
মনের মহাযাত্রা

রেজুয়ান আহম্মেদ
\"মানুষের সবচেয়ে বড় বিস্ময় হলো—আমরা একদিকে নক্ষত্রের ধুলিকণা, অন্যদিকে নক্ষত্রের স্বপ্ন দেখা প্রাণী।\"
—কার্ল সাগান
মন থেমে থাকে না কখনো। ঢেউয়ের মতো ছুটে চলে, কখনো অতীতের কোনো বালুকাবেলায় থামে, আবার কখনো কল্পনার অজানা দ্বীপে ভেসে যায়।
এই লেখাটা সেই অনন্ত সফরের এক খণ্ডচিত্র—যেখানে যুক্তি আর আবেগের দ্বন্দ্ব, স্মৃতি আর কল্পনার মায়াবী জাল, আর \'আমি\' নামক শব্দটার রহস্য আবিষ্কারের একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা।
চেতনার গোলকধাঁধা: আলো-আঁধারের খেলা
\"আমি ভাবি, তাই আমি আছি\"—ডেকার্ট বলেছিলেন। শুনতে সুন্দর লাগলেও, বাস্তবতা যেন একটু ভিন্ন:
\"আমি অনুভব করি, তাই আমি হাঁপিয়ে উঠি।\"
চেতনা, এই অদ্ভুত জিনিসটা, মস্তিষ্কের ৮৬ বিলিয়ন নিউরনের মধ্যে বিদ্যুতের ঝিলিক থেকে জন্ম নেয়। আমরা তাকে বলি \'চিন্তা\'। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই \'আমি\' কে, যে চিন্তাকে দূর থেকে দেখছে?
বিজ্ঞান বলে, \'আমি\' হলো নিউরনের তৈরি এক কল্পিত ছায়াপ্রতিচ্ছবি। বৌদ্ধরা মৃদু হেসে বলেন, আত্মা বলে কিছু নেই; জীবন আসলে এক প্রবাহমান নদী।
তবুও, নির্জন রাতের জানালায় তারা ঝিকিমিকি করলে কেন যেন মনে হয়, এই \'আমি\' যেন কোনো এক নক্ষত্রের নীরব সঙ্গী।
স্বপ্নের ডায়েরি: প্রশ্নের অন্তহীন মালা
মন যদি মস্তিষ্কেরই সৃষ্টি হয়, তাহলে কেন স্বপ্নে মৃত প্রিয়জনের হাসি শুনি?
চেতনা কি কেবল নিউরনের বিদ্যুৎ-নাচ, নাকি আকাশের ওপার থেকে আসা কোনো আলতো ছোঁয়া?
মুখোশের নাচ: আসল মুখ কোথায়?
\"মানুষই সেই প্রাণী, যে মুখোশ পাল্টে নিজের পরিচয় খোঁজে।\" —অজানা
প্রতিদিন আমরা নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন রূপে গড়ে তুলি—সোশ্যাল মিডিয়ার ছবিতে, প্রিয়জনের সাথে চ্যাটে, অফিসের করিডোরে।
জঁ-পল সার্ত্র বলেছিলেন, \"আগে অস্তিত্ব, তারপর তার মানে তৈরি হয়।\"
আমরা ফাঁকা ক্যানভাস নিয়ে জন্মাই—জীবনজুড়ে রং ছড়িয়ে একটা ছবি আঁকি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সেই ছবি কি আসলে আমাদের নিজের? নাকি সমাজের, বাবা-মায়ের, ফলোয়ারদের আঁকা কোনো নকল প্রতিচ্ছবি?
ছোট্ট একটি খোলা প্রশ্ন:
সব লেবেল—ধর্ম, পেশা, জাত, লিঙ্গ—ছিঁড়ে ফেললে, শেষ অবশিষ্ট থাকে কি?
সম্ভবত দুইটি মাত্র অসমাপ্ত প্রশ্ন:
\"আমি কে?\"
\"কেন আছি?\"
স্বাধীন ইচ্ছা নাকি পূর্বনির্ধারিত গল্প?
