img

খাগড়াছড়িতে নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে চাকমাদের বিজু উৎসব শুরু

প্রকাশিত :  ১২:২৬, ১৩ এপ্রিল ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ১২:২৮, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

খাগড়াছড়িতে নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে চাকমাদের বিজু উৎসব শুরু
সংগ্রাম দত্ত:পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী চাকমা সম্প্রদায়ের বৃহত্তম সামাজিক অনুষ্ঠান বিজু উৎসব আজ থেকে শুরু হয়েছে। গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল অর্চনার মাধ্যমে উৎসব শুরু করেছেন খাগড়াছড়ির চাকমা জনগোষ্ঠীরা। 

ফুল বিঝু উপলক্ষ্যে শনিবার (১২ এপ্রিল) ভোর থেকে জেলা সদরের খবংপুড়িয়া এলাকায় চেঙ্গি নদীর দুই পাশে হাজারও নারী-পুরুষ ফুল নিয়ে সমবেত হন। গঙ্গা দেবির উদ্দেশ্যে ফুল দিয়ে পূজা অর্চনা করেন। বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের মিলনমেলায় বর্ণিল উৎসবে রূপ নিয়েছে চেঙ্গি নদীর পার। 

এছাড়া মাঈনি, ফেনী নদীসহ বিভিন্ন জলাধারে ফুল দিয়ে গঙ্গা দেবির অর্চনা করেছেন জেলার অন্যান্য উপজেলায় বসবাসরত চাকমা জনগোষ্ঠীরা। ফুল দিয়ে উৎসব শুরু, আগামীকাল মূল বিজু এবং শেষ দিন নতুন বছর বা গজ্জ্যাপজ্জ্যা পালন করা হবে। 

চাকমা সম্প্রদায়ের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সীরা ফুল সংগ্রহ করে নদী, ছড়া খালে ফুল দিয়ে গঙ্গা দেবির উদ্দেশ্যে পূজা করেন। কেউ একা, আবার অনেকে দলবদ্ধ হয়ে নানা রঙের ফুল গঙ্গা দেবির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে ওঠে জলাধার। পুরোনো বছরের সব দুঃখ, গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে বরণ করতেই এই ফুল পূজার আয়োজন করেন চাকমারা।

খাগড়াছড়ি সদরের চেঙ্গি নদীতে পূজা অর্চনা করতে আসা কৃষ্ণা চাকমা বলেন, ফুল বিঝুর দিন এখানে এসে অনেক আনন্দিত আমি। আগামীকাল হবে মূল বিজু। বাড়িতে পাজনসহ নানা পদের আয়োজন হবে। অতিথিদের আপ্যায়ন করব। পরদিন নতুন বছর উপলক্ষ্যে উৎসব করব, কেয়াং ঘরে যাব, বাতি জ্বালাব, প্রার্থনা করব।

নিতা চাকমা বলেন, এ অনুষ্ঠান আমাদের সংস্কৃতি ঐতিহ্য। আমরা ঐতিহ্য ধারণ করি। আমাদের চাকমাদের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সবাইকে নিয়ে আমরা উৎসব পালন করি।

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ সদস্য বঙ্গ মিত্র চাকমা বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর উৎসবমুখর পরিবেশে বিজু উৎসব পালন করছি। আসা করছি অনাগত দিনগুলো ভালো কাটবে। এ সম্মিলিত সংস্কৃতির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভ্রাতৃত্ব বোধ গড়ে উঠবে।

