img

প্রাচীন হিন্দু মন্দির প্রেয়া ভিহেয়ার (Preah Vihear) ঘিরে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের বিরোধ: ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

প্রকাশিত :  ০৫:৫৮, ২৬ জুলাই ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৬:২০, ২৬ জুলাই ২০২৫

প্রাচীন হিন্দু মন্দির প্রেয়া ভিহেয়ার (Preah Vihear) ঘিরে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের বিরোধ: ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

সংগ্রাম দত্ত: কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি প্রাচীন হিন্দু শিব মন্দির প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির (Preah Vihear Temple)। এই মন্দিরটি বর্তমানে কম্বোডিয়ার সীমানার মধ্যে হলেও, থাইল্যান্ড বহু বছর ধরেই দাবি করে আসছে যে মন্দিরটি তাদের। ফলে দীর্ঘদিন ধরে উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

 ৯ম থেকে ১২শ শতকের মধ্যে খেমার সাম্রাজ্যের শাসনামলে প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির নির্মিত হয়। এটি খেমার রাজা সূর্যবর্মণ ১ এবং সূর্যবর্মণ ২ এর সময় নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। মন্দিরটি ভগবান শিব এর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। এটি আর্কিটেকচারও ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত মূল্যবান এবং এটি খেমার শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন।

প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দিরটি অবস্থিত দংরেক পাহাড়ের চূড়ায়। যা' কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড সীমান্তে। ভৌগোলিকভাবে মন্দিরটি সহজে প্রবেশযোগ্য থাইল্যান্ডের দিক থেকে, তবে রাজনৈতিকভাবে এটি কম্বোডিয়ার প্রদেশ প্রেহা ভিহেয়ারে অবস্থিত।

১৯০৪-১৯০৭ সালে ফরাসি শাসনাধীন ইন্দোচীন ও থাই রাজ্যের মধ্যে একটি সীমানা চুক্তি হয়। এর ফলে মন্দিরটি কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে পড়ে। কিন্তু থাইল্যান্ড ১৯৫০ এর দশকে তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) রায় দেয় যে, প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির কম্বোডিয়ার। কিন্তু এই রায় মানলেও, আশপাশের ভূমি নিয়ে বিরোধ অব্যাহত থাকে।

২০০৮ সালে ইউনেস্কো মন্দিরটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করলে থাইল্যান্ডে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে দু’দেশের সেনাদের মধ্যে একাধিকবার সীমান্তে গুলি বিনিময় ও সামরিক সংঘর্ষ ঘটে। বিশেষ করে ২০১০ ও ২০১১ সালে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, যার ফলে বহু মানুষ আহত ও গৃহচ্যুত হয়।

মন্দিরটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি খেমার সাম্রাজ্যের শক্তি, কৃষ্টির ধারক ও ইতিহাসের সাক্ষী। উঁচু পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত হওয়ায় এর কৌশলগত গুরুত্বও কম নয়। তাই শুধু ধর্ম নয়, রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রেয়া ভিহেয়ার মন্দির শুধু কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতীক নয়, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রস্থল। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটি কম্বোডিয়ার হলেও, দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি রক্ষার জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান এখন সময়ের দাবি। এই প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের ইতিহাস আমাদের শেখায় — প্রাচীন ঐতিহ্য সম্মান করতে হয়, কিন্তু তা যেন আধুনিক সংঘাতের কারণ না হয়।

img

ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা : জীবন কোনো রঙ-তামাশা নয়

প্রকাশিত :  ০৮:০৭, ১৮ অক্টোবর ২০২৫
সর্বশেষ আপডেট: ০৮:১২, ১৮ অক্টোবর ২০২৫

শাইখ রাশিদ খান

ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো—এই ধর্ম দুনিয়াবী কর্মকাণ্ডকে নিরুত‍সাহিত করে না। ইসলাম আমাদের বলে না যে, আমরা ধন-সম্পদ, পরিবার, আরাম বা সৌন্দর্য পছন্দ না করি। বরং কুরআনে আল্লাহ নিজেই এগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন—এই জিনিসগুলো আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নয়।

কুরআনে বলা হয়েছে, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার শোভা। আর সৎকর্মসমূহ, যা চিরস্থায়ী, তা আপনার প্রতিপালকের নিকট অধিক প্রতিদানযোগ্য এবং প্রত্যাশার দিক দিয়ে উত্তম। (সূরা কাহাফ, আয়াত ৪৬)

এই আয়াত আমাদের শিখায় যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ধন-সম্পদ, মর্যাদা, পরিবার—সবই জীবনের সৌন্দর্য, কিন্তু এগুলো ভিত্তি নয় । এগুলো আমাদের আল্লাহর পথে সহায়তা করার জন্য, পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য নয়।