\"যদি সৃষ্টিকর্তা আগেই সব জানেন, তবে আমাদের স্বাধীনতা আসলে একধরনের ছলনা।\" —স্পিনোজা
নিউরোসায়েন্টিস্ট বেনজামিন লিবেটের পরীক্ষায় দেখা গেছে—আমরা সিদ্ধান্ত নিই তারও ০.৩ সেকেন্ড আগে মস্তিষ্ক কাজ শুরু করে।
তাহলে আমাদের \'ইচ্ছা\' কি কেবল একটা গল্প, যা আমরা নিজেরা নিজেদের বলি?
স্টোয়িকরা বলেন, \"ইচ্ছাকে নয়, প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করো।\"
কিন্তু প্রতিক্রিয়াও যদি নির্ধারিত থাকে?
ছোট্ট ধাঁধা:
খুনি কি আসলে নিজেই দায়ী, নাকি তার ডিএনএ, শৈশবের ক্ষত, সমাজের অন্ধকার?
প্রেম কি কেবল ডোপামিনের এক ফোটা উল্লাস, নাকি আত্মার মুক্তির সঙ্গীত?
বেদনার ফুল: ব্যথা থেকে সৌন্দর্য
\"যন্ত্রণাই সৌন্দর্যের জন্মদাত্রী, ঠিক যেমন ঝিনুকে জন্ম নেয় মুক্তো।\" —খলিল জিবরান
মানুষই সেই প্রাণী, যে কান্না থেকে কবিতা গড়ে, ব্যর্থতা থেকে ছবি আঁকে।
ফ্রয়েড বলেছিলেন, \"সভ্যতার মূল্য দিতে হয় মন খারাপের মাধ্যমে।\"
আর নীটশে হেঁকে বলেছিলেন, \"যন্ত্রণাই মানুষকে দেবদূত কিংবা দানবে রূপান্তর করে।\"
বাংলাদেশের মিছিলের গান, রবীন্দ্রনাথের \'গীতাঞ্জলি\', কিংবা ভ্যান গগের \'তারার রাত\'—সবই সেই ব্যথার রঙে আঁকা মহৎ সৃষ্টি।
ভিড়ের ভেতর নিঃসঙ্গতা
\"একাকী মানুষ জ্ঞানী হয়, আর দলে মানুষ হয়ে যায় পাগল।\" —গুস্তাভ ল্য বন
টুইটার থেকে শুরু করে যুদ্ধের ময়দান—সবই দলের উন্মাদনার খেলা।
কার্ল জুং বলেছিলেন, আমরা এক অদৃশ্য সমষ্টিগত চেতনার সুতায় বাঁধা।
কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—আমরা কেন বারবার নিজেদের লেবেল দেই, নিজেদের খাঁচা বানাই?
মৃত্যুভয়: সব দর্শনের জন্ম
\"মৃত্যুর ভয়ই দর্শনের জন্মদাতা।\" —হাইডেগার
মানুষ জানে সে মরবে—এই জ্ঞানই তাকে প্রশ্ন করতে শেখায়, ঈশ্বর খুঁজতে শেখায়, নাস্তিক হতে শেখায়।
বৌদ্ধরা বলেন: মৃত্যু মানে নতুন শুরু।
অস্তিত্ববাদীরা বলেন: মৃত্যুই জীবনকে অর্থ দেয়।
নাস্তিকরা বলেন: মৃত্যুই শেষ পাতা।
মানুষ বনাম যন্ত্র: ভবিষ্যতের দ্বন্দ্ব
যেদিন যন্ত্র হাসবে, সেদিন মানুষ হারাবে তার শেষ অহংকার।\" —আইজাক আসিমভ
চ্যাটজিপিটি কবিতা লেখে, ডাল-ই ছবি আঁকে।
তবে কি সৃষ্টি হচ্ছে, নাকি নিছক অনুকরণ?
শেষ কথা
মন কোনো বই নয়, যার শেষ পাতা আছে। মন হলো এক উত্তাল নদী—পানির ওপরে ভাসে উত্তরহীন প্রশ্নের নৌকা, তলদেশে জমে থাকে বিস্ময়ের স্ফটিক।
মানুষের মন নিজেকে সম্পূর্ণ বোঝে না, আর হয়তো এই না-বোঝার মাঝেই লুকিয়ে আছে তার সবচেয়ে বড় আনন্দ।
রুমির এক অমলিন বাণীতে: \"আমি খুঁজছি না কিছু, খোঁজাটাই আমার আসল গন্তব্য।\"