img

শেখ হাসিনার পর কে?

প্রকাশিত :  ১৩:২৩, ১৯ জুন ২০১৯
সর্বশেষ আপডেট: ১৩:৩০, ১৯ জুন ২০১৯

শেখ হাসিনার পর কে?

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে এখন বিশ্ব পরিচিত নেতা এবং শুধু হাসিনা নামেই সবাই তাঁকে চিনে ফেলে, এটা বিদেশে বাস করি বলে স্পষ্ট বুঝতে পারি। তা ছাড়া তাঁর খ্যাতির পরিধিটাও বড়। লন্ডন শহর এখন টোরি দলের নতুন নেতা এবং টেরেসা মের স্থলাভিষিক্ত নতুন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা নিয়ে বিতর্কে মুখর। দৌড়ে বরিস জনসন এগিয়ে আছেন। দেখতে, শুনতে এবং কেশবিন্যাসেও তিনি অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো।

ডোনাল্ড ট্রাম্পও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। এবার লন্ডন সফরে এসে প্রকাশ্যেই বলেছেন, বরিস ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি খুশি হন। ট্রাম্পের ভাবসাব, কথাবার্তায় মনে হয় তিনি সম্ভবত ব্রিটেনকে এখন আমেরিকার উপনিবেশ মনে করেন। সেভাবেই ব্রিটেনকে উপদেশের আড়ালে নানা নির্দেশ দেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়লে তিনি ব্রিটেনকে ব্যবসা-বাণিজ্যে আঁচল ভরিয়ে দেবেন, বরিসকে যেন প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) যেন তাঁর হাতে (আমেরিকার) তুলে দেওয়া হয়। এই সার্ভিস তাঁর হাতে নিরাপদ থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

অন্যান্য দেশের মতো ব্রিটেনেও এখন বাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল। তাই ইরাক যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র লন্ডন সফরে এলে বিশাল জনবিক্ষোভের মুখে বাকিংহাম প্রাসাদ ছেড়ে লন্ডনের রাস্তায় নামতে পারেননি। এবার বুশের চেয়েও নিন্দিত ও বিতর্কিত ডোনাল্ড ট্রাম্প লন্ডনে এলে রাজপথে বিরাট বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁকে বুশের মতো গৃহবন্দি করে রাখা যায়নি, তাঁর লম্ফঝম্ফও বন্ধ করা যায়নি।

ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে লাভ নেই। শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে আসি। বলছিলাম ছোট ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বের বিশাল পরিধিতে তাঁর পরিচিত ও আলোচিত হওয়ার কথা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের রেস্টুরেন্টে এক লেবার দলীয় তরুণ এমপির সঙ্গে খেতে গেছি। উদ্দেশ্য ছিল টোরি দলের নতুন নেতা নির্বাচন সম্পর্কে উত্তপ্ত ঘরোয়া বিতর্ক উপভোগ করা এবং পার্লামেন্টের রেস্টুরেন্টে আজকাল ডাল-ভাত খাদ্য তালিকায় আসায় তার স্বাদ নেওয়া।

খেতে বসে বন্ধু এমপি একসময় জিজ্ঞেস করলেন, এবার বরিসই হয়তো টোরি দলের নেতৃত্বে বসবেন, তোমাদের দেশের খবর কী? শেখ হাসিনার বিকল্প কোনো নেতা তো শুধু আওয়ামী লীগে নয়, তোমাদের দেশেও দেখছি না, তাহলে দলের পরবর্তী নেতা কে হবেন, ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রীই বা কে হবেন? উপমহাদেশে এতকালের পরিবারতন্ত্রও অচল হতে চলেছে। ভারতে রাহুল গান্ধীর পরিণাম দেখলে তো।

বললাম, বাংলাদেশ নিয়ে এসব ভাবনা এখন কেউ ভাবছে না। সামনে আওয়ামী লীগের জন্য আরো পাঁচ বছর পড়ে আছে। শেখ হাসিনা এখনো দলের নেতৃত্বের হাল ধরে আছেন এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর পদেও আসীন। দেশের রাজনীতিও এখন মোটামুটি স্থিতিশীল। আশা করা যায়, অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন গতিশীল রাখতে পারলে আগামী নির্বাচনেও মানুষ শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় চাইবে।

বন্ধু এমপি বললেন, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশে কী হবে তুমি তা জানো না। হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন পরবর্তী নির্বাচনে তিনি নেতৃত্ব দেবেন না। ক্ষমতায়ও থাকতে চান না। এ অবস্থায় শেখ হাসিনার এবং তাঁর দলেরই তো উচিত আওয়ামী লীগের জন্য এখনই একজন যোগ্য ও দক্ষ নেতা খুঁজে বের করা এবং সময় থাকতে তাঁকে জনগণের কাছে পরিচিত করে তোলা। না হলে খালেদাবিহীন বিএনপির যে দশা হয়েছে, হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগের কি সেই অবস্থা হবে না?