কুরআনের একটি বাস্তব উদাহরণ

সুরা কাহাফে এই আয়াতের আগেই আল্লাহ তায়ালা দুই ব্যক্তির একটি গল্প তুলে ধরেছেন, যাদের একজনের ছিল বিশাল বাগান, ফল-ফলাদি, নদী—সবই ছিল। কিন্তু সে অহংকারী হয়ে পড়ল। বলল, "আমি মনে করি না যে এটা কখনো শেষ হবে। " এমনকি সে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে, যদি কেয়ামত আসে, তাহলেও সে আরও ভালো কিছু পাবে। এখানে তার সম্পদে সমস্যা ছিল না—সমস্যা ছিল তার অহংকারে, তার আত্মতুষ্টিতে এবং আল্লাহকে ভুলে যাওয়ায়।

ইসলাম দুনিয়াকে পরিত্যাগ করতে বলে না

ইসলাম কখনোই ইহ জীবনকে পরিত্যাগ করতে বলে না। বরং বলে- অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে । দুনিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করো, কিন্তু আল্লাহর দায়িত্ব ভুলে যেও না। উম্মাহর দুঃখ-কষ্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।

আজ আমরা দেখছি একটা আশার আলো—অনেক সন্তান পবিত্র কুরআন হিফজ করছে, তরুণেরা মসজিদে ফিরছে, বড়রাও ইসলাম শিখছে । আলহামদুলিল্লাহ, এটি একটি বড় নিয়ামত, বিশেষ করে মুসলিম জাহান নানা কষ্টে আছে । কিন্তু এই ফিরে আসা যেন শুধু কোনো সংকট বা আবেগের প্রতিক্রিয়া না হয় । এটা হতে হবে স্থায়ী পরিবর্তন।

শুধু আবেগ দিয়ে ইসলাম চলে না

আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে নাড়া দেয় তখনই, যখন কোনো বড় ঘটনা ঘটে—যেমন গাজার কোনো খবর, অথবা কোনো হৃদয়বিদারক ভাষণ । আমরা তখন দান করি, দোয়া করি, কাঁদি। তারপর… ভুলে যাই।

ইসলাম এমন অস্থায়ী আবেগ চায় না। আল্লাহ চান নিয়মিত করা। তিনি চান গম্ভীরতা। শুধু মুহূর্তে নয়, মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আমরা যেন আন্তরিক থাকি।

ইসলাম চায় ত্যাগ—আবশ্যক নয়, প্রয়োজনীয়

সত্যিকার ঈমান মানে কিছু না কিছু ত্যাগ করা—সময়, সম্পদ, আরামপ্রদ জীবন । ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার বদলানো বা র‍্যালিতে অংশ নেওয়া সহজ, কিন্তু প্রকৃত সহমর্মিতার বহি:প্রকাশ হলো, রাতের বেলা উঠে দোয়া করা, নিয়মিত ও গোপনে দান করা, যখন কোনো খবর আর মিডিয়ার শিরানাম থাকেনা, তখনও কষ্ট অনুভব করা। যদি আমরা ১০ মিনিট সময় বের করে দোয়া করতে পারিনা, তাহলে ভাবা দরকার—আমরা আসলেই কতটা আন্তরিক?

আমরা আমাদের সন্তানদের কী শিখাচ্ছি?

যদি আমরা নিজেদের না বদলাই, তাহলে আমাদের সন্তানেরা ইসলামকে মনে করবে শুধু কোনো মজার অনুষ্ঠান বা অনলাইন কনটেন্ট । তারা বুঝবে না কষ্ট কীভাবে সহ্য করতে হয়। ইসলাম তাদের কাছে শুধু সুখের ধর্ম হয়ে উঠবে—উদ্দেশ্য, ইবাদত, দায়িত্বের ধর্ম নয়।

আল্লাহ বলেন, হে বিশ্বাসীগণ, ইসলাম পূর্ণরূপে গ্রহণ করো। (সূরা বাকারা, আয়াত ২০৮)

মানে, আধা-আধা নয়, সম্পূর্ণভাবে। শুধু আবেগে নয়, দায়িত্বেও।

রাসুল (সা:) বলেছেন “যে ব্যক্তি দুনিয়াকেই তার প্রধান চিন্তা বানায়, আল্লাহ তার সব কাজ বিখণ্ডিত করে দেন। কিন্তু যে ব্যক্তি আখিরাতকে তার চিন্তা বানায়, আল্লাহ তাকে পরিপূর্ণ করেন এবং দুনিয়াও তার কাছে আসে, যদিও সে সেটা চায় না।” আল্লাহকে আগে রাখলে, দুনিয়া আমাদের পেছনে আসে । দুনিয়াকে আগে রাখলে, নিজের মধ্যে শুধু শুন্যতা অনুভব হবে।

হে আল্লাহ, আমাদের আন্তরিক বানাও। আমাদের সাহায্য করো যেন আমরা সব কাজে তোমাকে অগ্রাধিকার দিই । তোমার জন্য ত্যাগ করতে শিখি। দুনিয়ার সৌন্দর্যে বিভোর না হই। উম্মাহর কষ্টে যেন আমাদের কষ্ট হয়, এমন অন্তর দাও। এবং আমাদের সন্তানদের শেখাও—ইসলাম শুধু আনন্দ নয়, দায়িত্ব, ত্যাগ আর পরিপূর্ণতা।


(ইস্ট লন্ডন মসজিদের জুমার খুতবা । তারিখ: ১০ অক্টোবর ২০২৫ ।
শায়েখ রাশিদ খান : অতিথি খাতিব ।)