img

ভার্চুয়াল ওমরাহ!

প্রকাশিত :  ০৫:৪৩, ১৩ মে ২০২৫

ভার্চুয়াল ওমরাহ!

প্রথম আলোর ভোরের মতোই নিঃশব্দে একদিন বাচ্চু মিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় আবির্ভূত হয়েছিল। একসময় সে ছিল অচেনা এক মুখ—মাঝারি মানের বক্তা, যার ভিডিওতে লাইক পড়ত সীমিত সংখ্যায়। কিন্তু হঠাৎই সে বদলে গেল। ফেসবুক-ইউটিউবের গণ্ডি পেরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল গ্লোবাল ‘হুজুর ইনফ্লুয়েন্সার’ হিসেবে। আজ সে শুধু বক্তা নয়, উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক, আর কেউ কেউ বলে—‘ঈমানের ডিজিটাল বিপণনকারী’!  

তার নতুন উদ্যোগের নাম—‘উম্মাহ ট্যুর’। প্রথমে শুনলে মনে হতে পারে এটি কোনো পর্যটন সংস্থা। কিন্তু না, এটি একধরনের আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার সরবরাহকারী। তাদের দেওয়া ‘ওমরাহ প্যাকেজ’-এ পাসপোর্ট, ভিসা বা ফ্লাইট টিকিটের প্রয়োজন নেই। শুধু একটি স্মার্টফোন আর ‘খাঁটি নিয়ত’ থাকলেই চলবে! বাচ্চুর কথায়, ‘ভাই ও বোনেরা! জান্নাত এখন হাতের মুঠোয়, মোবাইলের স্ক্রিনে তাওয়াফ করলেই হজ আদায়!’  

ইউটিউবে লাইভে বাচ্চুর প্রথম আবির্ভাব ছিল ব্যতিক্রমী আয়োজন। ঝকঝকে টুপি, কাবা শরিফের এইচডি ব্যাকগ্রাউন্ড, আর মিষ্টি কণ্ঠে আহ্বান: ‘আমার ভাই ও বোনেরা! যারা জীবনে হজ করতে পারেননি, তাদের জন্য জান্নাতি ডিসকাউন্টে ভার্চুয়াল ওমরাহ প্যাকেজ!’ দর্শকদের চোখ ছানাবড়া। কীভাবে সম্ভব? বাচ্চুর ব্যাখ্যা: মোবাইলে কাবার ৩৬০ ডিগ্রি ভিডিও চালু করুন, আঙুলে ঘোরান স্ক্রিন। নিয়ত খাঁটি হলে সাত চক্করে আমল সম্পন্ন!  

কমেন্টবক্সে একের পর এক প্রশ্ন: ‘ভাই, ফোনের স্ক্রিন ছোট হলে তাওয়াফ ঠিক হবে?’ বাচ্চুর উত্তর: ‘নিয়ত বড় হলেই সব কবুল, স্ক্রিন ছোট হলে গুনাহ নেই!’ অন্য জিজ্ঞাসা: ‘তাওয়াফ করতে ফোন গরম হয়ে গেলে?’ বাচ্চুর মজাদার জবাব: ‘ফ্যানের নিচে বসুন। ফোন গরম, নিয়ত ঠাণ্ডা থাকলেই চলবে!’  

এরপর আসে প্যাকেজের বিবরণ। প্রিমিয়াম ভার্সন ৯৯৯ টাকায় মিলবে লাইভ হুজুরের গাইডেন্স—‘এখন আপনি হাজরে আসওয়াদের সামনে...’ ইকোনমি ভার্সন ২৯৯ টাকায় ভিডিও ডাউনলোড করে অফলাইনে আমল। বাড়তি সুবিধা: নফল নামাজের অডিও গাইড, যাতে নামাজে ‘কষ্ট’ না হয়!  

আরো আছে বোনাস! কমেন্টে ‘আমি জান্নাত চাই’ লিখলেই মিলবে বাচ্চুর বিশেষ ভিডিও মেসেজ—‘তুমি জান্নাতের যোগ্য, মাশাআল্লাহ!’ সাথে ফ্রি ‘জান্নাতি সুরা বুকমার্ক’—ইসলামি বইয়ে রাখলে ঈমানি অনুভূতি বাড়বে!  