তাঁকে বললাম, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণার সঙ্গে আমার ধারণার একটা পার্থক্য আছে। অবশ্য আমাদের দুজনের ধারণার মধ্যে কার ধারণা সফল হবে, তা বলতে পারি না। প্রথমে শেখ হাসিনার আগামী নির্বাচনে, যা এখনো পাঁচ বছর দূরে, তাতে নেতৃত্ব না দেওয়ার সম্পর্কে বলি? চার-চারবার দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকার পর শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই ক্লান্তিবোধ করছেন এবং যথার্থভাবেই রাজনীতির সম্মুখ সারি থেকে সরে যেতে চাইছেন। এটা অনেক দেশের জনপ্রিয় নেতাই চান।

কিন্তু জনগণের বিপুলভাবে আস্থাভাজন কোনো নেতা যদি দেখেন, দেশের কল্যাণের স্বার্থেই তাঁকে ক্ষমতায় রাখতে জনগণ উন্মুখ, তাহলে তাঁকে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়। একবার ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয়ের পর জামাল নাসের মিসরের প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু কায়রোর রাজপথে উত্তাল জনগণের দাবিতে তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছিল।

এটা শেখ হাসিনার জীবনেও ঘটেছে। এরশাদের আমলে এক সাধারণ নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্বে ইস্তফা দিয়েছিলেন। দলের নেতাকর্মীরা শুধু নয়, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করার দাবিতে। তাঁকে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। ভবিষ্যতেও শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব ছেড়ে রাজনীতির পেছনের সারিতে যেতে চাইলে একই অবস্থার উদ্ভব ঘটবে। তা ছাড়া তাঁর রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের বয়সও হয়নি। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭২ বছর। পাঁচ বছর পরেও তিনি ৮০ বছর বয়সে পৌঁছাবেন না। দ্য গল, চার্চিল, রিগ্যান, মাহাথির প্রমুখ নেতা বয়সের তোয়াক্কা করে ক্ষমতায় থাকেননি। যদি দেশের স্বার্থে প্রয়োজন পড়ে তাহলে সক্ষমতা থাকা পর্যন্ত হাসিনা কেন ক্ষমতায় থাকবেন না? ইসরায়েলের নেতানিয়াহু এবার নিয়ে কত দফা ক্ষমতায় আছেন?

ব্রিটিশ এমপি বন্ধুকে বললাম, খালেদাবিহীন বিএনপির আজ যে অবস্থা, হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগের সেই অবস্থা হবে তা মনে করি না। বিএনপির জন্ম ক্যান্টনমেন্টে এবং নেতৃত্ব ব্যক্তি ও পরিবারভিত্তিক। জনগণের মধ্যে এই দলের কোনো শিকড় (root) নেই। এই দলের পরিণতি ঘটতে চলেছে মুসলিম লীগের মতো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের জন্ম গণ-আন্দোলন থেকে। দলে নেতৃত্ব ও নীতির ক্রমবিবর্তন হয়েছে। নেতৃত্বেও বারবার বদল ঘটেছে। দলটির জন্ম মূলত মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। পরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বসেন। মওলানা ভাসানীর পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।

শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বসেন। ছয় দফা আন্দোলনের সময় শেখ মুজিব কারাগারে বসে আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। তাঁর মৃত্যুর পর বেগম জোহরা তাজউদ্দীন ও আবদুল মালেক দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। লিখতে ভুলে গেছি, বঙ্গবন্ধু যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন কামারুজ্জামানের ওপর। সর্বশেষ শেখ হাসিনা দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং এখনো আছেন। তাঁর নেতৃত্বেই দল আবার শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং এখনো শাসন ক্ষমতায় আছে।

দলের নেতৃত্বের মতো নীতিরও পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ছিল একটি মডারেট সাম্প্রদায়িক দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দলটি গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল হিসেবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি মডার্ন ও সেক্যুলার ডেমোক্র্যাট পার্টি। প্রতিটি সংকটে আওয়ামী লীগের ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি আছে এবং নেতৃত্ববিহীন অবস্থায় নতুন নেতা তৈরির সক্ষমতা আছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর চরম নেতৃত্বহীন অবস্থায় দলটি কি নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে সক্ষমতা দেখায়নি? হাসিনা-নেতৃত্ব কি উঠে আসেনি?

