রীশ চন্দ্র দত্তসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পুনরায় সিলেট রেলস্টেশন থেকে চা শ্রমিকদের রেলপথে হেঁটে চাঁদপুর যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। 

চা শ্রমিকদের উস্কানীর অভিযোগে আসাম প্রাদেশিক সরকার কয়েকজন শ্রমিক ও কংগ্রেস কর্মীকে গ্রেফতার করে।চা বাগানের শ্রমিকরা মরিয়া হয়ে ওঠে স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রায় অনড় থাকে।

শ্রমিকদের পদযাত্রা সহায়তার জন্য দ্রুত রেল-লাইন ভিত্তিক থানা ও মহকুমা কংগ্রেস সাহায্য কমিটি গঠিত হয়। রেল লাইন যে সমস্ত থানার উপর দিয়ে গেছে সেই থানা,মহকুমা,জেলা চা-শ্রমিকদের সাথে জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিবিদ এডভোকেট কামিনী কুমার চন্দ, শ্রীশচন্দ্র দত্ত, পূর্ণেন্দু কিশোর সেন, যতীন্দ্র চন্দ্র দত্ত, যতীন্দ্রনাথ দে, নীরোদকুমার গুপ্ত, অবলাকান্ত গুপ্ত, সতীন্দ্রনাথ দেব, কুলাউড়ার শিরিশ চন্দ্র দেব, শ্যামাচরণ দেব, মৌলভীবাজারের রমণীমোহন রায়, বানিয়াচঙ্গের শিবেন্দ্রচন্দ্র বিশ্বাস।  চা-শ্রমিকদের রাত্রী যাপন, ঔষধ ও খাবারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।

কুমিল্লার ব্যারিষ্টার অখিল চন্দ্র দত্ত, চাঁদপুরের হরদয়াল নাগ, চট্টগ্রামের যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত চা শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেন। 

১৯২১ সালের ২০ মে চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য চাঁদপুর ছিল ভয়ঙ্কর মৃত্যুর দিন। 

সবচেয়ে পাশবিক ঘটনাটি ঘটে চাঁদপুর রেলস্টেশনে। রেলইয়ার্ডে তিন থেকে চার হাজার শ্রমিক জড়ো হয়েছিল। জাহাজ ঘাটে পৌঁছনোর কথা। রাতের অন্ধকারে গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা রেলওয়ে ইয়ার্ড ঘিরে ফেলে। সরকার পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ এলাকায় কোন লোকজনকে যেতে নিষেধ করা হয়। সরলপ্রাণ ক্লান্ত চা বাগানের শ্রমিকরা রহস্যটা বুঝতে পারেনি। গভীর রাতে সবাই  ঘুমে অচেতন ।কমিশনার কেসি দে এর নির্দেশে গুর্খা সৈন্যরা ঘুমন্ত শ্রমিকদের উপর গুলি করতে থাকে। চা শ্রমিকদের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। রাতের অন্ধকারে অনেক লাশ গুম করে ফেলে গুর্খা বাহিনী।

চাঁদপুরে শতশত চা বাগানের শ্রমিকদেরকে বৃটিশ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। লাশ  মেঘনা নদীর পানিতে ফেলে দেয়।  শ্রীশ চন্দ্র দত্ত চাঁদপুরে চা শ্রমিকদের হত্যার প্রতিবাদ ও শোক সভা  করেন। চা শ্রমিকেরা যারা বেঁচে ছিলেন তারা নিরুপায় হয়ে পুনরায় আসামের করিমগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ চা বাগানে চলে আসেন। চা শ্রমিকরা যাতে ট্রেনে না চলতে পারেন তার জন্য সহজ-সরল শ্রমিকদের বাগানের নামাঙ্কিত একটি করে ট্যাগ দেওয়া হয়। সেই ট্যাগ দেখলেই শ্রমিকদেরকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়া হতো।

বৃটিশ গেল,পাকিস্তান গেল,বাংলাদেশ আসলো।বাংলাদেশে এখনো চা শ্রমিকরা ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত। চা শ্রমিকদের জীবনমানের তেমন কোন উন্নয়ন ঘটেনি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার কোন উন্নতি হয়নি।

২০ মে শতশত চা শ্রমিক হত্যা  দিবসটি এখনো অবহেলিত হয়ে আছে। এই দিবসটি পালন করা রাষ্টের একান্ত দায়িত্ব।