আগামীকাল ১৩ এপ্রিল চৈত্র সংক্রান্তির দেনে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ‘বৈসু’ এবং বাংলা নববর্ষের দিন থেকে মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব শুরু হবে। উৎসব চলবে টানা ৩ দিন।


img

আলোর খোঁজে সালমান —একটি হেরে গিয়েও উঠে দাঁড়ানোর গল্প

প্রকাশিত :  ০৫:৩২, ২০ মে ২০২৫

রেজুয়ান আহম্মেদ

ঢাকার মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডের ১৫৬ নম্বর বাড়িটি বাইরে থেকে দেখতে খুবই সাধারণ। পুরোনো ধাঁচের, দেয়ালে সাদা রঙের ছোপ ছোপ মলিনতা। কেউ পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে হয়তো একবার তাকিয়েও দেখবে না। অথচ এই শান্ত, চুপচাপ দেয়ালের আড়ালেই প্রতিদিন এক যুদ্ধ চলে—এক তরুণের নিজের সঙ্গে লড়াই, নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা।

তরুণটির নাম সালমান। বয়স তিরিশের কাছাকাছি। মুখে সাদামাটা চেহারা, চোখে চশমা, আর কপালে এমন এক চিন্তার ভাঁজ—যা দেখে বোঝা যায়, জীবনের হিসাব যেন কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না।

তার শুরুটা হয়েছিল স্বপ্ন দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন অর্থনীতির ক্লাসে একদিন এক শিক্ষক বলেছিলেন, “তুমি একদিন নিজের কোম্পানি খুলবে, তোমার নামেই কেস স্টাডি পড়ানো হবে।” কথাটি তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। ভাবত, একদিন ‘সালমান ইনোভেশনস লিমিটেড’ হবে দেশের সেরা কোম্পানিগুলোর একটি।

কিন্তু স্বপ্নের পথ যে এত কণ্টকময়, তা কে জানত?

বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বাবার অবসরভাতা আর নিজের সামান্য সঞ্চয় নিয়ে সালমান ঝাঁপিয়ে পড়ে শেয়ারবাজারে। শুরুতে সব ঠিকঠাক চলছিল—লাভ হচ্ছিল, আত্মবিশ্বাস বাড়ছিল। মনে হচ্ছিল, “আমি তো বুঝি বাংলাদেশের ওয়ারেন বাফেট!”

এরপর এল করোনা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন, আর নিজের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত। একের পর এক শেয়ারের দাম পড়ে যেতে লাগল। লাভের জায়গায় দাঁড়াল লোকসান। ধীরে ধীরে বাবার শেষ সঞ্চয়টুকুও হারিয়ে গেল।

চারপাশের মানুষ ফিসফিস করে বলত, “বড় ভাব দেখাতো, এখন দেখো কী হাল!” কিছু বন্ধু তো সরাসরি মুখের ওপর বলেই ফেলল, “ভাই, এসব বড়লোকদের খেলা। তুমি না এলেই ভালো করতে।”

একসময় কাজ খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সালমান। কোনো অফিসই নিতে চায় না। অনেকেই ভাবে, “একে নিলে অফিসটাই বুঝি বিপদে পড়বে।” ঘরের মানুষরাও মুখে কিছু না বললেও চোখে চোখে বলে দেয়, “তুমি ব্যর্থ।”

রাতগুলো তখন বিষাদের নামতা পড়ে। শোবার ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, “এই আমি, যার স্বপ্ন ছিল দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার, আজ আমি এক নিঃসঙ্গ ফ্যান গুণছি?”

তবুও, হেরে যাওয়ার মানুষ ছিল না সালমান। তার ভেতরে একটা ছোট্ট আগুন ছিল—যা একেবারে নিভে যায়নি।

এক রাতে, সব ঘুমিয়ে গেলে সে ছাদে উঠে যায়। হালকা শীতের হাওয়া, আকাশে ঝলমলে তারা। এমন মুহূর্তে মনে পড়ে এক সেমিনারের বক্তার কথা, “পতন মানেই শেষ নয়। সাহসী মানুষ আবার উঠে দাঁড়ায়।” সেই মুহূর্তে যেন আকাশের তারা চোখ টিপে তাকে বলে যায়, “তুই পারবি!”