আমার বক্তব্য শেষ করে বন্ধু ব্রিটিশ এমপিকে বলেছি, অবশ্যই বাংলাদেশের গণতন্ত্র চিরকাল এক দল, এক নেতানির্ভর থাকুক তা দেশের মানুষ চায় না। কিন্তু বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত—এরা গণতান্ত্রিক দল নয় এবং আওয়ামী লীগের বিকল্প দলও নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দল ও নেতৃত্ব গড়ে ওঠা দরকার। আজকের সুধীসমাজ নামক গোষ্ঠীর ছড়ানো বিভ্রান্তি থেকে দেশের মানুষ চূড়ান্তভাবে মুক্ত হলে জনগণের চাহিদা, আন্দোলন ও উদ্যোগ থেকে বিকল্প রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব গড়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। পচা শামুকে বারবার জনগণের পা কাটবে না।

মতামত এর আরও খবর

img

গাজা যুদ্ধ বন্ধে বাইডেন কেন এতটা মরিয়া

প্রকাশিত :  ১১:৪১, ১২ মে ২০২৪
সর্বশেষ আপডেট: ১১:৪৮, ১২ মে ২০২৪

জনাথন ফ্রিডল্যান্ড

দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হবেন কি না তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উদ্বেগ একেবারে প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। জো বাইডেনের পরামর্শ বারবার উপেক্ষা করে আসছিলেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এই উপেক্ষার মূল্য কী হতে পারে, এই সপ্তাহে ইসরায়েল সেটা দেখতে পেল।

ইসরায়েলের ৩ হাজার ৫০০ বোমার চালান আটকে দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। এই অস্ত্র ইসরায়েল গাজার দক্ষিণের শহর রাফা আক্রমণে ব্যবহার করবে, সেই বিবেচনায় অস্ত্রের চালানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাফায় এখন ১০ লাখের বেশি শরণার্থীর আশ্রয়শিবির।

ইসরায়েলের প্রতি জো বাইডেন তাঁর ‘লৌহদৃঢ়’ সমর্থন থেকে সরে আসছেন না। কিন্তু ইসরায়েল রাফা হামলার জন্য যে হুমকি দিয়ে চলেছে, সেটা সফল করতে অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করবেন না। সিএনএনকে বাইডেন বলেছেন, ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা দেওয়া থেকে আমরা সরে আসছি না। অন্যখানে যুদ্ধ করার সক্ষমতা তৈরির পথ থেকে সরে আসছি আমরা।’

ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন বলতেন, তাঁর দেশের ১ নম্বর কৌশলগত সম্পদ এই সব অস্ত্র, এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র নয়; বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক। দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের জোগানদাতা ও কূটনৈতিক অভিভাবক। 

কিন্তু মাত্র ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে ওয়াশিংটন এমন দুটি পদক্ষেপ নিল, যা পুরোপুরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেল। গত মার্চ মাসে নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ইসরায়েল প্রস্তাবটি আটকে দিতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। আর এখন তো ওয়াশিংটন অস্ত্রের চালান আটকে দিল।

এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই সিদ্ধান্তগুলো এমন একজন রাজনীতিবিদ নিয়েছেন, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ইসরায়েলের খুব নিবেদিতপ্রাণ সমর্থক। বাইডেন সেই যুগের একজন ডেমোক্র্যাট, যখন দুই সহস্রাব্দের নির্বাসন ও শাস্তির পর মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের আদি বাড়ি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গতি পেতে শুরু করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের চোখ তখন রহস্যজনকভাবে বন্ধ ছিল।  

গোল্ডা মেয়ার থেকে শুরু করে ইসরায়েলের প্রত্যেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাইডেন দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতি বাইডেনের টান বাড়ার ক্ষেত্রে এর একটার ভূমিকা আছে। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের মতো বাইডেনের ইসরায়েলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ শুধু নির্বাচনী হিসাব-নিকাশের বিষয় নয়।  

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’

অন্যদিকে ১৯৮০-এর দশকে নেতানিয়াহু প্রথম আলোচনার পাদপ্রদীপে উঠে আসেন। তিনি এমন একজন কূটনীতিক, যিনি আমেরিকানদের সঙ্গে সাবলীলভাবে কথা বলতেন। সে সময় থেকেই তিনি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাঁড় করান। ইসরায়েলের একজন হবু নেতার জন্য এই দক্ষতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। 

কয়েক দশক ধরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর ভোটারদের এই বার্তা দিয়ে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যকার সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি।