এই উদ্যোগে হতভম্ব ঢাকার হজ দালালরা। পুরান ঢাকার জাফর ভাই, দশ বছরের অভিজ্ঞ হজ এজেন্ট, কফিশপে বললেন: ‘এ কী হুজুর! মোবাইলে হজ করায়?’ পাশের বন্ধু ঠাট্টা করল: ‘আপনি প্রথাগত, বাচ্চু ডিজিটাল। আপনার হজ কষ্টসাধ্য, ওরটা ক্লিকসাধ্য!’  

বাচ্চুর ‘উম্মাহ স্টুডিও’ অ্যাপে এখন ইসলামি ফিল্টার। ইনস্টাগ্রামে সেলফি তুললেই অটো-ক্যাপশন: ‘ইয়া আল্লাহ, হেদায়েত দাও!’ টিকটকে ভিডিও পোস্ট করলে স্ক্রলে ভেসে উঠবে: ‘দুনিয়ার ধুলোয় ঢেকে থাকলেও জান্নাতে ঝলমকে হবো!’ এক অদ্ভুত ধর্মীয় ইনফ্লুয়েন্স!  

আন্তর্জাতিক সফরে প্লেনে উঠেই বাচ্চু লাইভ শুরু করে: ‘ভাই ও বোনেরা! প্লেন উঠছে, যেমন আমরা জান্নাতে উঠব। সবাই বলুন—সুবহানাল্লাহ!’ যাত্রীরা প্রথমে অবাক, পরে জিকিরে মগ্ন। এয়ার হোস্টেসের প্রশ্ন: ‘স্যার, জিকিরের জন্য অ্যাপ লাগবে?’ বাচ্চুর হাসি: ‘না বোন, নিয়তই যথেষ্ট!’  

এরপর ‘হালাল হোটেল’ চালু—মেনুতে ‘ঈমান এক্সপ্রেসো’, ‘তাকওয়া টোস্ট’, আর ‘সুরা হালিম’! এক গ্রাহকের মন্তব্য: ‘হালিম খেয়ে মনে হলো জান্নাতের ট্রায়াল ভার্সন পেলাম!’ এমনকি বিয়ের প্যাকেজও: ‘হালাল বিয়ে, হাই রেজুলেশনে!’ কমেন্টে কেউ লিখল: ‘এই জুটি নিশ্চয় জান্নাতের টিকিট পাবে!’  

সবশেষে ঘোষণা: ‘খুলছি উম্মাহ ট্যুর ইন্টারন্যাশনাল! দুনিয়ার সব গুনাহের দোকানে তালা দিয়ে জান্নাতি প্যাকেজ আনব!’ ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখা: ‘জান্নাত এখন গুগল ম্যাপে। নিয়ত দিয়ে সার্চ করুন!’  

বাচ্চু মিয়া—একজন বিপণনকারী, বক্তা, উদ্যোক্তা, প্রযুক্তিবিদ, আর ঈমানের ডিজিটাল দূত। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়: এটা ঈমানের নবজাগরণ নাকি কনটেন্ট-বেসড বাণিজ্যিক ছলনা?  

যেখানে ধর্মের স্থান হওয়া উচিত ছিল আত্মিক অনুশীলনে, সেখানে তা পরিণত হচ্ছে বাণিজ্যের হাতিয়ারে। বাচ্চু মিয়াদের কর্মকাণ্ড যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—ধর্ম এখন পণ্য! হয়তো এর মাধ্যমে কেউ ঈমানের পথ পাবে, কিন্তু যদি এটা শুধু প্রযুক্তি ও মুনাফার খেলায় পরিণত হয়, তবে ভাবনা জাগে: আমরা কি ঈমানের ‘মোবাইল ভার্সনে’ ঢুকে পড়েছি?  

জান্নাত কী এখন অ্যাপে কেনার পণ্য? এই প্রশ্ন আজ সমাজ, চিন্তা আর আত্মার দরজায় জোরালো আঘাত করছে।

img

বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা

প্রকাশিত :  ১৮:৫৫, ১১ জুন ২০২৫

গত এক দশকে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা অন্যান্য ধর্মের তুলনায় সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি অন্যান্য সব প্রধান ধর্মের সম্মিলিত প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে ইসলামের সম্প্রসারণ। ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, ইসলাম এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম।
গবেষণাটি ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কাল ঘিরে পরিচালিত হয়েছে এবং এটি ‘গ্লোবাল রিলিজিয়াস ল্যান্ডস্কেপ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

