
প্রাচীন হিন্দু মন্দির প্রেয়া ভিহেয়ার (Preah Vihear) ঘিরে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের বিরোধ: ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

সংগ্রাম দত্ত: কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি প্রাচীন হিন্দু শিব মন্দির প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির (Preah Vihear Temple)। এই মন্দিরটি বর্তমানে কম্বোডিয়ার সীমানার মধ্যে হলেও, থাইল্যান্ড বহু বছর ধরেই দাবি করে আসছে যে মন্দিরটি তাদের। ফলে দীর্ঘদিন ধরে উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
৯ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যে খেমার সাম্রাজ্যের শাসনামলে প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির নির্মিত হয়। এটি খেমার রাজা সূর্যবর্মণ ১ এবং সূর্যবর্মণ ২ এর সময় নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। মন্দিরটি ভগবান শিব এর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। এটি আর্কিটেকচারও ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত মূল্যবান এবং এটি খেমার শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন।
প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দিরটি অবস্থিত দংরেক পাহাড়ের চূড়ায়। যা' কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড সীমান্তে। ভৌগোলিকভাবে মন্দিরটি সহজে প্রবেশযোগ্য থাইল্যান্ডের দিক থেকে, তবে রাজনৈতিকভাবে এটি কম্বোডিয়ার প্রদেশ প্রেহা ভিহেয়ারে অবস্থিত।
১৯০৪-১৯০৭ সালে ফরাসি শাসনাধীন ইন্দোচীন ও থাই রাজ্যের মধ্যে একটি সীমানা চুক্তি হয়। এর ফলে মন্দিরটি কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে পড়ে। কিন্তু থাইল্যান্ড ১৯৫০ এর দশকে তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।
১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) রায় দেয় যে, প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির কম্বোডিয়ার। কিন্তু এই রায় মানলেও, আশপাশের ভূমি নিয়ে বিরোধ অব্যাহত থাকে।
২০০৮ সালে ইউনেস্কো মন্দিরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করলে থাইল্যান্ডে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে দু’দেশের সেনাদের মধ্যে একাধিকবার সীমান্তে গুলি বিনিময় ও সামরিক সংঘর্ষ ঘটে। বিশেষ করে ২০১০ ও ২০১১ সালে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, যার ফলে বহু মানুষ আহত ও গৃহচ্যুত হয়।
মন্দিরটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি খেমার সাম্রাজ্যের শক্তি, কৃষ্টির ধারক ও ইতিহাসের সাক্ষী। উঁচু পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত হওয়ায় এর কৌশলগত গুরুত্বও কম নয়। তাই শুধু ধর্ম নয়, রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির শুধু কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতীক নয়, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রস্থল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটি কম্বোডিয়ার হলেও, দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষার জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান এখন সময়ের দাবি। এই প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ইতিহাস আমাদের শেখায় — প্রাচীন ঐতিহ্য সম্মান করতে হয়, কিন্তু তা যেন আধুনিক সংঘাতের কারণ না হয়।