তিতাসের করুণ মৃত্যু ও ভিআইপি চাকরদের
নাজমুল ইসলাম
----------------------------------------------------------
প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ মালিক জনগণ। দেশের সকল শ্রেণির সরকারি চাকরিজীবীর বেতন-ভাতা-খোরাকি আসে জনগণের ঘামঝরা টাকা থেকে। তাই আক্ষরিক অর্থে তারা জনগণের চাকরি করেন। সোজা কথায় তারা চাকর, জনগণ তাদের মনিব। এই সংজ্ঞার কোনও অন্যথা নেই, তিনি যত বড় চাকরই হোন না কেন। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সরকারি চাকুরেরা আপন দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে দেশের প্রতিটি নাগরিককে যথোপোযুক্ত সম্মান করতে মোটেও কুণ্ঠিত হন না। বিপত্তি কেবল আমাদের মত হতভাগ্য জাতির দেশে, যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছে; আজ তারা দলিত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত ।
সম্প্রতি একজন সরকারি কর্মকর্তার জন্য মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে তিন ঘণ্টা ফেরি আটকে রাখার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত। আর সেই কারণে নদী পার হতে পারেনি মুমূর্ষু রোগীর অ্যাম্বুলেন্স। শেষ পর্যন্ত ওই কর্মকর্তার গাড়ি এলো। অ্যাম্বুলেন্স জায়গাও পেলো। কিন্তু রোগীর জীবন রক্ষা পেলো না। তিনি ফেরিতেই মারা গেলেন। ঘটনাটি বৃহস্পতিবার রাতের।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ওই কর্মকর্তাকে পার করার জন্য ফেরি আটকে রাখেন মাদারীপুর জেলার ডেপুটি কমিশনার। ফেরিঘাটের কর্মকর্তাসহ অনেক পর্যায়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীর স্বজনরা ফোন করেও ফেরিটি নড়াতে পারেননি। এমনকি তারা পুলিশের ৯৯৯ নম্বরে ফোন করেও কোনও ফল পাননি। একজন মুমূর্ষু রোগীর জীবনের চেয়ে ওই ‘ভিআইপি’ সরকারি কর্মকর্তাই গুরুত্বপূর্ণ হলেন তাদের কাছে। জীবন গেলেও তারা পদকে সর্বোচ্চ ‘সম্মান’ দেখিয়েছেন।
আগে রোগী না ভিআইপি? এই প্রশ্নটি অনেক দিন ধরেই উঠছে আমাদের দেশে। অ্যাম্বুলেন্স আটকে কি ভিআইপি চলাচল করবেন? পৃথিবীর কোনও দেশেই রোগীর চেয়ে ভিআইপিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আর একজন যুগ্ম সচিব কি ভিআইপি? সরকারি চাকুরেরা আবার ভিআইপি হন কীভাবে?
একজন সরকারি চাকুরে তো প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। প্রজাতন্ত্রের চাকর। তিনি কোনোভাবেই শাসক নন। নাগরিকদের সার্ভিস দেওয়াই তার কাজ। নাগরিকদের ট্যাক্সের পয়সায় তাদের বেতন হয়। তাই তাদের মনে রাখা উচিত তারা নাগরিকদের চাকর, চাকুরে। কিন্তু বাস্তবে এই দেশে এখন ভৃত্য মনিব হয়েছে। মনিবকে ভৃত্য বানানো হয়েছে। চাকর মালিক হয়েছে। মালিক হয়েছে চাকর।
এই দেশটি যেন উল্টো পথে হাঁটছে। চাকরের পদের সঙ্গে প্রশাসক লাগানো হচ্ছে। নাগরিকদের শাসক হয়ে উঠছেন তারা। সংবিধান আর আইনের এই বিপরীত অবস্থা কোনোভাবেই একটি সুশীল ও নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্র তৈরি করতে পারে না।
যে রাষ্ট্র নাগরিকের, সেটাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রে নাগরিকদের সঙ্গে চাকরের মতো আচরণ করা হয়, সেটা লুটেরাদের রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্র লুটেরাদের দখলে চলে গেছে। তারা নাগরিকদের অর্থ লুটে নেয়। নাগরিকদের ট্যাক্স নেয়। কিন্তু নাগরিকদের কিছু দেয় না। উল্টো শোষণ করে। এটা হলে আমাদের এই রাষ্ট্র যাত্রা সংস্কার করতে হবে।
আমি মনে করি রাষ্ট্রের অনেক বিষয়েই ধোঁয়াশা আছে। আর তার সুযোগ নিচ্ছেন সরকারি চাকুরেরা। তারা নাগরিকদের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন নিয়ে আবার নাগরিকেদর প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাও দখল করছেন। তারা দিন দিন শাসক হওয়ার সব পথ প্রশস্ত করছেন। তারাই হয়ে উঠছেন রাষ্ট্রের মালিক। আর এটা অব্যাহত থাকলে এই রাষ্ট্র আর এই সমাজে একসময় আর নাগরিক খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবাইকে ভৃত্য বানিয়ে একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাবে। দেশটা একটা প্রশাসনিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
এসব কথা বাদ দিলেও যদি মানবিক দিক দিয়ে ভাবি? সড়ক দুর্ঘটনায় আহত একজন মুমূর্ষু রোগীর অ্যাম্বুলেন্স কি আটকে রাখা যায়! বড় কর্তার জন্য কি আটকে রাখা যায় ফেরি, যেখানে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। জীবনের চেয়ে কি ‘ভিআইপি’ বড়? এই মানবিক বোধও কি এই প্রজাতন্ত্রের চাকররা হারিয়ে ফেলছেন?
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, নির্বাহী সম্পাদক- জনমত