পিউ রিসার্চ জানিয়েছে, ইসলাম ধর্মে এই বৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি হলো প্রাকৃতিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি। ধর্মান্তরণের ভূমিকা এখানে খুবই সীমিত। মুসলিম পরিবারে গড় সন্তানসংখ্যা অন্য ধর্মের তুলনায় বেশি। বর্তমানে সারাবিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ এই ধর্মের অনুসারী।
২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতি মুসলিম নারী গড়ে ২.৯ সন্তান জন্ম দিয়েছেন, যেখানে অমুসলিম নারীর ক্ষেত্রে এই হার ২.২। তাছাড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর গড় বয়স তুলনামূলকভাবে কম, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
গবেষণা অনুযায়ী, খ্রিষ্টধর্ম এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্ম, যার অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি। তবে ইসলাম দ্রুত বাড়তে থাকায় দুই ধর্মের মধ্যকার সংখ্যাগত ব্যবধান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
২০১০ সাল থেকে খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীর সংখ্যা বিশ্বে গড়ে ১.৮ শতাংশ হারে কমেছে। এ সময়ে ইসলাম ধর্মের অনুসারী বেড়েছে প্রায় ৩৫ কোটি, যা খ্রিষ্টধর্মের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
অঞ্চলভিত্তিক পরিবর্তন
বিশ্বজুড়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেই ইসলাম ধর্মের প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। কাজাখস্তান, বেনিন ও লেবাননে ইসলাম ধর্মে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে। তবে ওমান ও তানজানিয়ায় মুসলমানদের অনুপাত কিছুটা কমেছে।
ধর্মহীন মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। চীনে সবচেয়ে বেশি ধর্মহীন মানুষ বাস করেন, যাদের সংখ্যা প্রায় ১৩০ কোটি। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মহীন মানুষের সংখ্যা ২০১০ সালের তুলনায় বেড়েছে ৯৭ শতাংশ।
ধর্মত্যাগ ও ধর্মান্তর প্রবণতা
গবেষণায় দেখা গেছে, খ্রিষ্টধর্ম, হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মে ধর্মত্যাগের হার ধর্মান্তরের চেয়ে বেশি।
বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্মে, প্রতি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নতুন অনুসারীর বিপরীতে তিনজন ধর্ম ত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে, ধর্মহীনতায় প্রবেশের হারও বেশি—প্রতি একজন ধর্মহীনতা ছেড়েছেন, আর তিনজন নতুন করে ধর্মহীন হয়েছেন।

তবে ইসলাম একমাত্র প্রধান ধর্ম, যেখানে ধর্মান্তরিত হয়ে আসা মানুষের সংখ্যা ধর্মত্যাগীদের চেয়ে বেশি।

বিশ্ব ধর্মের বর্তমান চিত্র
ইসলাম : এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। প্রায় ২০০ কোটি মানুষ এই ধর্মের অনুসারী, যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ।
খ্রিষ্টধর্ম : বৃহত্তম ধর্ম, যার অনুসারী সংখ্যা ২৩০ কোটি।
ধর্মহীন : সংখ্যা বেড়ে ২০০ কোটিতে, ২০১০ সালের তুলনায় বেড়েছে ২৭ কোটি।
হিন্দুধর্ম : তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম, এর ১২০ কোটি অনুসারী রয়েছে; গত এক দশকে বেড়েছে ১২.৬ কোটি, তবে বৈশ্বিক হারে অপরিবর্তিত।

বৌদ্ধধর্ম : একমাত্র ধর্ম যার অনুসারীর সংখ্যা কমেছে — ১.৮৬ কোটি হ্রাস পেয়ে হার ৫% থেকে ৪%-এ নেমেছে।
ইহুদি ধর্ম : গত এক দশকে এর মাত্র ১০ লাখ জনসংখ্যা বেড়েছে। অন্যান্য ধর্ম (শিখ, বাহাই ইত্যাদি) সম্মিলিতভাবে প্রায় ২০ কোটি অনুসারী, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২.২ শতাংশ।
এই গবেষণাটি পরিষ্কারভাবে দেখায় যে, ইসলাম শুধু প্রাকৃতিকভাবে নয়, বৈশ্বিক ধর্মীয় পরিবর্তনের ধারাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি, ধর্মহীনতা ও ধর্মত্যাগের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আগামী দশকে বিশ্ব ধর্মীয় মানচিত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।