
শেয়ারবাজারে আস্থার পুনর্জন্ম: একদিনের উত্থান, না কি পরিবর্তনের ইঙ্গিত?

দীর্ঘদিনের নিস্তেজতা ও অবসাদের পর অবশেষে দেশের পুঁজিবাজারে যেন এক আশাব্যঞ্জক প্রভাতের আলো দেখা গেল। ১৬ জুন ২০২৫, সপ্তাহের দ্বিতীয় কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৫৯.৬৬ পয়েন্ট বা ১.২৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭৮৩.৬৬ পয়েন্টে। বাজারে প্রায় সর্বত্র শেয়ারের দরবৃদ্ধি, লেনদেনের গতি এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ফিরে আসা আত্মবিশ্বাস এক অনন্য বার্তা দিচ্ছে—পুঁজিবাজারে সম্ভাবনার দ্বার আবারও খুলতে শুরু করেছে।
এই উত্থান কেবল সংখ্যাতাত্ত্বিক নয়; এটি এক মনস্তাত্ত্বিক জয়ও বটে। বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন ধরে যে হতাশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন, আজকের দৃশ্য তাদের মনে নতুন আশা জাগিয়েছে। ৩৮৭টি কোম্পানির মধ্যে ৩১২টির দর বৃদ্ধি এবং মাত্র ৩৬টির দর হ্রাস—এই পরিসংখ্যান বাজারের প্রকৃত সেন্টিমেন্টেরই প্রতিফলন।
বাজারের চিত্র: এক উজ্জ্বল সকালের প্রতিচ্ছবি
দিনের শুরু থেকেই সূচকের ঊর্ধ্বমুখী ধারা, দুপুরের পর আরও তীব্র গতি এবং দিনশেষে দৃঢ় উত্থান—সব মিলিয়ে বাজারে ফিরে এসেছে বহু প্রতীক্ষিত প্রাণচাঞ্চল্য। এই ইতিবাচক গতিপথ যেমন বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে, তেমনি একটি সুস্থ ও শক্তিশালী বাজার কাঠামোর সম্ভাবনাকেও উন্মোচিত করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আজকের এমন বড় উত্থান আকস্মিক নয়। এর পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ:
দীর্ঘদিনের মন্দার পর বাজারের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরা,
সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পুঁজিবাজারবান্ধব কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত,
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ,
বৈশ্বিক অর্থনীতির তুলনামূলক স্থিতিশীল পরিবেশ।
বিশেষ করে আইসিবি, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং বড় অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ আজকের বাজারকে আরও গতিশীল করে তুলেছে।
খাতভিত্তিক পারফরম্যান্স: কারা ছিল এগিয়ে?
আজকের বাজারে বিশেষভাবে চাঙ্গা ছিল ব্যাংক, ফার্মাসিউটিক্যাল, বিদ্যুৎ ও নির্মাণ খাত। সরকারি অবকাঠামো প্রকল্পে গতি, ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে ডিভিডেন্ড প্রত্যাশা, জ্বালানি খাতে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা—এসব কারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এখন প্রশ্ন—এটা কি শুধুই একদিনের উল্লম্ফন, না কি এক টার্নিং পয়েন্ট?
পুঁজিবাজার একটি চলমান ও চক্রাকারে আবর্তিত অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া। দীর্ঘ পতনের পর উত্থান একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। তবে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—এই উত্থান কি ধারাবাহিকতা ও স্থিতিশীলতায় রূপ নিতে পারবে?
ডিএসইএক্স, ডিএসএসই এবং ডিএস৩০—তিনটি সূচকেরই আজকের শক্তিশালী গতি আগামী দিনের জন্য একটি ভিত্তি তৈরি করেছে। তবে এই গতিকে টেকসই করতে হলে সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও অংশীজনদের সম্মিলিতভাবে বিনিয়োগবান্ধব নীতি অব্যাহত রাখতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামীকাল অর্থাৎ ১৭ জুন বাজারে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকতে পারে। তবে যেসব বিনিয়োগকারী আজ লাভ করেছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুনাফা তুলে নিতে পারেন, ফলে সূচকে সামান্য চাপ তৈরি হতে পারে। তবুও সামগ্রিক প্রবণতা এখনো আশাব্যঞ্জক।
বিনিয়োগকারীদের করণীয়: আবেগ নয়, বিশ্লেষণ জরুরি
এমন মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের উচিত আবেগের বশে নয়, বরং তথ্যভিত্তিক ও বিশ্লেষণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির দিকে মনোযোগ দিন। গুজবের পেছনে না ছুটে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন, লভ্যাংশ ইতিহাস এবং খাতভিত্তিক সম্ভাবনা বিবেচনা করেই বিনিয়োগ করুন।
বিশ্লেষকদের সুপারিশ:
দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য স্থির করে বিনিয়োগ করুন,
কোম্পানির মৌলিক শক্তি ও পরিচালনা কাঠামো বিশ্লেষণ করুন,
প্রতিদিনের আর্থিক সংবাদ ও নীতিগত পরিবর্তনের প্রতি নজর রাখুন,
লভ্যাংশ ও কর্পোরেট ঘোষণার সময় জেনে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিন,
দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য যা প্রয়োজন।
আজকের সাফল্য সম্ভাবনার দরজা খুলেছে ঠিকই, কিন্তু সেই দরজা চিরকাল খোলা রাখতে হলে প্রয়োজন—
নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাহসী, স্বচ্ছ ও দৃঢ় অবস্থান,
বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় কার্যকর আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ,
প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা,
গুজব ও কারসাজি রোধে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি।
বিশ্বের অন্যান্য উদীয়মান বাজার যখন ডিজিটালাইজেশন, স্বচ্ছতা ও কর্পোরেট গভর্নেন্সে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশকেও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গঠনে একই গতিতে এগোতে হবে।
পুঁজিবাজার কেবল সূচকের ওঠানামা নয়; এটি জাতির অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য, বিনিয়োগ মনোভাব এবং ভবিষ্যতের প্রতিফলন। আজকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা আমাদের শেখায়—আস্থা, পরিকল্পনা ও দায়িত্বশীলতার সমন্বয়েই গড়ে উঠতে পারে একটি শক্তিশালী ভবিষ্যৎ।
সেই ভবিষ্যতের ভিত্তি যেন আজকের এই হাসিমাখা মুখগুলোতেই গাঁথা থাকে—এই প্রত্যাশায় এগিয়ে যাক বাংলাদেশের পুঁজিবাজার।