সকালে উঠে সালমান শুরু করে নতুন করে। চায়ের কাপ হাতে পুরোনো নোটবুক খুলে বসে। ইউটিউব থেকে সব ‘লোভনীয়’ ভিডিও আনসাবস্ক্রাইব করে দেয়। শুরু করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের রিপোর্ট, কোম্পানির আয়-ব্যয়ের হিসাব আর বিএসইসির গাইডলাইন পড়া। বলে, “এবার শিখে করব। আর কোনো বোকামো নয়।”

আস্তে আস্তে সে ঘুরে দাঁড়ায়। এখন আর ঝুঁকির পেছনে ছোটে না, বিনিয়োগ করে স্থির কোম্পানিতে। লাভ কম, কিন্তু নিরাপদ। আর সবচেয়ে বড় কথা—আবার নিজের ওপর বিশ্বাস ফিরে পায়।

একদিন বন্ধুদের ডেকে বলে, “চলো, একটা ইনভেস্টমেন্ট ক্লাব খুলি। মানুষকে শেখাই—শেয়ারবাজার মানেই জুয়া নয়, এটা জ্ঞান আর ধৈর্যের জায়গা।”

বন্ধুরা প্রথমে হেসে খুন! “তুই নিজেই তো ডুবলি, এখন শেখাবি?”

সালমান শান্ত গলায় বলে, “আমি ডুবেছিলাম কারণ জানতাম না। এখন শিখেছি। এবার অন্যদের শেখাব, যাতে তারা না ডোবে।”

এইভাবেই গড়ে উঠল ‘উৎসাহ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাব’। ছোট ছোট কর্মশালা, কলেজে ক্লাস, ফেসবুক লাইভে আলোচনা—একটার পর একটা আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে শুরু করল সালমান আর তার দল।

একদিন এক সেমিনারে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ড. হাফিজুর রহমান। সালমান তাঁকে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আমাদের শেয়ারবাজার কি কখনো ঘুরে দাঁড়াবে?”

ড. হাফিজুর হেসে বললেন, “তুমি যা করছো, এটাই শুরু। বিনিয়োগকারীদের সঠিক জ্ঞান দিতে পারলে বাজার শুধু ঘুরে দাঁড়াবে না—নতুন অর্থনীতির ভিত গড়ে উঠবে।”

সালমানের মনে বজ্রপাতের মতো বাজল কথাটা। বুঝল, এটা শুধু তার একার জার্নি নয়, এটা পুরো প্রজন্মের পরিবর্তনের ডাক।

এক বছর না যেতেই ‘উৎসাহ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাব’ হয়ে উঠল দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফিন্যান্স প্ল্যাটফর্ম। পত্রিকায় ছাপা হলো সালমানের গল্প—“হার না মানা সৈনিক”, “ফাইন্যান্স নিনজা”! হাজারো তরুণ তার কর্মশালায় আসতে লাগল, যারা একসময় শেয়ারবাজার মানেই ভয় পেত, এখন সেখানে দেখে সম্ভাবনা।

আর সালমান?

সে এখনো রাত হলে ছাদে যায়। আকাশ দেখে। কিন্তু চোখে আর হতাশার ছায়া নেই। এবার তার চোখে আলো। হৃদয়ে শান্তি। কারণ সে জানে—আলো খোঁজে যারা, তারা হার মানে না।

আজকের সালমান কেবল একজন ব্যক্তি নয়—সে এক অনুপ্রেরণা।

তার গল্প যেন হাজারো তরুণকে বলে যায়, “তুমি হেরে যেতে পারো, কিন্তু উঠেও দাঁড়াতে পারো। সাহস আর জ্ঞান থাকলে অন্ধকার কেটে যায়।”

হ্যাঁ, এটা শুধু সালমানের গল্প নয়—এটা আমাদের সবার গল্প। কখনো না কখনো আমরা সবাই সালমান হই—ভাঙি, হারাই, আবার গড়ে উঠি।

ভোর আসেই