কিন্তু বাস্তব অবস্থাটা এখন কী দাঁড়াল?  চার দশকের বেশি সময়ের মধ্যে বাইডেনই প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করলেন। (১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন অভিযানের সময় রোনাল্ড রিগ্যান যুদ্ধবিমান দিতে বিলম্ব করেছিলেন।) বাইডেন কেন এটা করলেন? কারণ, নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের একটি অংশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন তিক্ততা তৈরি করেছেন, যেটা আগে দেখা যায়নি।

ইসরায়েলের প্রতি যে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজের নিরেট সমর্থন, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন আছড়ে পড়েছে, সেটা বিস্ময়করই। আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা গ্যালাপের মার্চ মাসের জরিপ বলছে, ৫১ শতাংশ ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, ২৭ শতাংশ সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনের পক্ষে। কিন্তু ডেমোক্র্যাট ও তরুণ জনগোষ্ঠী—দুই ক্ষেত্রেই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সমর্থন অনেকটাই বেড়েছে।

জরিপের এই তথ্য বাইডেন ও তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা দলকে চিন্তার মধ্যে ফেলেছে। এই অংশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনই ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করতে ভূমিকা রেখেছিল। গাজাবাসীর দুর্ভোগ সেই ভোটারদের সমর্থন অনিশ্চিত করে তুলেছে। হোয়াইট হাউস নেতানিয়াহুর কাছে পরিকল্পনা চেয়েছিলেন, বেসামরিক জনসাধারণকে হতাহত না করে কীভাবে রাফায় অভিযান করতে পারে ইসরায়েল। 

কিন্তু নেতানিয়াহু সেই পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণে ইসরায়েলকে থামানোর জন্য অস্ত্রের চালান আটকে দেওয়ার সরাসরি পথ বেছে নিয়েছে ওয়াশিংটন।

রাফা বাইডেনের জন্য শক্তি পরীক্ষার জায়গাও হয়ে উঠেছে। বাইডেন রাফাকে বিপদরেখা হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। নেতানিয়াহু যদি সেই বিপদরেখা অতিক্রম করেন, তাহলে বাইডেন দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

কিন্তু নেতানিয়াহু এখন পর্যন্ত রণেভঙ্গ দিতে অস্বীকার করেছেন। ইসরায়েলের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সামনে রেখে জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ছাড়া আমরা একাই লড়ে যাব। প্রয়োজনে আমরা আমাদের নখ দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাব।’ 

নেতানিয়াহু চার্চিলের মতো আওয়াজ তুলতে চাইছেন। কিন্তু তাঁর কথাগুলো দুর্বলের কণ্ঠস্বর, সবলের নয়। ওয়াশিংটন চায়, নেতানিয়াহু যেন রাফা অভিযান থেকে সরে আসেন। কিন্তু জোট সরকারের অতি ডানপন্থী মিত্ররা তাঁকে আরও কঠোর হতে বলছেন, রাফা অভিযানের মাধ্যমে হামাসের বিরুদ্ধে পুরোপুরি বিজয়ের জন্য বলছেন।

এই নিরানন্দ নাটকে বাইডেন ও নেতানিয়াহুই কেবল কুশীলব নন; হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ারেরও নিজস্ব হিসাব-নিকাশ আছে, নেতা হিসেবে টিকে থাকার সংকল্প রয়েছে। খুব ঘনিষ্ঠভাবে যাঁরা সিনাওয়ারকেও পাঠ করেছেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, নির্দোষ মানুষের জীবন রক্ষা করা তাঁর অগ্রাধিকার নয়; বরং যত বেশি গাজাবাসী নিহত হবেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে তাঁর শত্রু ইসরায়েলে অবস্থান ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই পরিস্থিতি তাঁকে বিজয়ী দাবি করতে সহায়তা করবে। সম্প্রতি হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে নেওয়ার ঘোষণার পেছনে সিনাওয়ারের এই ভাবনায় কাজ করেছে। 

সিনাওয়ারা সাময়িক কোনো যুদ্ধবিরতি (তাতে অনেক মানুষের প্রাণরক্ষা হয়, দুর্ভোগ কমে) চান না, তিনি চান স্থায়ী যুদ্ধবিরতি। আর তার জন্য সিনাওয়ারা অপেক্ষা করতেও রাজি।

গাজা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু কিংবা সিনাওয়ারা কেউই বিশ্বাস করেন না, চুক্তি করলে তাঁদের স্বার্থ রক্ষিত হয়। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অ্যারন ডেভিড মিলার বলেছেন, ‘এই সংঘাত বন্ধে একটি পক্ষেরই কেবল সত্যিকারের তাড়া আছে, সেই পক্ষটি হলেন জো বাইডেন।’


জনাথন ফ্রিডল্যান্ড, ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের খ্যাতিমান কলামিস্ট

মতামত এর আরও খবর